বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

রবীন্দ্রপ্রেমী সাজতে গিয়ে
মুখ পুড়ছে বিজেপির
তন্ময় মল্লিক

‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনাতে নজরুল।’ ভূপেন হাজারিকা এই গানটি গেয়ে হয়েছিলেন বাঙালির আপনজন। বাংলার ও বাঙালির চেতনায় রবীন্দ্র-নজরুলের নিত্য আনাগোনা। সুরের জাদুতে সেই ভাবনাকে গেঁথে দিয়েছিলেন বাঙালির হৃদয়ে। বিজেপির রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের আয়োজনেও ছিল সেই মনের নাগাল পাওয়ার লোভ। তাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের লিখিত ভাষণের ছত্রেছত্রে ছিল রবীন্দ্র অনুরাগের ছোঁয়া। তবে, তা তো ছিল কেবল মুখের ভাষা। কিন্তু অন্তরের অভিপ্রায়? সেটা প্রকাশিত হয়েছে সায়েন্স সিটির অনুষ্ঠানে অনুরাগীদের স্লোগানে। সুভাষ স্মরণ থেকে কবি বরণ, সবেতেই অনুরাগীদের ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান বুঝিয়ে দেয়, বিজেপির আসল উদ্দেশ্যটা কী? বিভাজনের জিগির তুলে বাংলা দখল। 
নির্বাচন এলেই বাংলার ও বাংলার মনীষীদের কথা দিল্লির বিজেপি নেতাদের মনে পড়ে। অনেকটা মোবাইলে দেওয়া অ্যালার্মের মতো। ভোট এলেই বিজেপি নেতাদের মনে বেজে ওঠে ‘বাংলায় যেতে হবে, বাংলায় যেতে হবে’ রিং টোন। একুশের নির্বাচনের আগেও বাংলার মনীষীদের কথা তাঁদের খুব মনে পড়েছিল। প্রতিটি সভায় নিয়ম করে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর মহাশয়দের কবিতা ও বাণী স্মরণ করতেন। সেই তালিকায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শীর্ষে। কারণ এই মানুষটার পদবি শুধু ‘ঠাকুর’ই নয়, তিনি প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের দেবতা। তাই তাঁকে ভাঙিয়ে বাঙালির মন জয়ের চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না। তা করতে গিয়ে কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থানকে কর্মস্থান, আর কর্মস্থানকে জন্মস্থান বানিয়ে ছেড়েছিলেন। 
তবে, সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের যশস্বী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর আওড়ানো ‘ওরে নূতন যুগের ভোরে’ গানটা মনে আছে? রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘চলায় চলায় বাজবে জয়ের ভেরী/ পায়ের বেগেই পথ কেটে যায়, করিস নে আর দেরি’। আর নিজেকে রবীন্দ্রপ্রেমী প্রমাণ করতে গিয়ে মোদিজি আওড়েছিলেন, ‘চোলাই চোলাই বাজবে জয়ের বেরি/পায়ের বেগেই পোদ কেটে যায়,/ করিস না আর দে...রি’।
শুধু কথায় নয়, মোদিজির বাহ্যিক চালচলনেও এসেছিল ‘রাবীন্দ্রিক ছোঁয়া’। ফ্যাশনপ্রিয় মানুষটার চুল-দাড়ির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি গোটা দেশের মানুষের নজর কেড়েছিল। অনেকে সেই মোদিজির মধ্যে খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু, ছন্দপতন ঘটিয়েছিল তাঁর বাচনভঙ্গি। যে বাংলা নারীকে দিয়েছে মায়ের স্থান, সেই মাটিতে দাঁড়িয়েই তিনি করেছিলেন নারীর অপমান। তাতেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন বাংলার মা-বোনেরা।
