উত্তরপ্রদেশের পুর নির্বাচনে জয় নিয়ে যোগী আদিত্যনাথ উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছেন না। যতই তিনি শান্ত থাকার চেষ্টা করুন না কেন, আনন্দের সোডা বেরিয়ে আসছে ভসভসিয়ে। বলছেন, আমার রাজ্যে ট্রিপল ইঞ্জিন। তাঁর এই অতি উল্লাসের কারণ কী? সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়েও কর্ণাটকে যখন নরেন্দ্র মোদি নামক মহীরুহ মুখ থুবড়ে পড়েছেন, সেখানে উত্তরপ্রদেশে শুধুই যোগী হাওয়া। বছর দুয়েক ধরে দলের অন্দর থেকেই ‘মোদি হটাও যোগী লাও’ স্লোগান চোরাগোপ্তা উঠছে। এবার সেই অংশটাই প্রকাশ্যে আসবে। যোগীও সেটা চান। মোদি পথের ক্রেডিট নিলে যোগী যে রথের কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করেন, সেটা বোঝার জন্য আইনস্টাইন হতে হয় না। উদ্দেশ্য একটাই—চব্বিশের মহারণে ‘অগ্রজে’র পাশে হিন্দুত্বের ‘আধুনিক’ পোস্টার বয় হিসেবে জায়গা করে নেওয়া। কাজেকম্মে সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন আদিত্যনাথ। আর তাই উত্তরপ্রদেশ সযত্নে চেপে যাচ্ছে একটি নাম—সুলতান আনসারি। স্থানীয় নির্বাচনে একটি ওয়ার্ডে নির্দল হিসেবে জিতেছেন এই ভদ্রলোক। কোথায়? অযোধ্যার রাম অভিরাম দাস ওয়ার্ড। রামমন্দির আন্দোলনের অগ্রণী অভিরামের নামে এলাকার নামকরণ। যে সে ওয়ার্ড হলে পাবলিক এতটা নড়েচড়ে বসত না। রাম জন্মভূমিতে সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য! এটা তো গেরুয়া বাহিনীর এজেন্ডা নয়! অথচ, এই ওয়ার্ডে হিন্দু ভোটার ৩ হাজার ৮৪৪ এবং মুসলিম ভোটার সংখ্যা মাত্র ৪৪০ জন। তাতেও সুলতান আনসারি কীভাবে জিতে গেলেন? তাও আবার বিজেপিকে তিন নম্বরে ঠেলে। দ্বিতীয় স্থান অধিকারীও একজন নির্দল। যোগীবাবার ট্রিপল ইঞ্জিনে তো একপোঁচ কাদা পড়ে গেল!
ঘুরেফিরে বাস্তব একই বিন্দুতে এসে মিশছে—শেষের শুরু। কোথাও একটা রাজ্য থেকে, কোথাও কেন্দ্র, কোথাও নিছক জনপদ। সত্যিটা স্বীকার করার সময় এসেছে। নরেন্দ্র মোদি নিজেও সেটা জানেন। তাই তিনি ব্যতিব্যস্ত। অতি মাত্রায়। তাই তড়িঘড়ি তিনি কর্ণাটক জয়ের জন্য কংগ্রেসকে অভিনন্দন জানিয়ে দিয়েছেন। আর উল্টোদিকে কংগ্রেস? তারা কিন্তু স্রোতে ভাসতে শুরু করে দিয়েছে। লাড্ডু বিতরণ, আবির খেলা এবং ভারত জোড়ো যাত্রার নামে জয়জয়কার। অর্থাৎ, সেই রাহুল গান্ধীর সাফল্যের ঢক্কানিনাদ। হাইকমান্ডের অন্ধস্নেহের ঠেলায় নেতা-কর্মী-সমর্থকরা বুঝছেন না, এতে ক্ষতি কংগ্রেসেরই। কর্ণাটকে কীভাবে এসেছে জয়? ভারত জোড়ো যাত্রার জন্য? ভারত তো চিরকাল জুড়েই ছিল। তাকে জোড়ার কোনও প্রয়োজন দেখা যায় না। আমাদের দেশ জুড়ে না থাকলে অযোধ্যায় সুলতান আনসারি হেলায় জয় পেতেন না। তাহলে কি প্রিয়াঙ্কার জন্য? হিমাচল প্রদেশ ছোট্ট একফালি রাজ্য। তাই ওই রাজ্যটিকে বাদ রাখলে সাফল্যের গাথা বোনার সময় এখনও