বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মমতা-মডেল ছাড়া গতি নেই বিজেপির
তন্ময় মল্লিক

টার্গেট সবসময় উঁচুতে বাঁধা হয়। তাতে লক্ষ্যের ধারেকাছে না হোক, অর্ধেকটা গেলেও সম্মান বাঁচে। বিজেপির দিল্লি নেতৃত্বও সেই নীতিতেই নির্বাচনে আসন লাভের লক্ষ্য স্থির করে। কখনও সখনও শিকে ছিঁড়লেও বেশিরভাগ সময়েই তা মুখ থুবড়ে পড়ে। তাই কেন্দ্রে ফের ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে সন্দিহান বিজেপির এবার লোকসভার টার্গেট চারশো। স্লোগানও তৈরি, ‘আব কি বার ৪০০ পার।’ তার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সুকান্ত মজুমদারদের উঠছে নাভিশ্বাস। কিন্তু অঙ্ক তো মেলাতেই হবে। তাই একুশে ২০০ পারের হুঙ্কার দিয়ে ৭৭-এ আটকে যাওয়া বঙ্গ বিজেপির লোকসভার টার্গেট ২৫। এসব শুনে অনেকেই বলছেন, সংগঠনের তো নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা, অথচ লোভ বিরিয়ানি খাওয়ার।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৩০০ আসন পার করেছিল বিজেপি। সেবার বালাকোট ইস্যুতে দেশজুড়ে তৈরি হয়েছিল জাতীয় ভাবাবেগ। তারসঙ্গে বাংলায় যুক্ত হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের নেতিবাচক ভোট। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েতে বিপুল আসনে ভোট করতে না দেওয়াটা তৃণমূলের কাল হয়েছিল। ২০১৬ সালের নির্বাচনে হেরে বাম-কংগ্রেস জোট রণে ভঙ্গ দেওয়ায় বিজেপিকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন মমতা-বিরোধীরা। বামেদের উজাড় করে দেওয়া ভোটে বিজেপি পেয়েছিল ১৮টি আসন। কিন্তু এখন সেই অবস্থা নেই। উল্টে পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিতে বিজেপির উপর চটে আছে গোটা দেশ। অবস্থা এতটাই খারাপ যে কেন্দ্রীয় এজেন্সির চোখ রাঙানি সত্ত্বেও একের পর এক জোট শরিক ত্যাগ করেছে বিজেপির সঙ্গ। এই অবস্থায় দেশে ৪০০, আর বাংলায় ২৫ আসনের দাবি জানিয়ে হাসির খোরাক হয়েছে বিজেপি।
একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় বিপুল প্রত্যাশা জাগিয়েও মুখ থুবড়ে পড়েছিল বিজেপি। তারপর থেকেই পায়ের তলার মাটি হারাচ্ছে গেরুয়া শিবির। প্রতিটি নির্বাচনে তাদের ভোট কমছে। তা সত্ত্বেও সাগরদিঘি উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীর পরাজয়ে বিজেপি খুব উল্লসিত হয়েছিল। কিন্তু সেই উল্লাস দিনদিন মিইয়ে যাচ্ছে। কারণ বিজেপির নেতারা বুঝতে পারছেন, সাগরদিঘির ফল তাঁদের জন্য অশনি সঙ্কেত। হু-হু করে ভোট কমার ছবি স্পষ্ট। তা সত্ত্বেও লোকসভা নির্বাচনে ২৫টি আসনের দাবির কারণ একটাই, দিল্লির নেতৃত্বের দেওয়া অঙ্কের উত্তর মেলানোর তাগিদ। তবে অনেকেই কটাক্ষ করে বলছেন, ২৫টা শেষপর্যন্ত ২+৫ না হয়ে যায়!
