বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

কর্ণাটক কী বার্তা দিল?
সমৃদ্ধ দত্ত

কর্ণাটক জানিয়েছে স্পষ্ট করে যে, ধর্মীয় বিভাজনের প্ররোচনামূলক প্রোপাগান্ডা সিনেমা দেখে ভোট দেওয়ার মতো বোকা তারা নয়। সাধারণ মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে ওইসব সিনেমা। ভোটে কিছুই এসে যায়নি। কর্ণাটক বুঝিয়ে দিয়েছে টিপু সুলতান ভালো না মন্দ, সেটা তারা আদি অনন্তকাল ধরে ইতিহাসের বই খুঁজে খুঁজে সিদ্ধান্ত নেবে। কোনও দল অথবা সংগঠন হঠাৎ করে ইতিহাস নিয়ে জ্ঞান বিতরণ করতে এলে কর্ণাটক সেটা মানবে না। কর্ণাটকের যুবসমাজ বার্তা দিয়েছে যে, ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষ্যে তারা গোলাপফুল কিনতেই পারে, ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে পার্কে বসতেই পারে। ইচ্ছা করলে প্রেম প্রস্তাব দেবে পরস্পরকে। এসব পশ্চিমী সভ্যতা পালন করা চলবে না, এই হুংকার দেওয়া  উগ্র সংগঠনের চোখ রাঙানি সহ্য করে নিজেদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে কর্ণাটক রাজি নয়। কর্ণাটক বুঝিয়ে দিয়েছে, নেহরু খারাপ, কংগ্রেস খারাপ, গান্ধী পরিবার খারাপ, গত ৭০ বছরে কিছুই হয়নি দেশে, ভারতের নবজন্ম হয়েছে ২০১৪ সালে, এরকম আজগুবি প্রচারে তারা গুরুত্বই দেয়নি। কর্ণাটক প্রমাণ দিয়েছে, মন্দির মসজিদ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, এনআরসি, সিএএ, এসবে কিছুই যায় আসে না তাদের। ওসবে মেতে উঠলে রাজনৈতিক দলের লাভ হয়। নেতারা মন্ত্রী বিধায়ক হন। মন্ত্রী বিধায়কদের প্রচুর স্যালারি ও সুযোগ সুবিধা। কিন্তু পাবলিকের কোনও সুবিধা হয় না। 
কর্ণাটক তাই এবার ভোট দেওয়ার সময় মনে মনে বলেছে, এই রইল আমার ভোট। এই ভোটটি মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে, এটা বেকারত্বের বিরুদ্ধে, এটা চরম আর্থিক মন্দার বিরুদ্ধে, এটা গ্যাসের দামের বিরুদ্ধে, এটা দাঙ্গা লাগানোর চক্রান্তের বিরুদ্ধে। এটা ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। এটা জোর করে  হিন্দি ভাষা আর উত্তর ভারতীয় কালচার চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে। কর্ণাটক একাই এইসব বার্তা দিয়েছে? একেবারেই নয়। দু’বছর আগে পূর্ব ভারতের আর একটি রাজ্য এই একই উত্তর দিয়ে দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গ বুঝিয়ে দিয়েছিল, তারা জাত গোখরোর এক ছোবলেই ছবি মার্কা সস্তা প্রচারের বিরুদ্ধে। তারা দেশের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মুখে ‘দিদি ও দিদি’ নামক নিম্নমানের ভাষার বিরুদ্ধে। তারা রবীন্দ্র নজরুলের বাঙালিকে সংস্কৃতির লেকচার দেওয়ার বিরুদ্ধে। অতএব ফলাফল পেয়েছে তারা। ২০২১ সালে বাংলায়। ২০২২ সালে হিমাচল প্রদেশে। ২০২৩ সালে কর্ণাটকে। 