আসেনি। উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের সময়ও তিনি ছিলেন। সেখানে কিন্তু দাঁত ফোটাতে পারেননি প্রিয়াঙ্কা। অর্থাৎ, সময় এখনও দিতে হবে। বাকি রইলেন শিবকুমার। বিধানসভা নির্বাচনে টাকা, প্রচার, স্ট্র্যাটেজি... সবটাই তিনি করেছেন। ‘বড়দাদা’ সিদ্ধারামাইয়াকে মুখ্যমন্ত্রী পদটাও ছেড়ে দিচ্ছেন। তারপরও তাঁর কৃতিত্ব পিছনের সারিতে চলে যাবে। গণ্ডগোলটা কংগ্রেসের গোড়ায়। তারা ভাবছে, কী মহান জয় তারা হাসিল করে ফেলেছে। কিন্তু বাজি রেখে বলা যায়, কংগ্রেস যদি কর্ণাটকের কোনও আসনে না লড়ে সর্বত্র দেবেগৌড়ার জেডিএসকে এগিয়ে দিত, তাহলেও একই ফল মিলত। একক বিরোধী হিসেবে জেডিএস লড়লেও কপালে দুঃখ ছিল বিজেপির। এখন যে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে... সংখ্যালঘু ভোট কুমারস্বামীদের ঝুলি থেকে বেরিয়ে গিয়েছে, তখন আর তা খাটত না। কারণ, ভোট পড়ত বিজেপির বিপক্ষে। জেডিএসের পক্ষে নয়। একের বিরুদ্ধে এক ফর্মুলাতেই জয়। এটাই বর্তমান। এটাই ভবিষ্যৎ। অথচ সে সব ভুলে আত্মতুষ্টিত এভারেস্টে উঠে বসে পড়েছে কংগ্রেস। দিকে দিকে স্লোগান উঠছে, রাহুল গান্ধী জিন্দাবাদ। অদূরে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের ভোট। এই তিনটি ক্ষেত্রেই বিরোধী হিসেবে একমাত্র শক্তিশালী কংগ্রেস। পরিস্থিতি যা চলছে, তাতে কোনওটিতেই বিজেপি প্রতাপ দেখাতে পারবে বলে মনে হয় না। কংগ্রেস যদি এই তিন রাজ্যেও ভালো ফল করে, ওভার কনফিডেন্সে তখন কিন্তু তাদের পা মাটিতে পড়বে না। সেটা হবে চব্বিশের জন্য কঠিন সমীকরণ। তখন তারা আবার জোটের বড়দা হিসেবে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে, আর নিচু নজরে দেখা হবে আঞ্চলিক দলগুলিকে। নরেন্দ্র মোদি ঠিক সেটাই চান। তাই হুড়োহুড়ি করে শুভেচ্ছাবার্তা দিয়েছেন তিনি। রাহুল গান্ধীর নাম উহ্য রাখলেও ক্ষতি নেই। মোদিজি জানেন, রাহুল গান্ধীকে জোটের মুখ হিসেবে তুলে আনতে পারলে তাঁর সামনে ভরপুর সুযোগ। ইতিহাস বলছে, গত বিধানসভা ভোটের নিরিখে, অপারেশন লোটাসের আগে পর্যন্ত কর্ণাটকে ছিল কংগ্রেস-জেডিএসের জোট সরকার। মধ্যপ্রদেশেও তাই। রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে ক্ষমতা দখল করেছিল কংগ্রেস। এতকিছুর পরও কিন্তু এসেছিল ২০১৯ সালের লোকসভা ভোট। তাতে ওভার কনফিডেন্ট কংগ্রেসের আসন সংখ্যা কত ছিল? মাত্র ৫২টি। মানেটা পরিষ্কার, রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী পদে মোদির বিকল্প হিসেবে মেনে নেয়নি মানুষ। কিন্তু সেবারও একের বিরুদ্ধে এক ফর্মুলায় বিরোধীরা লড়লে ফল কিন্তু অন্যরকমই হতো। কারণ, মাত্র ৩৭.৩৬ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩০৩টি আসন দখল করেছিল ‘মোদি জনতা পার্টি’। বিরোধীদের মধ্যে ভাগ হওয়া ভোট একছাতার তলায় আনার প্রয়োজন সেবার ছিল। এবারও রয়েছে। কংগ্রেসকে সেটা বুঝতে হবে।
