অন্ধকারের আড়াল থেকে ভেসে আসা এক কণ্ঠস্বর। মনে হয় খুব চেনা সেই কণ্ঠ, কিন্তু তাও সে নেপথ্যে। একের পর দুই, তিন থেকে চার, এবং সমবেত... হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার আহ্বান, হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের ডাক। ক্যামেরার উল্টোদিকে চেয়ারে বসে ইমরান দাউদ। ব্রিটেনের বাসিন্দা। বাবা বলতেন দেশের কথা, কখনও না ভোলা স্মৃতিগুলো বারবার ফিরে আসত। সকাল থেকে সন্ধ্যা। সেই টানেই ফিরেছিলেন পিতৃভূমিকে ফিরে পেতে। গলা ধরে আসছে তাঁর। বলছেন, ‘তাজমহল থেকে ফিরছিলাম আমরা। রাত হয়ে গিয়েছে রাজ্যে ঢুকতে। দেখলাম ওরা মুহূর্তে ঘিরে ধরল আমাদের। প্রথম টার্গেট করল ড্রাইভারকে’।...
* * *
মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি হল নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ। কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ হল। নরেন্দ্র মোদি সরকারের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সেইসব ছাপিয়ে আলোচনার প্রথম সারিতে থেকে গিয়েছে দু’টি ইস্যু—গৌতম আদানি এবং বিবিসির তথ্যচিত্র। কেন? ১) আদানি এন্টারপ্রাইজের এফপিও শেষ মুহূর্তে ১০০ শতাংশ সাবস্ক্রাইব কারা করে নিল, সেই নামগুলি জানার অদম্য ইচ্ছা আমাদের। প্রচুর আলোচনা, বিতর্ক, আন্দাজে ঢিল ছোড়া চলল দিনেরাতে। তারপর অসহায় সিদ্ধান্তে আসা গেল, শেয়ার হোল্ডারদের তালিকা জনসমক্ষে এলেই জানা যাবে। অতএব, অপেক্ষা। যদিও তাতে জল ঢেলে দিলেন আদানি। এই দফার ২০ হাজার কোটির এফপিও বাজার থেকে তুলে নিলেন তিনি। যাঁরা যাঁরা বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের প্রত্যেককে টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিলেন। অর্থাৎ, নেপথ্যচারীদের নামগুলো কিন্তু থেকে গেল অন্ধকারেই। কৌতূহলের বশে হাত-পা কামড়ালেও লাভের লাভ আর কিছু হবে না। আর ইস্যু ২) বিবিসির তথ্যচিত্র। ভারতে দেখানোয় তাতে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিল কেন্দ্রীয় সরকার। দু’টি পার্টে সব মিলিয়ে দু’ঘণ্টার সিরিজ। বিবিসির দাবি, গুজরাত হিংসার গ্রাউন্ড রিপোর্ট সেখানে রয়েছে। তাতেই আপত্তি। মোদি সরকার এবং তাদের ধামাধরা বহু ‘বিশেষজ্ঞ’ উপসংহার টানলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ খাটো করে দেখানোর জন্যই এটা তৈরি করা হয়েছে। একেবারে পলিটিক্যাল এজেন্ডা। এটা দেখাতে দেওয়া যাবে না। আমাদেরও পেট গুড়গুড় করতে শুরু করল। আলোচনা বা বিতর্ক না হলে কতজন ভারতীয় এই তথ্যচিত্র দেখতেন? কয়েক হাজারও নয়। ১৪০ কোটি জনতার নিরিখে সিন্ধুতে বিন্দুসম। নিঃশব্দে রিলিজ হতো, কয়েকজন বুদ্ধিজীবী মানুষ তা নিয়ে আলোচনা করতেন, আর তারপর সেটি হারিয়ে যেত আকাশে ভেসে যাওয়া ধূলিকণার মতো। কিন্তু মোদি সরকার সেই পথ নিল না। তারা নিষিদ্ধ করে আগ্রহ বাড়িয়ে দিল মানুষের। এই তথ্যচিত্র যাঁরা দেখবেন বলে ঠিক করেছিলেন, তাঁরা কিন্তু কোনও না কোনওভাবে দেখেই নিলেন। পাইরেসির জমানায় একটা লিঙ্ক খুঁজে নেওয়া এমন কোনও হাতি-ঘোড়া বিষয় নয়। উপরন্তু এসব ব্যাপারে উদাসীন আরও কোটি কোটি মানুষ খোঁজ শুরু করে দিলেন, কোথায় পাব তারে? অনেকে পেয়েও গেলেন। দেখে ফেললেন। আর শুরু হয়ে গেল চুপিসারে আলোচনা, ‘এসব সত্যি নাকি? তাহলে তো ভয়ানক!’