২০১৯ থেকেই বিজেপির বাংলা দখলের স্বপ্ন দেখা শুরু। অবশ্যই তা ঘুরপথে। আর সেই স্বপ্নটা দেখিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। তাঁরা নির্বাচনী প্রচারে এসে প্রায় প্রতিটি জনসভায় বলেছিলেন, দিল্লিতে বিজেপি ক্ষমতায় এলেই পতন হবে তৃণমূল সরকারের। তাই রাজ্যে ১৮টি আসন জিততেই লম্ফঝম্ফ জুড়ে দিয়েছিল বঙ্গ বিজেপি। তখন নেতাদের মুখে শুধু একটাই বুলি, ৩৫৬ ধারা। কথায় কথায় রাজভবনে গিয়ে ‘অভিভাবকে’র কাছে নালিশ ঠুকতেন। ‘নির্বাচন পরবর্তী হিংসা’কে ইস্যু করে বাংলাকে অশান্ত প্রমাণের চেষ্টা হয়েছিল অনেক। একের পর এক কেন্দ্রীয় টিম পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। কারণ তদন্তে নেমে কেন্দ্রীয় টিম বুঝেছিল, অধিকাংশ অভিযোগই মিথ্যে। গল্পের ‘সন্ত্রাস’কে গাছের মগডালে তোলা হয়েছে।
তবে, বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারির দাবিতে জল ঢেলেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই। বঙ্গ বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মেটানোর বৈঠকে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, ঘুরপথে বাংলার ক্ষমতা দখলের কোনও সুযোগ নেই। তৃণমূল সরকারের মোকাবিলা করতে হবে গণতান্ত্রিক পথে। আন্দোলন করে। আর সফল আন্দোলনকারীর দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেছিলেন এমন একজনের নাম যাতে বঙ্গ বিজেপির কাটা ঘায়ে পড়েছিল নুনের ছিটে। অমিত শাহ তৃণমূল নেত্রীর আন্দোলন ও পথকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কারণ তিনিও মানেন, মমতাই হলেন আন্দোলনের প্রতীক।
বিরোধীরা যতই সমালোচনা করুন না কেন, সাধারণ মানুষের কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই আন্দোলন, পরিষেবা ও জনসংযোগের রোলমডেল। তাঁর নেওয়া সমস্ত সরকারি কর্মসূচি সমাজ জীবনে ফেলেছে আলোড়ন। স্বাধীনতা লাভের পর দেশের বিভিন্ন রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে অনেকেই বসেছেন, কিন্তু তাঁর মতো করে মেয়েদের জন্য আর কে ভাবতে পেরেছেন? কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর কন্যাশ্রীর আদলে চালু করেছে ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও।’ রাজ্যের ‘কৃষকবন্ধু’ অনুসরণে কেন্দ্রে চলছে ‘প্রধানমন্ত্রী কৃষক সম্মাননিধি।’ ‘রূপশ্রী’ কোনও জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি ঠিকই, কিন্তু লক্ষ লক্ষ কন্যাদায়গ্রস্ত দুঃস্থ বাবা, মায়ের দুশ্চিন্তা দূর করেছে। 
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু প্রকল্প চালু করেন না, তার সুযোগসুবিধাও মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। 
তাঁর ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্প সাধারণ মানুষকে 
দিয়েছে ‘গণদেবতা’র মর্যাদা। মানুষ বুঝেছে, 
সরকারি সাহায্য কোনও করুণা বা দয়ার দান নয়, সেটা তাঁদের অধিকার।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্গাপুজো কমিটিগুলিকে অনুদান দেওয়ায় বিরোধীদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু পিছু হটেননি। করোনার জন্য পুজোর অনুদান বাড়ানোয় সমালোচনার ঝাঁঝ হয়েছিল তীব্র। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ভোটব্যাঙ্ক তৈরির অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিলেন বহু নেটনাগরিক। কিন্তু মজাটা হল, যোগী আদিত্যনাথের সরকারও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথ অনুসরণ করছে। উত্তরপ্রদেশে চৈত্র নবরাত্রি পালনের জন্য এবার থেকে দেওয়া হচ্ছে টাকা। পরিমাণটা কম নয়, এক লক্ষ। 
