বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

আধিপত্যবাদ ও গণতন্ত্রের মধ্যে কোনটি নেব?
পি চিদম্বরম

১২ মে, শনিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টেক্সাসের অ্যালেনে ঐশ্বর্য থাটিকোন্ডা নামে এক ভারতীয় নাগরিক মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ২৭ বছর। সপ্তাহান্তের সাধারণ বিনোদন হিসেবে তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে তিনি একটি শপিংমলে ঘুরতে গিয়েছিলেন। এটাই জানা গিয়েছে যে, মৌরিসিও গার্সিয়া নামে এক প্রাক্তন নিরাপত্তারক্ষীর হাতে তিনি খুন হন। এই ঘটনায় নিহত হন আরও সাতজন। আটজন শিকারের কাউকেই এই আততায়ী চিনত না। এমনকী, এই হত্যাকাণ্ড ঘটাবার ব্যাপারে তাঁদের কারও বিরুদ্ধে গার্সিয়ার কোনও মতলবও ছিল না।
গার্সিয়ার সোশ্যাল মিডিয়া পেজগুলি ঘেঁটে দেখা গিয়েছে যে, সে ছিল শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদে বিশ্বাসী একজন মানুষ। সে স্পষ্টতই বিশ্বাস করত যে, যাদের ত্বকের রং সাদা তারা—কালো, বাদামি, হলদেটে অথবা সংকর বর্ণের লোকেদের চেয়ে জাতিতে উচ্চতর—তাই অশ্বেতাঙ্গ লোকেদের ঘৃণা করার এটি একটি কারণ। কোনও ক্ষেত্রে অশ্বেতাঙ্গদের চেয়ে শ্বেতাঙ্গরা উন্নততর, এমন একটি তত্ত্বের সমর্থনে কোনও বৈজ্ঞানিক বা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই। বিবর্তনীয়, জৈবিক, শারীরবৃত্তীয়, অভিজ্ঞতামূলক প্রভৃতি কোনও দিক থেকেই এর সমর্থন খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশ্বের সেরা ক্রীড়াবিদরা কালো ত্বকের মানুষ। বিশ্বের বৃহত্তম ব্যাঙ্কটি চীনাদের অধিকারে। দুনিয়ার বৃহত্তম তেল কোম্পানির মালিকানা আরবদের হাতে। ভারতীয়রা তুলো ও দুধের সর্ববৃহৎ উৎপাদক এবং চলচ্চিত্রেরও বৃহত্তম নির্মাতা।  
নাৎসিবাদে ফেরা
শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য নতুন কিছু নয়। নাৎসিরা শ্বেতাঙ্গ জার্মানদের একটি উচ্চতর ‘প্রভুর জাতি’বলে ভাবত। কালো, স্লাভ, রোমা, ইহুদি এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর লোকদেরকে তারা নিকৃষ্ট গণ্য করত। ফ্যাসিবাদীরা বিশ্বাস করত উগ্র-জাতীয়তাবাদে, কিন্তু একটা সময় পর বর্ণবাদী ধারণা পাল্টে তারা হয়ে ওঠে ইহুদি-বিরোধী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, বহু জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত একটি জোটের কাছে নাৎসি এবং ফ্যাসিবাদীরা ভয়ঙ্করভাবে পরাজিত হয়।
শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যই একমাত্র আধিপত্যবাদী তত্ত্ব নয়—আধিপত্যবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে ধর্ম, জাতপাত, ভাষা প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে। ভারত হল সব প্রকারের আধিপত্যবাদী তত্ত্বের ভিত্তিভূমি। জাতি বা বর্ণ ও উপবর্ণের শ্রেণিবিন্যাস এবং বর্ণবাদী আধিপত্যবাদীরা বহু শতাব্দী ধরে রয়েছে। বাসবেশ্বর, জ্যোতিবা ফুলে, নারায়ণ গুরু, ই ভি আর ‘পেরিয়ার’ রামস্বামী, বাবাসাহেব আম্বেদকর এবং অন্যসকল সংস্কারকরা এই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে নিরলসভাবে প্রচার করে গিয়েছেন। তবু জাতপাতের অভিশাপ ভারতকে গ্রাস করে রেখেছে। 
আধিপত্যবাদীরা প্ররোচনা পায়
সনাতন ধর্ম, আরএসএস, বিজেপি এবং অনেক হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের বিশ্বাসীদের সৌজন্যে ধর্মীয় আধিপত্য জীবনে একটি নয়া স্বত্ব পেয়েছে। তবে নরেন্দ্র মোদির সরকার আসার আগে পর্যন্ত রাষ্ট্র হিসেবে ভারত মোটামুটি ধর্মনিরপেক্ষই ছিল। অভিজাত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জওহরলাল নেহেরু। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। পণ্ডিত নেহরু ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচারক। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে তিনি অনেক উঁচুতে তুলে ধরেছিলেন। বি আর আম্বেদকরের জন্ম একটি দলিত পরিবারে। একটি সংবিধান রচনা করে তিনি ঘোষণা করেন যে ভারত হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। হিন্দুরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং আছে। তাদের সম্ভাব্য আধিপত্য কিংবা বর্জন নীতির হাত থেকে সংখ্যালঘুদের এবং তাদের অধিকারগুলিকে রক্ষা করেছে সংবিধান। কিছু বিচ্যুতি বাদ দিলে, রাষ্ট্র এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি ছয় দশকেরও বেশিকাল ছিল পরস্পর সম্পর্কহীন। মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি, ইহুদি এবং নাস্তিকরা সামাজিক জীবনে বৈষম্যের শিকার হলেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সামনে নিরাপদ বোধ করত। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য করতে অভ্যস্ত ছিল না রাষ্ট্র। তবে বৈষম্য কখনও হলে বিচারপতিরা রাষ্ট্রের পদক্ষেপকে খারিজ করেছেন এবং রক্ষা করেছেন ধর্মনিরপেক্ষতাকে। ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে সম্মান করতেন অধিকাংশ হিন্দু নাগরিক। রাজনৈতিক দলগুলিও চলত নিয়ম মেনে। 
শুরু উপজাতীয়তার অনুশীলন
সেসব অতীতের জিনিস বলে মনে হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি তার মর্যাদা খুইয়েছে। পার্টি নেতৃত্ব ধর্মনিরপেক্ষতার ঘোষণা দিয়েও, মনে হচ্ছে, অনেক রাজনৈতিক দল একটি ধর্ম বা অন্য ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতিতে দ্রুত নিমজ্জিত হওয়ার সাক্ষী আমরা কর্ণাটকের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে। এই প্রসঙ্গে শক্তিমান রাজনৈতিক সংগঠন বজরং দলের কথা বলতে হয়, ঘৃণার ভাষণে এবং প্রায়ই হিংসায় মদত দিয়ে দাবি করে যে তারা বজরংবলী (ভগবান হনুমানের ভক্ত)। রাজনৈতিক লড়াইটাকে বিজেপি ভগবান হনুমান এবং অন্যান্যদের মধ্যে লড়াইয়ের রূপ দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। অন্য কেউ নন, স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্বাচনী ভাষণ শুরু এবং শেষ করেন ‘জয় বজরংবলী’ ধ্বনি দিয়ে। বিজেপির প্রচার বিপজ্জনক মোড় নেয় যখন ভোটদাতাদের কাছে ভোট দেওয়ার আগে ‘জয় বজরংবলী’ স্লোগান দেওয়ার আবেদন করা হয়। ঘটনাটি নির্বাচনী আইন লঙ্ঘনের একটি গুরুতর দৃষ্টান্ত এবং মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন এর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপই করেনি। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, কর্ণাটকের জনসংখ্যার ১২.৯২ শতাংশ মুসলিম এবং ১.৮৭ শতাংশ খ্রিস্টান। তাদের উপেক্ষা করে, ২২৪টি আসনের একটিতেও মুসলিম বা খ্রিস্টান প্রার্থী দেয়নি বিজেপি। বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘মুসলমানদের ভোট আমরা চাই না।’ এই পার্টির প্রচারের অব্যক্ত বার্তা ছিল যে, ‘অহিন্দুকে ঘৃণা করুন, ভোট দিন হিন্দুকে।’
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সত্যপাল পাল সিং বাঘেল বিজেপি ক্যাডারদের অযৌক্তিক এক চিন্তায় সুড়সুড়ি দেন, যখন তিনি বলেন, ‘সহনশীল মুসলমানদের সংখ্যাটি আঙুল গুনেই বলা যেতে পারে ... এমনকী এটি একটি কৌশল। লোকজন সংবিধানের মৌলিক কাঠামো এবং এটির সঙ্গে কীভাবে খেলা করা যায় না, সে সম্পর্কে কথা বলতে থাকে। এই জাতির যে মূল কাঠামো ‘অখণ্ড ভারত হিন্দু রাষ্ট্র’ সেটা ছিল ১১৯২ সালের আগে।’ আর এই মানুষটি দেশের আইন ও বিচারমন্ত্রী!
আমি যতদূর জানি, বিজেপি নেতৃত্ব একবারের জন্যও মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা, খ্রিস্টান গির্জায় ভাঙচুর, তরুণ দম্পতিদের হুমকি কিংবা গেরুয়া নজরদার গোষ্ঠীর হিংস্রতার নিন্দা করেনি। ধর্মীয় আধিপত্যবাদীরা তাণ্ডব চালাচ্ছে। কর্ণাটকের ভোটারদের কাছে এটা প্রথম সুযোগ—উপজাতীয়তার বিপজ্জনক অনুশীলন বন্ধ করার এবং ধর্মীয় আধিপত্যবাদীদের হাত থেকে গণতন্ত্রকে বাঁচানোর। এই নিবন্ধটি পড়ার সময়ই আপনি আঁচ পেয়ে যাবেন যে আগামী দিনে কী ঘটতে চলেছে। 
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত 

15th     May,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