কর্ণাটককে ধন্যবাদ। কর্ণাটক ভারতের আত্মা কী চায় এবং আবহমানকাল ধরে কী হয়ে এসেছে সেই বিস্ময়কর ফল্গুধারার মতো  দুটি ভাবধারাকেই সম্মান করেছে। সেই দুটি হল শান্তি, মৈত্রী ও স্বস্তির বার্তা। বেছে নিয়েছে নিত্যদিনের সমস্যা থেকে মুক্তির আশার দিককে। অবাস্তব ও বৃহৎ স্বপ্নের পিছনে সময় নষ্ট করেনি কর্ণাটক। তারা শুধু কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা চেয়েছে। সংসারের সুরাহা চেয়েছে। ভবিষ্যতের জন্য সামান্য সঞ্চয় হোক এটা চেয়েছে। যার ঘর নেই সে টাকা জমিয়ে বা ঋণ করে একটি নিজের বাড়ির স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রেপো রেট বাড়িয়ে বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের গৃহঋণের সুদের হারকে নরকযন্ত্রণায় নিয়ে যাওয়ার এই অমানবিকতাকে তারা সহ্য করেনি। অতএব মুক্তি চেয়েছে নিত্যদিনের জীবনের ছোটখাটো যন্ত্রণা থেকে। সুবিচারের আশায় সরকার বদল করেছে। কংগ্রেস এই সুবিচার না দিলে? তাদেরও ছুঁড়ে ফেলে দেবে জনতা। 
কর্ণাটক বিজেপিকে ধাক্কা দেয়নি শুধু। কর্ণাটক সবথেকে বেশি আঘাত করেছে নরেন্দ্র মোদির ইগোতে। নরেন্দ্র মোদি একটি ভাবনায় আচ্ছন্ন। তিনি মনে করেন তিনি একজন  সুপারস্টার। ওসব বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, ধর্ম নিয়ে হানাহানির বিরুদ্ধে বিরক্তি বা ভয়, তাঁর দলের প্রতি ক্ষোভ, তাঁর দলের মদতপুষ্ট উগ্র সংগঠনগুলির ধর্মের নামে গুন্ডামি, এসবই এক নিমেষে ফিকে হয়ে যায় তিনি যখন মঞ্চে এসে দাঁড়ান। তিনি যখন ভাষণ দিয়ে মঞ্চ থেকে নামেন, তখন তিনি ভেবে সুখ পান যে, এভাবেই কোটি কোটি মানুষ তাঁর প্রতি মোহগ্রস্ত। যত লোক একটি সভায় এসে তাঁর জয়ধ্বনি দেয়, তার বাইরে যে বহুগুণ মানুষ ঘরে বসে তাঁর সম্পর্কে কী ভাবছে, এটা তিনি ভাবেন না। ভাবতে পছন্দ করেন না। তাঁর নিশ্চিত বিশ্বাস, যে কোনও পরাজয়ের সম্ভাবনাকে তিনি একাই জয়ে বদলে দিতে পারেন। তাঁর হাঁটাচলা, হাত নাড়ানো, গম্ভীর কণ্ঠস্বরে মডিউলেশন এনে বিরোধীদের কটাক্ষ করা, রোড শোয়ের সময় একটানা লিম্যুজিন গাড়ির ফুটরেস্টে দাঁড়িয়ে গাড়ি থেকে শরীর অর্ধেক বের করে জনতার দিকে হাত নাড়ানো, ফুল ছুঁড়ে দেওয়া, এসব কলাকৌশলে সবথেকে মুগ্ধ হন তিনি নিজেই। তাঁর ‘মন কি বাতে’ তিনি নিজেই এত আমোদিত যে,মানুষের মনের কথা আর সেখানে পৌঁছয় না। তাঁর স্তাবকেরা তাঁকে বলেন, আপনি তাবৎ মুশকিল আসান! মোদি সেকথা বিশ্বাস করেন। কারণ, আসলে নিজেই তো সেই কথা নিজেকে সারাদিন ধরে বলেন। মোদি সারাদিন ধরে এত কথা বলেন কেন? কারণ তিনি নিজের কথা নিজে শুনতে ভালোবাসেন? কর্ণাটক তাঁকে ভারী আশাহত করেছে। কারণ, এসবই তিনি কর্ণাটকের ভোটপ্রচারের সময় করেছিলেন। লাভ হল না। 