লক্ষ্য ছিল একটাই। যে কোনও মূল্যে করতে হবে বাংলা দখল। তারজন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে করতে হবে হেয়। তাই প্রতিটি সভায় নিয়ম করে ‘বাংলার দিদি’কে ‘দিদি অ দিদি’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। তা নিয়ে উল্লসিত বিজেপি কর্মী সমর্থকদের সে কী হাততালি! বাংলাকে নতুন কিছু একটা দেওয়া গিয়েছে ভেবে খুশি হয়েছিলেন মোদিজিও। তাই তাঁর বেসুরো দিদি ডাক নিয়ে সমালোচনাকে আমল দেননি। আসলে তিনি বুঝতে পারেননি, বাংলার আর গোবলয়ের সংস্কৃতি এক নয়। তার মাসুলও দিয়েছেন। ২০০ চেয়ে পেয়েছেন ৭৭। ২০২২ সালে বাংলায় রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন নিয়ে দিল্লি বিজেপির মাথাব্যথা ছিল না। কেউ ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু এবার বিজেপি নেতৃত্ব ফের রবীন্দ্র অনুরাগী হয়ে উঠেছে। সামনে পঞ্চায়েত ভোট। আর বছর ঘুরলেই বেজে যাবে লোকসভা ভোটের দামামা। তাই এখন থেকেই আসরে নেমে পড়েছেন দিল্লির নেতারা। কারণ তাঁরাও বুঝেছেন, বঙ্গ বিজেপির যা অবস্থা তাতে এখনই হাল না ধরলে ভরাডুবি নিশ্চিত।
লোকসভা ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে দিল্লির নেতাদের বাংলার প্রতি ‘টান’ ততই বাড়ছে। তাঁরা বুঝতে পারছেন, কেন্দ্রের ক্ষমতায় ফিরতে হলে বাংলা থেকে গতবারের চেয়েও বেশি আসন পেতে হবে। তাই বিজেপির চাণক্য ৩৫ আসনের টার্গেট দিয়েছেন। বঙ্গ বিজেপির নেতাদের অবস্থা কর্পোরেট সংস্থার সেলস্ এগজিকিউটিভদের চেয়েও করুণ। মার্কেটের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে, কিন্তু টার্গেট বাড়িয়েই যাচ্ছে। একেবারে দ্বিগুণ! 
বঙ্গে বিজেপি কত আসন পাবে, তা সময়ই বলবে। কিন্তু দিল্লিতে ক্ষমতায় ফেরার জন্য বাংলা থেকে বিজেপির কেন এতগুলো আসন প্রয়োজন হয়ে পড়ল? ‘বিজেপির দুর্গ’ বলে পরিচিত রাজ্যগুলিতে কি তাহলে ধস নামছে? কর্ণাটকের এক্সিট পোলের রিপোর্ট জানার পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যেসব রাজ্যে ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার রয়েছে সেখানে বিজেপির মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল। যে প্রত্যাশার ফানুস উড়িয়ে বিজেপি রাজ্যের ক্ষমতায় বসেছিল, তার সিকিভাগ পূরণেও হয়েছে ব্যর্থ। ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকারের সওয়ারিরা বুঝতে পারছেন বাস্তবের সঙ্গে ‘গেরুয়া স্বপ্নে’র ফারাকটা। তাই পাঁচ বছর রাজ্যপাট চালানোর পরেও বিজেপি ক্ষমতায় ফিরছেই, সেকথা কেউ বলতে পারছে না। বরং প্রত্যেকের ইঙ্গিত হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের। 
আজ কর্ণাটকের ফল ঘোষণা। বুথ ফেরত সমীক্ষার সঙ্গে ভোটের ফল মিলে গেলে ২০২৪ সালের লড়াই বিজেপির জন্য আরও কঠিন হবে। আর এক্সিট পোলের সমীক্ষাকে ভুল প্রমাণ করে বিজেপি ক্ষমতায় ফিরলে? দেশজুড়ে মাত্রা ছাড়াবে গেরুয়া সংস্কৃতির আগ্রাসন।  
অমিত শাহ এবার বাংলায় এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালনের জন্য। তিনি এমন সময় এরাজ্যে এসে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন যখন জাতিদাঙ্গায় জ্বলছে মণিপুর। মারা গিয়েছেন বহু মানুষ। আশ্রয়হীনের সংখ্যা অগুনতি। কেউ ত্রাণশিবিরে, কেউ খোলা আকাশের নীচে চরম অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। জারি করতে হয়েছে ৩৫৫ ধারা। কিন্তু মণিপুরে তো চলছে ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার। তা সত্ত্বেও কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হল? 
