বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

অসম্পূর্ণ শিক্ষার বেসাতি
শান্তনু দত্তগুপ্ত

সমাজ এবং ব্যবসার মধ্যে মিল কোথায়? দু’টি ক্ষেত্রেই পাবলিকের ভাবনাচিন্তাটাকে একটা নির্দিষ্ট ট্র্যাকে নিয়ে ফেলতে হয়। তাহলে দু’টোই সফল। আর তা না হলে দু’টোই ফ্লপ। বোঝা গেল না তো? বিষয়টাকে একটু সহজ করে নেওয়া যাক। ধরুন, একটা পাড়া বা ব্লকের প্রত্যেক পরিবারের কর্তা মনে করেন, মাথার বাঁদিকে সিঁথি করা খুব খারাপ। তাই তাঁরা ডানদিকে সিঁথি করতে শুরু করলেন। তাঁদের দেখাদেখি বাড়ির লোকজনও তাই করল। সবাইকে স্রোতের একদিকে চলতে দেখে পাশের পাড়ার লোকও ভাবল, তাহলে এটাই ঠিক। তারপর তারাও সিঁথি করল মাথার ডানদিকে। একটা সময় দেখা গেল, মাথার ডানদিকে সিঁথি করাটাই সমাজে রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে। যে মানুষটি একটু অন্যরকম হতে চেয়ে বাঁদিকে সিঁথি করছে, তাকেই লোকে দুচ্ছাই করছে। সেও ভয় পেয়ে যাচ্ছে... ভাবছে, ইস্‌! ঩নিশ্চয়ই তাহলে মাথার বাঁদিকে সিঁথি করাটা ভীষণ খারাপ। ও পথে আর না যাওয়াই ভালো। অর্থাৎ, মানুষকে একটা নির্দিষ্ট ভাবনায় চালিত করা। যে ব্যক্তি এটা করতে পারলেন, তিনিই সফল। তিনিই লিডার। আর বাকি সকলে? তাঁর অনুগামী। কিন্তু আমরা দেখলাম না, ওই ব্যক্তিকে একটি সংস্থা এমন একটা কিছু করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। কারণ তাদের স্লোগান, আমাদের ব্র্যান্ডের চিরুনি দিয়ে আঁচড়ালে ডানদিকে সিঁথিটা ভালো হয়। এই ব্যাপারটাই পাবলিককে বা সমাজকে খাইয়ে দেওয়া দরকার ছিল। সেটাই হল। তার কোয়ালিটি, অন্য কোনও অপশন... কিছুই তখন আর মানুষের মাথায় ধাক্কা দিল না। সবাই চলল এক পথে... স্রোত বইল যেদিকে। সৌজন্যে সফল লিডার! উঁহু, সফল ব্যবসায়ী। এই কলাকৌশলের আক্ষরিক নাম কী? এটাই প্রোপাগান্ডা।
‘গণতন্ত্রের অন্যতম পরিচালক কী? জনগণের মতামত এবং সঙ্ঘবদ্ধ অভ্যাসকে সচেতন এবং বুদ্ধিদীপ্তভাবে ম্যানিপুলেট করা।’ ১৯২৮ সালে এই কথাগুলো লিখে গিয়েছেন এডওয়ার্ড বার্নেজ। মার্কিন লেখক এবং জনসংযোগ বা পাবলিক রিলেশনসের জনক। তাঁর স্পষ্ট কথা, ‘সমাজের এই মেক্যানিজমটা চোখে দেখা যায় না। কিন্তু যে বা যারা মগজ ধোলাইয়ের এই কাজটা দক্ষতার সঙ্গে করতে পারে, তারাই দেশের প্রকৃত শাসক।’ কী ভয়ানক শিক্ষাই না দিয়ে গিয়েছেন বার্নেজ। তাঁর কথা মতো গণতন্ত্রকে নিপুণভাবে ব্যবহার করা যায়... বদলানো যায় জনগণের মতামত। শাসকরা সেটা করেই থাকে। রাজনৈতিক দলগুলি বলে আদর্শের কথা। কিন্তু সেটা লোকদেখানো, ছেলেভুলানো। এই আদর্শের নেপথ্যে লুকিয়ে আছে আসলে স্বার্থসিদ্ধির ইস্তাহার। কীভাবে ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখা যায়, কামানো যায়, জনতাকে নিজেদের কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়... সেটাই আদর্শ। সেটাই শাসন ব্যবস্থা। কংগ্রেস যখন শাসন করবে, তখন তাদের ম্যানিপুলেশন হবে খানিক রক্ষণাত্মক। কিন্তু বিজেপি যখন কুর্সিতে বসবে, তাদের ‘আদর্শ’ হবে ঘোর আগ্রাসী। ফারাক এটুকুই। লক্ষ্য কিন্তু প্রত্যেকেরই এক—মসনদে টিকে থাকা। ক্ষমতার লোভ ভয়ানক। একবার এই গলিতে ঢুকে পড়লে বেরনো খুব কঠিন। পুলিস সেলাম ঠুকবে, জনগণ মাইবাপ বলে পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে, যেখানে যা দরকার হবে একটা ফোন ঘোরালেই কাজ হাসিল... এটাই তো ক্ষমতা! এটাই ভারতের গণতন্ত্র। আর বিজেপি মানে তো শুধু শাসকের মুখ বা ধড় নয়, তার ল্যাজটাও বিরাট বড়। তার পোশাকি নাম সঙ্ঘ। নাগপুরে বসেই তারা ঘোরাবে নিয়ন্ত্রণের ছড়ি। তাদের কথায় তৈরি হবে গো-রক্ষক বাহিনী। তারা বলবে, ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ প্রেম দিবস-টিবস চলবে না। দিনটা হোক গো-আলিঙ্গন দিবস। দেশজুড়ে চূড়ান্ত সমালোচনা এবং খিল্লির জেরে সরকার তার থেকে পিছিয়েও আসবে। তারপরও অবশ্য গোরু গাছে তোলার ট্রেন্ড স্তিমিত হবে না। বরং সঙ্ঘ বলবে, সংস্কারের সূত্রপাত হোক গর্ভ থেকে। মানে, সন্তান গর্ভে ধারণ করা মাত্র তার শিক্ষা শুরু করে দিতে হবে। শেখাতে হবে ধর্ম, হিন্দুত্ব। তবেই না জন্মের পর সে সঠিক পথে এগবে! 
সঙ্ঘের কর্তাব্যক্তিরা বোধহয় মহাভারতে অভিমন্যুর উপাখ্যানে বড্ড বেশি অনুপ্রাণিত। মহাভারতে রয়েছে, গর্ভাবস্থায় সুভদ্রাকে চক্রব্যূহে প্রবেশের কৌশল বলছিলেন অর্জুন। মায়ের গর্ভে থাকা অভিমন্যু তখনই নাকি শিখে নেন বিষয়টি। সঙ্ঘের বিধাতারাও বোধহয় তেমন কিছুই আশা করছেন আজকের ভারতীয়দের থেকে। আমরাও শুনছি, গুরুত্ব দিচ্ছি, খবরে তা প্রকাশও পাচ্ছে। এই গুরুত্বের কারণ কী? তাঁরা আমাদের ভাবনার গভীরে প্রবেশ করার ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছেন। তাঁরা চালিত করছেন আমাদের মতামতকে। বিশ্বাসে বাধ্য করছেন—তাঁরাই ঠিক। শাসকের তো এটাই কাজ! তাই নয় কি? 