নাঃ, আটকাতে পারল না বিজেপি। আটকাতে পারল না কেন্দ্র। গোড়াতেই যে গলদ! প্রচার কার হবে, আর কার হবে না, সেটাই এখনও বুঝে উঠতে পারেনি তারা। আবারও দুই সংখ্যাটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ন’বছর শাসনের পরও দু’টি ইস্যুতে কাঁচা রয়ে গিয়েছে মোদি সরকার। ১) দেশবাসীর মনস্তত্ত্ব বোঝা এবং ২) অর্থনীতি।
অর্থনীতি দিয়েই না হয় দেশের সাইকোলজিতে প্রবেশ করা যাক।
এবারের বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ঘোষণা করেছেন, ৭ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়কর দিতে হবে না সাধারণ মানুষকে। তারপর থেকে ছোট ছোট স্ল্যাবে বাড়বে করের পরিমাণ। সাধারণ চাকরিজীবী মানুষ বাজেটের এই একটি ঘোষণার অপেক্ষাতেই বসে থাকে। জিনিসপত্রের দাম কোনটা বাড়ল, আর কোনটা কমল যদি আম আদমির প্রথম কৌতূহল হয়, দ্বিতীয় অবশ্যই আয়কর। নির্মলাদেবী ঘোষণা করলেন, বোঝালেন। কিন্তু মানুষ বুঝল কী? তারা দেখল, আমাদের সরকার আয়কর ব্যবস্থাটাকে নতুন পদ্ধতিতে সরিয়ে নিয়ে যেতে উঠেপড়ে লেগেছে। পুরনো নিয়মে যা যা ছাড় পাওয়া যেত, নতুনে আর সে সব মিলবে না। আগের নিয়মে স্ল্যাবের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, বাড়ানো হচ্ছে চাপ—পুরনো ছেড়ে নতুনে এস। এতেই লাভ। সত্যিই কি তাই? মানুষ কিন্তু ধন্দে। এক একজন বিশেষজ্ঞ এক এক রকম কথা বলছেন। কেউ বলছেন, সব ছাড়ের সুযোগ পুরোপুরি নিতে গেলে পুরনোটাই লাভজনক। আবার কারও দাবি, মোটেই না। নতুন ভালো। অঙ্ক বুঝতেই সাধারণ মানুষের কালঘাম। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ইনকাম করব, তার ভাগ দেব সরকারকে, আর সে জন্যও এত ঝামেলা? খেপে উঠছে মানুষ। এর থেকে শাসককুল কী বুঝলেন? মোদ্দা বিষয়টা হল, সোজা কথাটা সোজাভাবে আপনারা বলতে পারেননি। কারণ দেশবাসীর সাইকোলজি বুঝে হয়নি এই বাজেট। দ্বিতীয় ইনিংসের শেষ লগ্নে যা আপনাদের জন্য ভীষণ জরুরি ছিল। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, মন্দার জ্বালায় মানুষ এমনিতেই ভুগছে। তার উপর আয়কর নিয়ে এত অঙ্ক? নির্মলা ম্যাডামের জানা উচিত, এত সময় মানুষের নেই। এই হিসেব বোঝার জন্য অ্যাকাউন্ট্যান্ট ভাড়া করার সামর্থ্যও না। আপনারা বলতে পারেন, ‘জনমোহিনী বাজেট করাটা আমাদের লক্ষ্য নয়। আমরা দেশের কথা ভাবি। দেশ এগলেই দশের লাভ।’ ঠিক কথা। কিন্তু দেশও কি এগচ্ছে?
আসা যাক আপনাদের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণায়। ক্যাপিটাল এক্সপেনডিচার ৩৩ শতাংশ বাড়িয়েছেন আপনারা। মানেটা হল, আগামী অর্থবর্ষে রাস্তাঘাট, ব্রিজের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো নির্মাণে আপনারা বরাদ্দ রেখেছেন ১০ লক্ষ কোটি টাকা। রাজ্যগুলির জন্য বরাদ্দের পরিমাণও বাড়বে। সব মিলিয়ে খরচের হিসেব আসছে ১৩.৭ লক্ষ কোটি টাকায়। খুবই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। ঘাড়ের উপর মন্দার ভূত নাচছে, বিনিয়োগ আসছে না, লাভজনক সরকারি সংস্থাও কেউ কিনতে চাইছে না... এই অবস্থায় পরিকাঠামো নির্মাণে বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়। ২০০৮ সালে মন্দা যখন গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, মনমোহন সিং তাঁর আঁচ খুব একটা ভারতের উপর পড়তে দেননি। তার প্রধান কারণ হল, পরিস্থিতি বুঝে তিনি আগেভাগেই ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