দক্ষিণ ভারত বিজেপি-মুক্ত, পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আধিপত্য, বিহার নীতীশ কুমার-লালুপ্রসাদের, দিল্লি ও পাঞ্জাব আম আদমি পার্টির। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস কুর্সি দখল করলে বড় রাজ্য বলতে বিজেপির ঝুলিতে থাকবে শুধু গুজরাত ও উত্তরপ্রদেশ। যোগীরাজ্যে সমাজবাদী পার্টি প্রধান বিরোধী হলেও তাদের একটা সমস্যা এখনও রয়েছে—সংখ্যালঘু ভোট এখনও পুরোপুরি তাদের সমর্থনে ফিরে আসেনি। দলিত ভোটের অধিকাংশটা মায়বতী পেলেও সংখ্যালঘু এবং উচ্চবর্ণের ভোট বিরোধীদের পক্ষে আসাটা দরকার। সেই সমীকরণ মাথায় রেখে কোমর বেঁধে নামতে হবে অখিলেশ যাদবকে। মণিপুরে যা হল, তাতে ডাবল ইঞ্জিনের ধুয়ো তুলেও উত্তর-পূর্ব ভারতকে গেরুয়া শিবির আর কতটা হাতের মুঠোয় রাখতে পারবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। সেক্ষেত্রে বিজেপির আধিপত্য থাকবে শুধু মোদির রাজ্য গুজরাতে।
অঙ্কটা স্পষ্ট। মানুষকে বিশ্বাস করাতে হবে, বিরোধীরা জোটবদ্ধ আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। কোনও সাধারণ ভোটার বিভেদের রাজনীতির উনুনের উপর বসে বেকারত্বের অনশনে ভুগতে চান না। বিকল্প তাঁরা খুঁজে বেড়ান। সবসময়। সেটাই তাঁদের কাছে নিয়ে আসতে হবে। প্রতিশ্রুতির মোড়কে নয়, আস্থার বাস্তবে। কর্ণাটক সেই পথ দেখিয়েছে। ছোট্ট একটা ওয়ার্ড হলেও অযোধ্যা হেঁটেছে সেই রাস্তাতেই। নামটা এখানে সুলতান আনসারি। হতে পারতেন তিনি যে কেউ। আসল কথাটা হল, তিনি নির্দল। সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি। আনসারির আরও একটা পরিচিতি রয়েছে—তিনিই প্রথম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অযোধ্যায় জমি কেলেঙ্কারির। সাড়ে ১৮ কোটি টাকার জমি দু’কোটিতে বিক্রি করতে ‘বাধ্য’ হয়েছিলেন তিনি। পরে অবশ্য চাপে পড়ে তিনি বলেছিলেন, ট্রাস্টের প্রতি তাঁর ‘আস্থা’ আছে। জমি কেলেঙ্কারির কথা মোটেও বলতে চাননি তিনি। তাঁর মন্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। ধীরে ধীরে তা চাপা পড়ে গিয়েছিল সময়ের গভীরতায়। নির্দল প্রার্থী হিসেবে জয় সুলতান আনসারিকে আরও একবার শিরোনামে নিয়ে এসেছে। যোগীরাজ্যের সংবাদমাধ্যম অবশ্য এ নিয়ে হইচই করতে চাইছে না। ‘নিয়ন্ত্রণে’র জাঁতাকলে আটকে পড়েছে তারা। সাধারণ মানুষের সেই বাধ্যবাধকতা নেই। তারা বলছে। বলবে। শব্দ হয়তো তাদের হারিয়ে যাবে শাসকের প্রতিরোধে। তাও তারা বলবে... ভোটের যন্ত্রে। শুধু একজোট হতে হবে বিরোধীদের। লোকসভা নির্বাচনের আগেই। ভোটের পরে জোটের তত্ত্বে এবার না হলে মোদি সরকারকে হটানো যাবে না। আত্মতুষ্টি নয়, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসও নয়। বুঝতে হবে নিজেদের শক্তি, সীমাবদ্ধতা। এটাই ফর্মুলা। তাতে কোনও ভাগশেষ থাকবে না।