বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মোদিজি, অস্ত্র ব্যুমেরাং হবে না তো?
শান্তনু দত্তগুপ্ত

সাল ২০১৩। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহর। লেখাটা হাত থেকে নামালেন মনমোহন সিং—‘আমার কি পদত্যাগ করা উচিত?’ উল্টোদিকে বসে মন্টেক সিং আলুয়ালিয়া। তৎকালীন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। আর মনমোহন সিংয়ের বন্ধু। রাজধানীর দরবারে তখন একের পর এক ঘটনার ঘনঘটা। রাহুল গান্ধী অযাচিতভাবে সাংবাদিক সম্মেলনে ঢুকেছেন এবং দেশবাসীর সামনে ছিঁড়ে ফেলেছেন একটি অর্ডিন্যান্স। মনমোহন সিংয়ের কথায় কপিল সিবাল ড্রাফ্‌টটা বানিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে পাশ কাটিয়ে যাতে দোষী সাব্যস্ত জনপ্রতিনিধিদের রক্ষাকবচ দেওয়া যায়, সেই লক্ষ্যেই আইনে সংশোধনী আনতে চলেছিল ইউপিএ সরকার। উদ্দেশ্য সুদূরমেয়াদি। কিন্তু এই আইন কার্যকর হলে তাৎক্ষণিক রক্ষা দেওয়া যেত লালুপ্রসাদ যাদবকে। দোষী সাব্যস্ত হলেও যদি তিন মাসের মধ্যে আবেদন করা যায়, তাহলে সদস্যপদ খারিজ হবে না। বিধি বাম। রাহুল গান্ধী এলেন, সাংবাদিক সম্মেলনে বসলেন এবং অর্ডিন্যান্স ছিঁড়ে ফেললেন। তাঁর মনে হল, এইসব কার্যকলাপ স্রেফ রাজনীতির জন্য। কয়েকজন ক্রিমিনালকে বাঁচানোর চেষ্টা... আবর্জনা ছাড়া আর কিচ্ছু না। রাহুল গান্ধী কি সেদিন দেশের সামনে হিরো হয়ে উঠতে পেরেছিলেন? বোধহয় না। তাহলে ঠিক পরের বছর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস তথা ইউপিএ’র ভরাডুবি হতো না। দেশবাসী বলত, রাহুলই আমাদের যোগ্য প্রধানমন্ত্রী। বরং সেদিন দেশ দেখেছিল এমন এক অপরিণত নেতাকে, যিনি নিজের দল এবং সরকারকে যখন-তখন অপদস্থ করতে পারেন। রাজনীতির দাবাখেলায় যতটা অংশ আলোয় দেখা যায়, তার অর্ধেকের বেশিটাই থাকে অন্ধকারে। ওটাই প্ল্যানিং, অঙ্ক কষা। রাহুল গান্ধী আজ থেকে ১০ বছর আগে একটা গ্যালারি শো দেখাতে গিয়েছিলেন। একবারও ভাবেননি, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং ইউপিএ সরকারের অন্তরাত্মা সোনিয়া গান্ধী যে পরিকল্পনা করেছেন, তা এমন ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আসলে তখনও নরেন্দ্র মোদি নামে এক ব্যক্তি জাতীয় রাজনীতির ‘আন্তর্জাতিক ম্যাচ’ খেলতে নামেননি। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ঘরোয়া রাজনীতিতেই তাঁর যাবতীয় বড় স্কোর। তাই স্টান্ট কীভাবে দিতে হয়, কীভাবে দেশবাসীকে কথার মায়াজালে ফাঁসাতে হয়, সেটা শিখতে পারেননি রাহুল (এখনও কতটা শিখেছেন, সন্দেহ আছে)। অর্ডিন্যান্স কাণ্ডে তাঁর লাভ তো হলই না, বরং সরকারকে এক মুহূর্তে খেলো করে দিলেন তিনি। প্রাক্তন আইএএস সঞ্জীব আলুয়ালিয়া লিখলেন, ‘ডঃ মনমোহন সিং নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। দুর্নীতি দেখেও অন্ধ হয়ে থেকেছেন তিনি, অবিবেচক এবং পক্ষপাতের রাজনীতি হচ্ছে বুঝেও কিছু বলেননি। নিজের পরিচ্ছদ পরিষ্কার রেখেছেন, কিন্তু সরকার কালিমালিপ্ত হয়েছে। এর দায় তাঁরও।’ সঞ্জীব আলুয়ালিয়ার আর একটা পরিচয় রয়েছে... তিনি মন্টেক সিংয়ের ভাই। বন্ধু চেয়েছিলেন, লেখাটা অন্য কেউ মনমোহন সিংয়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আগে যেন তিনি নিজে সেই কঠিন কাজটা করতে পারেন। নিউ ইয়র্ক শহরে বসে সেই কাজটাই করেছিলেন মন্টেক সিং আলুয়ালিয়া। লেখাটা নিঃশব্দে পড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তারপর চোখ তুলে তাকিয়েছিলেন মন্টেকের দিকে—‘আমার কি পদত্যাগ করা উচিত?’
