বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

বাজেট ভাষণে আজকের পরিস্থিতি উপেক্ষিত
পি চিদম্বরম

বাজেট আলোচনার ব্যস্ততায় কেটেছে গত সপ্তাহ। একটা আর্থিক বছরের জন্য সরকারের আনুমানিক আয় এবং ব্যয়ের বার্ষিক খতিয়ানকে ছাপিয়ে গিয়েছে কেন্দ্রীয় বাজেট। সরকারের নীতি ও কর্মসূচি জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মূল বাহন এখন এটাই। সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের পাশাপাশি সঙ্কেত পেতেও মানুষ বাজেটের দিকে তাকিয়ে থাকে।
যাদের বলার সাহস নেই তারা অবশ্য থাকে নির্বাক। সরকারের তরফে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের কাছে তাদের কোনও প্রবেশাধিকার নেই। সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সাংসদদের উপর তারা নির্ভর করে। লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা দাপুটে সরকার সাধারণভাবে নিজেতেই মগ্ন থাকে এবং অন্য রাজনৈতিক দল কিংবা সাংসদদের সঙ্গে পরামর্শ করে না।
প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টার ভূমিকা
হালফিল আর্থিক পরিস্থিতি জানাতে বাজেটের প্রাক্কালে যে অর্থনৈতিক সমীক্ষা (ইএস) উপস্থাপন করা হয়, জনগণ এবং বিশেষজ্ঞরা সেটার দিকেই তাকিয়ে থাকেন। পরবর্তী বছর নিয়ে সরকারের ‘আউটলুক’ বা ‘দৃষ্টিভঙ্গি’ কী, যথারীতি, ২০২২-২৩ অর্থনৈতিক সমীক্ষার ১ নম্বর অধ্যায়ে সেটা বর্ণিত হয়েছে। প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা (সিইএ) এবছর দিশাহীনভাবে হাতড়ানোর পর ২০২৩-২৪-এর জন্য দৃষ্টিভঙ্গির সারাংশটা দুটো অনুচ্ছেদে বিবৃত করেছেন। সেটা নীচে তুলে দেওয়া হল। 
১.৩০। এমনকী ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি উজ্জ্বল থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আগামী বছর চাপেই থাকবে। থাকবে লগ্নির মূল্যে পতনের ঝুঁকি। তার থেকেই উদ্ভূত একটা অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে বলে মনে করা হচ্ছে। কয়েক দশকের উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, সারা পৃথিবীর কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলোকে আর্থিক পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে বাধ্য করেছে। বিশ্ব আর্থিক ক্ষেত্রে কঠোরতার নীতির প্রভাব চোখে পড়াও শুরু হয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মন্থর হয়ে আসছে। এটা উন্নত অর্থনীতিতেই বিশেষভাবে চোখে পড়ছে। এছাড়া চাপের মধ্যে পড়ে গিয়েছে সরবরাহ শৃঙ্খল। বাজারের উপর দখলদারি নিয়ে রয়েছে আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব। তার ফলে বেড়ে গিয়েছে অনিশ্চয়তা। সব মিলিয়ে আরও খারাপ হয়ে গিয়েছে ‘গ্লোবাল আউটলুক’। তাই, আন্তর্জাতিক বৃদ্ধি হ্রাসের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। বৃদ্ধির হার ২০২২ সালের ৩.২ শতাংশ থেকে ২.৭ শতাংশে নেমে আসবে ২০২৩ সালে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের (আইএমএফ) ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক, অক্টোবর ২০২২-এ এমনটাই বলা হয়েছে। আর্থিক ক্ষেত্রে বৃদ্ধির নিম্নগতির সঙ্গে বর্ধিত অনিশ্চয়তার পরিস্থিতি ট্রেড গ্রোথ বা বাণিজ্য বৃদ্ধিকে কমিয়ে দেবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লুটিও) পূর্বাভাসেই দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যবসা বৃদ্ধির গতি নেমে যাবে। বৃদ্ধির হার ২০২২ সালে ৩.৫ শতাংশ ছিল। সেটা ২০২৩ সালে ১.০ শতাংশে নেমে আসবে। 
১.৩১। বাহ্যিক ক্ষেত্রে, অ্যাকাউন্ট ব্যালান্সের ঝুঁকিটা আসবে একাধিক উৎস থেকে। জিনিসপত্রের দাম যে রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছিল, তার চেয়ে অবশ্য কমেছে। তবু এখনও যেখানে রয়েছে সেটা আগের স্বাভাবিক অবস্থার থেকে অনেকটাই বেশি। পণ্য অগ্নিমূল্য হওয়া সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেশ চড়া। এই পরিস্থিতি মোট আমদানির খরচ বাড়াবে। পরিণামে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স ভারতের আরও বিপক্ষে চলে যাবে। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাপী চাহিদা হ্রাসের কারণে ভারতের রপ্তানি বৃদ্ধির হার থমকে যাবে। সব মিলিয়ে গভীরতর হবে বাণিজ্য সংক্রান্ত সমস্যাটা। এই চক্রে পড়ে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ঘাটতি আরও বেড়ে গেলে দেশীয় মুদ্রার উপর অবমূল্যায়নের চাপ আসতে পারে।