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও প্রকল্প চালু করলেই বিরোধীরা তার পিছনে অভিসন্ধি খুঁজে পান। সমালোচনাও করেন। আবার বাঁচার জন্য সেই কর্মসূচিকে আঁকড়ে ধরেন। কেবল নামটা বদলে 
দেন। কোনও দলের কর্মসূচি বা সরকারি প্রকল্প 
ভালো হলে তাকে অনুসরণ করা অন্যায় নয়। 
বরং সাধারণ মানুষের জন্যে তা স্বাস্থ্যকর। কিন্তু সমালোচনা করার পর তাকেই আঁকড়ে ধরলে? বুঝতে হবে, সেটা দৈন্যের লক্ষণ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, জনপ্রতিনিধির সবচেয়ে বড় মূলধন জনসংযোগ। তাই মুখ্যমন্ত্রী হয়েও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যান অনায়াসেই। গাড়ি থেকে নেমে দোকানে ঢুকে চা বানিয়ে কিংবা তেলেভাজা ভেজে খাওয়াতে পারেন সঙ্গীদের। দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের একাংশের জনবিচ্ছিন্নতা ও বিচ্যুতি দেখে তিনি চালু করেছিলেন ‘দিদির দূত’ কর্মসূচি। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ‘দিদির ভূত’ বলে কটাক্ষ শুরু করে দেয় বিরোধীরা। অথচ ভোট এগিয়ে আসতেই সুকান্ত মজুমদাররা সেই রাস্তাতে হাঁটার চেষ্টা করছেন। শুরু করেছে ‘বুথ সশক্তিকরণ’ কর্মসূচি। আর বালুরঘাটে ‘পাড়ায় সুকান্ত’। বিজেপির রাজ্য সভাপতির কথায়, উদ্যোগ ফলপ্রসূ হলে রাজ্যের অন্যত্রও তা চালু হবে। 
বিজেপির এই কর্মসূচির সাফল্যের পিছনে সংশয়ের কারণ দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের তোলা কৃত্রিম হওয়ার জোরে বিজেপি এরাজ্যে প্রধান বিরোধী দল হয়েছে। কিন্তু সাংগঠনিক দুর্বলতা থেকেই গিয়েছে। তাই বিজেপির কোনও আন্দোলনই বেশিদিন টেকে না। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়াই করে উঠে এসেছেন।  কঠিন পরিস্থিতির মুখেও কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, সেটা তিনি জানেন। 
এরাজ্যে যাঁরা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন তাঁরা প্রত্যেকেই দলের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে তাঁদের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীকটাই ছিল বড়। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে দল গড়েছেন। তিনিই দলের মুখ। মানুষ তাঁকে দেখেই তৃণমূলকে ভোট দেয়। অন্যদের সঙ্গে তাঁর ফারাকটা এখানেই। তাই রাস্তায় নামলেই তিনি ‘হ্যামলিন’।
মানুষের অধিকার নিয়ে যে আন্দোলন তাঁকে মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে হ্যাটট্রিক করার বিরল সম্মান এনে দিয়েছে তা থেকে তিনি সরেননি। দেড় বছর ধরে অনেক অনুনয়, বিনয় করেও রাজ্যের প্রাপ্য বকেয়া আদায় করতে পারেননি। তাই ফের নামছেন আন্দোলনে। তাঁর দু’দিনের ধর্নায় কি কেন্দ্র বাংলায় ১০০ দিনের কাজ চালু করে দেবে? মোটেই না। যারা কোভিডের দোহাই দিয়ে গরিবের ‘ইজ্জত’ মান্থলি বন্ধ করে, আধার ও প্যান কার্ডের সংযোগে দেরি হওয়ায় ঘাড় ধরে হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে, তারা সুযোগ পেলেই গরিবের পেটে লাথি মারবে, এটাই তো স্বাভাবিক। বিরোধী অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে নরেন্দ্র মোদি হয়তো ফের একবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, কিন্তু কিছুতেই গরিবের বন্ধু হতে পারবেন না।

25th     March,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