সৎ পরামর্শই দিয়েছিলেন মন্টেক। বলেছিলেন, ‘এমন সিদ্ধান্ত নেবেন না।’ মন্টেক তখনই বুঝেছিলেন, কংগ্রেসের একাংশ রাহুলকে যতই ‘ন্যাচরাল লিডার’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন, বাস্তব সেটা নয়। এটা ঠিক, রাজনীতির সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক বেশ নিবিড়। অন্তত আম জনতা সেটাই মনে করে। কিন্তু রাজনীতির সব মামলা উদ্দেশ্যহীন হয় না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে শুধু শাসক-বিরোধী সমীকরণে গণ্ডগোল হলেই মামলা ঠুকে দেওয়ার রেওয়াজ এই পোড়া দেশে রয়েছে। আইন সংশোধন হলে বহু অপরাধীর সুবিধা হতো ঠিকই, পাশাপাশি এমন সব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা সামাল দিতেও সুবিধা পেতেন জনপ্রতিনিধিরা। হয়তো সেই তালিকায় আজ পড়ে যেতেন রাহুল গান্ধী! দুর্নীতির এই খোলা ময়দানেও অবশ্য ‘আমাদের ওই নেতা সৎ’ বলার মধ্যে ভোটারদের একটা অদ্ভুত প্রশান্তি থাকে। নরেন্দ্র মোদিকে সরাসরি দুর্নীতিগ্রস্ত বলে কোনও সাধারণ মানুষ আজ পর্যন্ত রায় দিতে পারেননি। রাহুল গান্ধী এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধী অবশ্য সেই অভিযোগ করেছেন। ভিত্তি কী? তাঁদের তির গৌতম আদানির দিকে। এই ব্যবসায়ীকে নানাবিধ সুবিধা পাইয়ে দেওয়াটাই নাকি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রধান দুর্নীতি। এই অভিযোগ কতটা সত্যি, সে বিচার আদালত করবে। মুখে মুখে এমন অভিযোগ এদেশে প্রচুর ঘোরাফেরা করছে। তেমন দেখতে গেলে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। তাই সরাসরি আইনের পরিসংখ্যানে আসা যাক। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের হলফনামা অনুযায়ী, ৬৭ জন এমপির নামে ফৌজদারি মামলা রয়েছে। আর তার দু’বছর পরের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ক্রিমিনাল রেকর্ডের অধিকারী এমপি এবং এমএলএ’র সংখ্যা ৩৬৩। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ৮৩ জন জনপ্রতিনিধিকে নিয়ে ওই তালিকার শীর্ষে ছিল বিজেপি। এঁদের মধ্যে তেলেঙ্গানার সংসদ সদস্য সোয়াম বাপু রাওয়ের বিরুদ্ধেই যেমন ফৌজদারি মামলা রয়েছে ৫২টি। তালিকায় রয়েছে অনুরাগ ঠাকুর, জন বারলা, দিলীপ ঘোষ, নিশীথ প্রামাণিক, অমিত শাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ নাম। তাঁদের ক’জনের বিরুদ্ধে মামলায় রায় ঘোষণা হয়েছে? কতজনের রায় বিপক্ষে গিয়েছে? কতজনের সদস্য পদ খারিজ হয়েছে? এঁদের একজনেরও না। গত ১০ বছরে মাত্র তিনজন বিজেপি জনপ্রতিনিধি নির্বাসনের মুখে পড়েছেন। ১) উত্তরপ্রদেশের খাটাউলি কেন্দ্রের এমএলএ বিক্রম সিং সাইনি। ২) মহারাষ্ট্রের ইচলাকারাঞ্জি আসনের সুরেশ হালভাঙ্কর এবং ৩) মধ্যপ্রদেশের বিজাওয়ারের বিধায়ক আশা রানি। মারাত্মক হাইপ্রোফাইল একজনও নয়। এবং তাঁদের বিধায়ক পদ খারিজ হওয়ায় বিজেপির সরকার পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থাও হয়নি। কিন্তু রাহুল গান্ধী ভারতের রাজনীতিতে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ নাম। শুধুই তাঁর পরিবারের জন্য। নরেন্দ্র মোদি যতই দেশে-বিদেশে গান্ধী পরিবারের নামে বিষোদ্গার করুন না কেন, ভারতের ইতিহাসে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাঁদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। গান্ধী পরিবারে জন্মের খাতিরে রাহুল এমনিতেই ৪০ নম্বর হাতে রেখে শুরু করেছিলেন। অর্থাৎ পরীক্ষা দিতে না বসেই পাশমার্ক। কিন্তু ফার্স্ট হতে গেলে কিছু তো পড়াশোনা করতে হবে! একুট-আধটু রাজনৈতিক মেরিট...! বাঘা বাঘা সব নেতা-নেত্রীরা প্রকাশ্যে মেরে ফেলো, কেটে