প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা যদি মনে করে থাকেন, তাঁর কাজ তিনি করেছেন, তিনি ভুল ভেবেছেন। তাঁর উচিত ছিল, ‘দৃষ্টিভঙ্গিকে’ ভারতীয় প্রেক্ষাপটে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে সরকারকে আগেভাগে জানানো, যাতে প্রয়োজনীয় সংশোধনের জন্য সরকার পদক্ষেপ করতে পারে। একই সময়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রী, অর্থনৈতিক সমীক্ষার‌ অধ্যায় ১ পড়ার পর তাঁর মূল্যায়ন সংসদের সঙ্গে ভাগ করে নেন। অতঃপর ব্যাখ্যা করেন কী ধরনের ব্যবস্থা তিনি নিতে চলেছেন। ব্যর্থ তাঁরা দু’জনেই। তার ফলে যে প্রেক্ষাপটে বাজেট পেশ করা হল, তার সঙ্গে বাজেট বক্তৃতার বিষয়বস্তুর কোনও প্রাসঙ্গিকতা রইল না। সব মিলিয়ে ৯০ মিনিটের ভাষণটা নির্ভীকতার ভান হয়েই থেকে গেল।  
তিনটি সন্দেহজনক বিষয় 
বাজেটে তিনটি জিনিস পরিষ্কার: (১) ২০২২-২৩ সালে মূলধনী ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ অর্থ ব্যয় করতে ব্যর্থ হওয়ায়, অর্থমন্ত্রী ২০২৩-২৪ সালের মূলধনী ব্যয়ের এস্টিমেটকে ৩৩ শতাংশ বাড়িয়েছেন। (২) সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচিতে ব্যয় নির্মমভাবে কমানোর পর, অর্থমন্ত্রী দরিদ্র এবং বঞ্চিতদের এই বলে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন যে, তাদের কল্যাণই সরকারের ধ্যানজ্ঞান। (৩) অর্থমন্ত্রী ২০২০ সালে চালু করেছিলেন বিনাছাড়ের নয়া করব্যবস্থা (এনটিআর)। কিন্তু করদাতাদের সেটার প্রতি আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়ে তিনি এখন হিসেব কষে বোঝাতে সচেষ্ট, মধ্যবিত্ত করদাতাদের জন্য এনটিআর কত বড় আশীর্বাদ। কিন্তু তাঁর এই হিসেব-নিকেশ যে সন্দেহজনক। 
উপর্যুক্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কোনোটিকেই সূক্ষ্মভাবে যাচাই-বাছাই করা হবে না। প্রথমটা হল, সরকারি মূলধনী ব্যয়। অর্থমন্ত্রী পরোক্ষে স্বীকার করেছেন যে, বৃদ্ধির অন্য তিনটি ইঞ্জিন বিকট আওয়াজ করছে। রপ্তানি কমেছে। অর্থমন্ত্রী শিল্পপতিদের ভর্ৎসনা করার পরেও বেসরকারি বিনিয়োগের গতি ধীর। ভোগব্যয় থমকে রয়েছে এবং সেটা পড়েও যেতে পারে। অতএব, সরকারের তরফে মূলধনী ব্যয়বৃদ্ধির বিকল্প অর্থমন্ত্রীর কাছে ছিল না। ২০২২-২৩ সালে ৭,৫০,২৪৬ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবের বিপরীতে সংশোধিত হিসেব ৭,২৮,২৭৪ কোটি টাকায় নেমে আসবে। এই ঘটনা সরকারি প্রকল্পগুলির রূপায়ণে দুর্বলতাই প্রকট করে। রেল, সড়ক প্রভৃতি মন্ত্রকের সীমাবদ্ধতা এবং কর্মক্ষমতার দিকটি উপেক্ষা করেই অর্থমন্ত্রী ১০,০০,৯৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন! এমনকী, মূলধনী ব্যয়ের পক্ষে যাঁরা সওয়াল করে থাকেন এই ঘটনায় তাঁরাও হতবাক। 
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রয়েছে জনকল্যাণে ব্যয়বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি। ২০২২-২৩ সালের জন্য বিবিধ শিরোনামের অধীনে রয়েছে: কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ, নগরোন্নয়ন, এসসি, এসটি, সংখ্যালঘু ও দুর্বল শ্রেণির মানুষের উন্নয়নে গৃহীত ‘আমব্রেলা স্কিম’ ইত্যাদি। বাজেট বরাদ্দকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতিতে পরিণত করে সরকার এই গোষ্ঠীগুলিকে ঠকিয়েছে। চলতি বর্ষের সংশোধিত হিসেবের নিরিখে, আগামী বছরের জন্য সার এবং খাদ্যের উপর ভর্তুকি ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। মনরেগার জন্য বরাদ্দ কমানো হয়েছে ২৯,৪০০ কোটি টাকা। আর প্রাপ্তি বলতে কেবলই কিছু মন ভোলানো কথা।
অপরাধী শনাক্তকরণ
অবশেষে রয়েছে, নয়া করব্যবস্থার (এনটিআর) রহস্য। এর উন্মোচন ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। বিষয়টা পরের সপ্তাহে আলাদাভাবে আলোচনা করব। একটা বিষয় পরিষ্কার: ব্যক্তিগত আয়কর থেকে সমস্ত ছাড়ই বাতিল করতে চায় সরকার।
অনিশ্চয়তায় ভরা বছর সামনেই। একটা তোলপাড় করা পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে পেরতে হবে। নিজেকে তৈরি রাখুন।
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত 

6th     February,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