আসলে রাজনীতির সঙ্গে প্রোপাগান্ডার সম্পর্ক চিরকালই গভীর। ভোট এলেই নেতানেত্রীরা এমন একটা হাবভাব করেন, যেন দেশের মানুষের মতামত তাঁদের কাছে ভগবানের আদেশ। নির্বাচন মিটে গেলেই অবশ্য রূপটা বদলে যায়। তখন আর ভোটারদের মতামত তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং নিজেদের ভাবনা মানুষের উপর চাপানোর জন্য তাঁরা বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। এই যেমন নরেন্দ্র মোদি এবং ব্রিগেড গত ন’বছর ধরে করে চলেছেন। প্রত্যেকটা পদক্ষেপের পিছনেই রয়েছে একটা সূক্ষ্ম হিন্দুত্ববাদী কলকাঠি। এবং অবশ্যই আরএসএসের চিরকালীন কিছু এজেন্ডা বাস্তবায়িত করার আপ্রাণ চেষ্টা। বলতেই হয়, তারা সফল। কারণ, আমরা তাদেরই বিশ্বাসের উপর ভর করে গণতন্ত্রের ইন্টেরিয়র ডেকরেশন চালিয়ে যাচ্ছি। বার্নেজ সেই ১০০ বছর আগে লিখে গিয়েছেন, ‘সাধারণ মানুষের মতামতের মধ্যে স্বর্গীয় কোনও বার্তা আছে বলে অন্তর থেকে কোনও রাজনীতিক বিশ্বাস করেন না। এমনটা ভাবেন না কোনও সিরিয়াস মনোবিদও। জনতার কণ্ঠ আসলে সমাজের ভাবনা, আর সেটা তৈরি করে নেতারা। সেই নেতা, যাঁকে সমাজ বা জনতা বিশ্বাস করে। সেই নেতাই প্রভাবিত করেন মানুষের চিন্তাধারাকে। সফল লিডার কে? যিনি প্রোপাগান্ডাকে অস্ত্র বানিয়ে মানুষের মতামত বদলে দেয়’। 
আমরা মূল্যবৃদ্ধির আগুনে পুড়ছি, বেকারত্বের অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি। এটাই আমাদের বর্তমান এবং আমরা জানি, এটাই ভবিষ্যৎ। তারপরও আমরা ভাবছি, সমালোচনা করছি, গালি দিচ্ছি... কিন্তু তারপরও ভরসা রাখছি গেরুয়া প্রোপাগান্ডার উপর। তাহলে কে সফল? বিরোধীরা? না, সাফল্য এখনও বিজেপির আঙিনাতেই গোঁত্তা খাচ্ছে। আর সফল নেতা? নরেন্দ্র মোদি। তিনি এবং তাঁর বাহিনী যা বলবেন, সেটাই হয়ে উঠবে জনমত। যেমন দেখা যাক রাহুল গান্ধী ইস্যু। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে এই ব্যক্তির কতটা যোগ্যতা রয়েছে, সেটা ভোটাররা ঠিক করবেন। কিন্তু মোদিজি এবং তাঁর অনুগতরা প্রতি মুহূর্তে রাহুল গান্ধীকে তাচ্ছিল্য করে চলেছেন। সাধারণ কথাও এমন ব্যঙ্গাত্মক ঢঙে বলছেন, যেন সোনিয়া-পুত্র সার্কাসের দীর্ঘ কেরিয়ারের একজন সফল বার্তাবহ। তাঁর আক্রমণ, লন্ডনে গিয়ে রাহুল নাকি ভারতের গণতন্ত্রের অসম্মান করেছেন। ভারতবাসীর মনে তাঁরা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন, দেশের বাইরে কেউ কোনও কথা বললেই তা রাষ্ট্রবিরোধী। সমালোচনা? চলবে না। বিজেপি বিরোধী সংবাদ পরিবেশন? সে তো নয়ই। কিন্তু মোদিজি নিজে যখন দেশের বাইরে গিয়ে পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের নিন্দা করেন? সেটা ভারতের গণতন্ত্রের অপমান নয়? বিদেশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি যখন বলেন, ইউপিএ জমানা আসলে ‘লস্ট ডেকেড’... তখন মনে হয় না, আমি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে অসম্মান করলাম বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের। নাঃ, একথা তাঁর মনে হবে না। এমনটা ভাবব না আমরাও। প্রোপাগান্ডার মায়াজালে আমরাও যে সম্মোহিত। বরং আমরা বিশ্বাস করব, সত্যিই বোধহয় গর্ভাবস্থায় শিক্ষা দেওয়া যায়। গড়ে তোলা যায় সন্তানের ভিত। 
বিজেপির দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা হয়তো ভুলে গিয়েছেন, মহাভারতেও একটা টুইস্ট আছে। চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার মারপ্যাঁচটা সুভদ্রাকে বলে উঠতে পারেননি অর্জুন। তাই অভিমন্যুর শিক্ষাটাও অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল। পরিণাম? দ্রোণাচার্য রচিত ব্যূহে তিনি ঢুকতে পেরেছিলেন, কিন্তু বেরিয়ে আসতে পারেননি। মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল তাঁকে। বিজেপির জমানাতেও কিন্তু চলছে অসম্পূর্ণ শিক্ষার বেসাতি। কারণ, প্রোপাগান্ডা যে ফাঁকা কলসি! প্রচুর বাজবে, তেষ্টা মেটাবে না।

14th     March,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