ফেলো, জ্বালিয়ে দাও বলেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তা ‘তারিখ পে তারিখ’ জটিলতায় আটকে থাকছে। অথচ ‘মোদিরা চোর’ বলেই নাস্তানাবুদ হয়ে গেলেন রাহুল। তাও কার কাছে? পূর্ণেশ মোদি। গত ২২ মার্চের আগে সুরাত পশ্চিম কেন্দ্রের এই বিধায়ককে গুজরাতের সব মানুষ চিনতেন কি না, সে ব্যাপারেই সন্দেহ আছে। অথচ পার্টির লোকজন বলে, এই মোদিও নাকি কম বয়সে চা বিক্রি করতেন, দিন মজুরের কাজ পর্যন্ত করেছেন। আর করেছেন রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে মামলা। এটাই অবশ্য তাঁর প্রোফাইলের সবচেয়ে বড় সাফল্য। মামলার বিষয়বস্তু কী ছিল? রাহুল গান্ধী অনগ্রসর মোদি সম্প্রদায়কে অপমান করেছেন। তাঁকে বলা হয়েছিল, ক্ষমা চেয়ে নিন। রাহুল সে পথে যাননি। তাঁর মনে হয়েছিল, ক্ষমা চাইলে তিনি ছোট হয়ে যাবেন। রাজনীতির সাফল্য সামান্য ইগো কিংবা ছোটবড় হওয়ায় নির্ভর করে না। সোনিয়া-পুত্রের আইনজীবী ছিলেন কীরিত পানওয়ালা। সুরাতের নামজাদা উকিল। ভয়ানক ভালো সাকসেস রেট। তিনিও কিছু করতে পারেননি। আদালতকে পানওয়ালা মহাশয় বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, তাঁর মক্কেলের নিশানা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, খুব বেশি হলে ললিত মোদি। গোটা মোদি সম্প্রদায় নয়। আদালত গা করেনি। রাহুলও যদি বলতেন, আমার মন্তব্যে মোদি সম্প্রদায় যদি আহত হয়ে থাকেন, তার জন্য আমি দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী—তাতে কি তাঁর পদবি 
বদলে যেত? মোটেও না। তিনি গোঁ ধরে থাকলেন। আর আদালত বলল, ‘একজন জনপ্রতিনিধি 
হিসেবে বক্তব্য রাখার সময় শব্দচয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মামলায় যদি সর্বোচ্চ সাজা না হয়, তাহলে অন্যায় হবে।’ 
এটাই চেয়েছিল বিজেপি। এটাই চেয়েছিলেন মোদি-শাহ। বিরোধীদের কোমর ভাঙতে তাঁদের হাতে দু’টি অস্ত্র—এজেন্সি এবং রাহুল গান্ধী। মোদিজি হয়তো বুঝেছেন, প্রথম হাতিয়ারটা বেশি প্রয়োগ হয়ে গিয়েছে। ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিলেন তিনি, ‘ইডিই বিরোধীদের একজোট করবে।’ বাস্তবে তেমন কিছুই হচ্ছে। এজেন্সির দাপটে প্রত্যেক রাজ্যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে বিরোধীদের। কতগুলো অভিযোগ সত্যি, কতগুলোয় জল মেশানো... তার হিসেব এজেন্সি করছে না। তাই বিরোধীরাও এখন আর কংগ্রেসের তোয়াক্কা করছে না। প্রায় প্রত্যেকেই এখন একটা ভাবনায় একমত—বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি এক করতে হবে। তাতে কংগ্রেস থাকুক বা নাই থাকুক। শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যশালী জাতীয় পার্টিঃ জোটে না থাকলে যে গেরুয়া শিবিরের ভয়ানক মুশকিল! মহাজোটে তাদের উপস্থিতির অর্থ, দাদাগিরি। ভাবটা এমন, আমি থাকতে অন্য আঞ্চলিক দল কী করবে? অলিখিতভাবে রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার মরিয়া একটা চেষ্টা চলবে লাগাতার। বিজেপি সেটাই চায়। প্রতিষ্ঠানবিরোধী যে হাওয়া, তার অনেকটাই উধাও হয়ে যাবে ভোটযন্ত্রে। আম জনতা এখনও দেশের সুপ্রিম পদে রাহুল গান্ধীকে আদৌ কত নম্বর দেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি তাঁর এই দ্বিতীয় অস্ত্রও এলোপাথাড়ি ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। অত্যন্ত দুর্বল মানুষকেও যদি বারবার বোঝানো হয়, তুমি শক্তিশালী। তোমাকে ঠেকাতেই এত আয়োজন। সেই দুর্বলও ধীরে ধীরে বাঘ হয়ে উঠবে। নরেন্দ্র মোদি তখন সেই বাঘের পিঠ থেকে নামতে পারবেন তো?

28th     March,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