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হাতে কেন্দ্রীয় এজেন্সির, দক্ষ গোয়েন্দা অফিসারের অভাব নেই। তাঁরা কি পরিস্থিতি সম্পর্কে আগাম কোনও খবর সরকারকে দেননি? নাকি দেওয়ার পরেও ‘আগুনে হাত পোড়ার’ আশঙ্কায় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে! কারণ যাই হোক না কেন, দায় এড়াতে পারে না কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অমিত শাহের মণিপুরে গিয়ে সেখানকার মানুষকে আশ্বস্ত করা কর্তব্য ছিল বলে অনেকে মনে করছেন। অমিতজির প্রতি এই প্রত্যাশার যথেষ্ট কারণ আছে। কেউ বিপদে পড়লে সব কাজ ফেলে সেখানে ছুটে যাওয়ার নজির তো তিনিই গড়েছেন। এই তো কিছুদিন আগে উত্তরবঙ্গ থেকে ফেরার পথে শুনলেন, কাশীপুরে দলের এক কর্মীকে নাকি খুন করা হয়েছে। সেকথা শুনে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে কাশীপুরে চলে গেলেন। উদ্দেশ্য, মৃত কর্মীর পরিবারের পাশে দাঁড়ানো! তাই অনেকে ভেবেছিলেন, তিনি ছুটে যাবেন অশান্ত মণিপুরেও। কিন্তু তা না করে তিনি বাংলায় এসে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করলেন! আর তাতেই বিরোধীরা পেয়ে গেল কটাক্ষ করার সুযোগ। অনেকে বলছেন, ‘রোম যখন জ্বলছিল নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল’ প্রবাদটা অমিতজি ফের মনে করিয়ে দিলেন। 
কলকাতায় সায়েন্স সিটিতে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মূল উদ্যোক্তারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলেও অনুষ্ঠানটি ছিল ‘অরাজনৈতিক’। তাই দেওয়া হয়েছিল অনুষ্ঠানের গাম্ভীর্যের কথা মাথায় রেখে আচরণ করার পরামর্শ। আগাম সতর্কতার কারণ? তাঁরা অনুষ্ঠান দেখতে আসা ‘বন্ধু’দের খুব ভালো করেই চেনেন। কিন্তু তাঁদের সব চেষ্টাই গেল জলে। অমিতজি ঢুকতেই উঠল ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান। অনুষ্ঠানটির গেরুয়াকরণ ঠেকানোর সব চেষ্টা করেও উদ্যোক্তারা তা রুখতে পারলেন না। আসলে এতদিনের অভ্যেস, এত সহজে পাল্টে ফেলা যায়? তবে, সরকারি ও অরাজনৈতিক সভায় ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে তাকে ‘দলীয় অনুষ্ঠানে’ পরিণত করার চেষ্টা এর আগেও বিজেপি করেছে। কলকাতায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মজয়ন্তী পালনের অনুষ্ঠানেও ঘটেছিল একই ঘটনা। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীকে অপদস্থ করার জন্য দেওয়া হয়েছিল ‘জয় শ্রীরাম’ধ্বনি। বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের উদ্বোধন অনুষ্ঠানেও ঘটেছিল একই ঘটনা। আগামী দিনেও হয়তো ঘটবে। কারণ বিজেপির কাছে ‘জয় শ্রীরাম’ প্রভু রামচন্দ্রকে স্মরণের পথ নয়, বিরোধীদের উত্ত্যক্ত করার হাতিয়ার।
কাউকে পুজো করার ও শ্রদ্ধা নিবেদনের আগে তাঁর আবেগ, আদর্শকে উপলব্ধি করতে হয়। অন্তর থেকে সেই আবেগকে সম্মান জানালে তবেই তিনি গ্রহণ করেন পুজোর অর্ঘ্য। সার্থক হয় পুজোর উদ্দেশ্যও। তা না হলে সবই বৃথা। সে পুজো রামচন্দ্রেরই হোক বা রবীন্দ্রনাথের।

13th     May,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