বিভাজনের রাজনীতি, ধর্মের রাজনীতি, ঘৃণার রাজনীতি যে পরাস্ত হচ্ছে, কর্ণাটক সেই বার্তাই শুধু দিল না, আরও একটি সূক্ষ্ম পরিবর্তনের স্থায়ী আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ২০২০ সালে দিল্লি, ২০২১ সালে বাংলা, ২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশ, ২০২৩ সালে কর্ণাটকে। একের পর এক বিধানসভার ভোটে দেখা যাচ্ছে, মানুষ এখন আর ত্রিমুখী অথবা চতুর্মুখী লড়াইকে গ্রাহ্য করছে না। তাদের কাছে ক্রমেই ‘ওয়ান ভার্সাস ওয়ান’ ভোটযুদ্ধ সবথেকে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। অর্থাৎ সরাসরি দুটি দল অথবা জোটের মধ্যেই ভোটের যুদ্ধ। মাঝখানে অন্য কোনও দল বেশ কিছু ভোট আদায় করে  একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করুক এটা আর মানুষ পছন্দ করছে না। তাই রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি বনাম কংগ্রেস। বিজেপি বনাম আম আদমি পার্টি। বিজেপি বনাম তৃণমূল। বিজেপি বনাম সমাজবাদী পার্টি। আবার দক্ষিণ ভারতে বিজেপির অস্তিত্ব নেই কর্ণাটক ছাড়া। সব রাজ্যেই দ্বিমুখী লড়াই। 
এই প্যাটার্নের বাইরে এতকাল ধরে বেশ কিছু রাজ্যে একাধিক দলের মধ্যেই যুদ্ধ হয়েছে। যেমন উত্তরপ্রদেশে বিজেপি, কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, মায়াবতী। উত্তরপ্রদেশে মানুষ মায়াবতী ও কংগ্রেসকে গুরুত্বহীন করে দিয়েছে। এখন লড়াই হয় বিজেপি বনাম সমাজবাদী পার্টির। বিগত ভোটে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সিপিএম ও কংগ্রেসকে প্রায় শূন্য করে দিয়েছে। এই রাজ্যে এখন তাই ভোট হয় মূলত বিজেপি বনাম তৃণমূল। সাগরদীঘি কি ব্যতিক্রম? নাকি আগামী দিনে আবার সমীকরণ বদলের আভাস? সেটা পরবর্তী ভোটগুলিই জবাব দেবে। দিল্লিতে বেশ কিছু বছর ধরেই বিজেপি বনাম আম আদমি পার্টি। কংগ্রেস গুরুত্বহীন। দক্ষিণ ভারত বরাবরই এরকম। ত্রিমুখী লড়াই সেখানে হয় না। ওড়িশায় কংগ্রেস অস্তিত্বহীন। সেখানে বিজেপি বনাম বিজু জনতা দল। পাঞ্জাবে অকালি দল, বিজেপি ক্রমেই তাৎপর্য হারাচ্ছে। সেখানে কংগ্রেস বনাম আম আদমি পার্টিই প্রধান দুই যোদ্ধা। কর্ণাটকেই একমাত্র ছিল বিজেপি, কংগ্রেস এবং জনতা দল (সেকুলার)। এবার ভোটের আগে মনে করা হচ্ছিল জনতা দলের হাতেই থাকবে সরকার গঠনের চাবিকাঠি। কর্ণাটক সেই ভুল করেনি। তারা সরাসরি দু‌ই দলকে বেছে নিয়েছে লড়াইয়ে। জনতা দল গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। 
অর্থাৎ ভারতের ভোটার কোনও অনিশ্চয়তা অথবা ধোঁয়াশা কিংবা কনফিউশনের মধ্যে থাকতে রাজি নয়। তারা সরাসরি এখন দুই দলের মধ্যে এক পক্ষকে বাছাই করছে। টু পার্টি ডেমোক্রেসি সিস্টেম। সুতরাং, লোকসভা ভোটে বিজেপি বনাম বিরোধী মহাজোটের একটি করে দল যদি সিংহভাগ আসনে দেখা যায়, তাহলে মোদির জয় কঠিন হয়ে যাবে। রামমন্দির, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, হিন্দুরাষ্ট্র, পাকিস্তানকে হুংকার সম্ভবত এসব পুরনো সিলেবাসে আর কাজ হবে না। নীতির সফটওয়্যার বদলাতে হবে মোদিকে! পারবেন কি? 

19th     May,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