আসলে পরিকাঠামো নির্মাণে সরাসরি শাসকের কোনও উপকার হয় না। সবটাই পরোক্ষে। ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার বাড়িয়ে তারা মূলত বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলিকে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করে। জাতীয় সড়ক, ব্রিজ, এয়ারপোর্ট তৈরি করবে বেসরকারি সংস্থা। টেন্ডার ডাকা হবে। সেই মতো দায়িত্ব পাবে কোনও একটি কোম্পানি। তারা প্রয়োজন মতো দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করবে, তারা কাজ করবে, দেশের সম্পদ বাড়বে। মানুষ কাজ পেলে হাতে টাকা আসবে। সেই টাকায় তারা পণ্য কিনবে। বাজার অর্থনীতিতে টাকাটা রোল হবে। আর সরকার জানে, রাস্তাঘাট ভালো হলে বিদেশি সংস্থাগুলিও ভাববে লগ্নির কথা। এগুলো সবই অর্থনীতির বেসিক কথাবার্তা।
কিন্তু দুই জমানার ফারাক কোথায়? মনমোহন সিং বুঝেছিলেন, শুধু প্রাইভেট কোম্পানিগুলিকে চাঙ্গা করলেই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে না। গ্রামীণ অর্থনীতির কথাও ভাবতে হবে। দক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে গুরুত্ব দিতে হবে অদক্ষ শ্রমিকদেরও। তাই তিনি একইসঙ্গে বাড়িয়েছিলেন ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ। মোদি সরকার ঠিক উল্টোটা করেছে। ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ তারা কমিয়ে দিয়েছে একধাক্কায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। কোভিড পরবর্তী সময়ে যে প্রকল্পে তৈরি শ্রমদিবস দেশের অর্থনীতির ভিত নড়বড়ে হতে দেয়নি, কোপ পড়ছে তারই ঘাড়ে। পুকুর কেটে, মাটি তুলে যাঁরা সংসার চালাতেন, তাঁরা আজ আতান্তরে। এবং তাঁদের সংখ্যাটা শহরের দক্ষ শ্রমিক এবং চাকরিজীবীদের থেকে অনেক কোটি এগিয়ে। মনমোহন সিং বুঝেছিলেন, গ্রাম এবং শহর, টাকার জোগান দিতে হবে দু’জনকেই। তবে ভারসাম্য আসবে অর্থনীতিতে। কারণ তিনি অর্থনীতির সঙ্গে দেশবাসীর মনস্তত্ত্বটাও বুঝতেন।
সেখানেই ডাহা ফেল মোদিজির দ্বিতীয় ইনিংসের বাজেট। সংসদে দাঁড়িয়ে নির্মলাদেবী দেড় ঘণ্টা বক্তৃতা দেওয়ার আগে সরকারের ম্যানেজাররা কি ভেবেছিলেন, এতে সাধারণ মানুষের কতটা লাভ হবে? জিনিসপত্রের দাম কি কমবে? প্রত্যেকটা বেসরকারি সংস্থা এখন কর্মী ছাঁটাইয়ে ব্যস্ত। সেই প্রবণতার কি বদল হবে? গত বছর বাজেটেও তো পরিকাঠামো নির্মাণে মোদি সরকার বরাদ্দ করেছিল ৭ লক্ষ কোটি টাকা। তারপরও কিন্তু কর্পোরেট জগৎ মুখ তুলে তাকায়নি। ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটগুলি উৎপাদন বাড়ায়নি। কেন? বাজারে চাহিদাই যে নেই! উৎপাদন বাড়বে কেন? আর উৎপাদন না বাড়লে চাকরিই বা বাড়বে কেন? এর উত্তর কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় পাওয়া গেল না।
নতুন ভারতের কথা বলছে মোদি সরকার। নির্মলা ম্যাডাম ২০৩০, ২০৪০ সালের প্রসঙ্গ টানছেন। পড়ছেন তাঁর সরকারের ‘ভিশনারি বাজেট’। আর তখন প্রায় সবার অলক্ষে জামিনে মুক্তি পাচ্ছেন সিদ্দিক কাপ্পান। ৮৪৬ দিন জেলবন্দি থাকার পর। কারণ তিনি ধর্ষিতার ন্যায়বিচারের দরবার করতে হাতরাস যাচ্ছিলেন। কেরলের এই সাংবাদিকের গায়ে দেশদ্রোহীর তকমা সেঁটে দিতে কয়েক ঘণ্টা সময় লেগেছিল শাসকের। ‘অপরাধমুক্ত’ তিনি এখনও নন। তাঁর বিধ্বস্ত শরীরটা আমাদের বারবার শেখাচ্ছে, বিপ্লবী হতে যেও না। স্বাধীনতা তখন হয়ে যাবে সংবিধান নামক বইয়ের স্রেফ একটা শব্দ। নিষিদ্ধ হবে বাকস্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার। কারণ আমাদের তাকাতে হবে সামনের দিকে। গাইতে হবে সাফল্যের জয়গান... সবচেয়ে শক্তিশালী নেতার। সমীক্ষা বলছে, বাইডেন, ঋষি সুনাককেও পিছনে ফেলে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। বিশ্বদরবারে বন্দিত তিনি। নতুন ভারত... নতুন উত্থান। অবচেতনে তবু কেন ভেসে আসছে ওই কণ্ঠস্বর, ‘...অন্য কোনও বিকল্প নেই। এখানকার নেতা, পুলিস, প্রত্যেক হিন্দুকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে। চালাতে হবে সাফাই অভিযান।’