বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

বেকারে ছেয়ে গেলে
আয়কর ছাড় কার জন্য?
হিমাংশু সিংহ

 

অদ্ভুত বাজেট। সোনার দাম বাড়িয়ে কৃত্রিম হীরেকে ছাড় দেওয়া হল। একবারও ভেবে দেখা হল না এই দেশের অলিগলিতে হলুদ ধাতুর কারবারিরা একটা ছোট দোকান খুলে আজও কোনওক্রমে সংসার চালান। সংগঠিত বড় ব্যবসায়ীদের আগ্রাসন সত্ত্বেও সেগুলি আজও টিমটিম করে জ্বলছে। মালিক কর্মচারী মেলালে সংখ্যাটা কিন্তু অনেক। কয়েক কোটি। করোনাকাল থেকেই দাম চড়ে রয়েছে। ব্যবসায় মন্দা। এই পরিস্থিতিতে দশ গ্রাম সোনার দর ৬০ হাজারের উপরে চলে গেলে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ ছোট ছোট সোনার দোকান মালিকরা সহ্য করতে পারবেন তো! তবে গুজরাতের হীরে ব্যবসায়ীরা দু’হাত তুলে বিজেপি সরকারকে আশীর্বাদ করবেন। লোকসভা নির্বাচনের এক বছর আগে থাকতেই তাই হীরে লবির মনোরঞ্জন করা হল বাংলা সহ দেশের তামাম সোনা ব্যবসায়ীর ভাত মেরে। 
৮৭ মিনিটের সংক্ষিপ্ত ভাষণ। অর্থমন্ত্রী বেকার সমস্যার কথা উল্লেখই করলেন না একবারও। একটা বাক্যও খরচ করলেন না মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে। পেট্রল, ডিজেল রান্নার গ্যাসের আকাশছোঁয়া দাম নিয়ে। গ্যাসের দাম গত আট বছরে দ্বিগুণ হয়ে প্রায় এগরোশো টাকা। অথচ ছাড় মিলেছে যৎসামান্য। এটাই সরকারের বিচার! অর্থমন্ত্রীর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতায় ‘গরিব’ শব্দটা উচ্চারিত হল মাত্র দু’বার। মুখে অমৃতকালের কথা বললেও নির্মলা সীতারামন সর্বঅর্থেই রামরাজ্যের বাজেটই পেশ করলেন লাল টেম্পল পাড় শাড়িতে। সঙ্গে লাল শালুতে মোড়া আইপড। আয়োজনে খামতি ছিল না। কিন্তু সংখ্যালঘুদের জন্য বরাদ্দ ব্যাপক হ্রাস করা হল কেন, উত্তর মেলেনি। গরিব, কৃষক, যুবক-যুবতীদের উৎসাহ দিতে একটা শব্দও খরচ করা হয়নি কেন, জানা যায়নি তাও। আগাগোড়াই শুধু কথার মায়াজাল, পরিশেষে প্রাপ্তি শূন্য। গরিব মানুষের তেমন কোনও লাভ না হলেও বিকেলের সাংবাদিক সম্মেলনে লাল শাড়ি বদলে গেল শৌখিন হলুদে। সরকারের দাবি, আয়করে যে ছাড় দেওয়া হয়েছে তাতেই মধ্যবিত্ত খুশি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, নতুন না পুরনো আয়কর—কোন কাঠামোয় লাভ বেশি সেই বিভ্রান্তিকর ধাঁধাতেই বন্দি হয়ে গিয়েছে বেতনভুক নাগরিকের যাবতীয় স্বস্তি। প্রায় একশো ঘণ্টা কেটে গেলও হিসেব যেন শেষই হচ্ছে না। পুরনো আয়কর কাঠামোয় বিনিয়োগের উপর হরেক কিসিমের ছাড় আছে। সেইসব ছাড় নতুন কর কাঠামোয় অনুপস্থিত। অথচ এলআইসি, পিপিএফ এসব করাই তো সেই জন্য। ৮০ সি ধারায় দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত করযোগ্য আয়ে ছাড় পেতে। হাউজিং লোনের সুদে দু’লক্ষ টাকা পর্যন্ত ছাড় (২৪বি ধারা) পেতেই একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট কেনা। বাড়তি ছাড় মেলে ন্যাশনাল পেনশন স্কিম ও মেডিক্লেমের মতো স্বাস্থ্যবিমায়। কিন্তু সেসব ছেড়ে নতুন কর কাঠামোয় শুধুই সাত লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত। বাকি ছাড় হাপিশ। সরকারের দাবি, হিসেব অনেক সরল করতে সাহায্য করবে এই নয়া আয়কর কাঠামো। তবে একবার নতুন কাঠামোয় গেলে নাকি আর ফেরা যাবে না। সেই গোলকধাঁধা আর বিভ্রান্তির অদ্ভুত টানাপোড়েনে মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীর হিমশিম অবস্থা। এত হিসেব কষেও লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কিন্তু উনিশ-বিশ। অনেকেই বলছেন, এতো সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো। খুড়োর কল ঝুলিয়ে এই আকালের বাজারে ভোটের ময়দানে হাটট্রিক করাই লক্ষ্য বর্তমান সরকারের। মধ্যিখানে ব্যস্ততা বাড়বে ট্যাক্স কনসালটেন্টদের। কর কমাতে নির্মলার কর ধাঁধায় আক্রান্ত রোগীর ভিড় বাড়বে চেম্বারে! শত শত ইনসিওরেন্স এজেন্ট, হোম লোন সংস্থা ইতিমধ্যেই প্রমাদ গুনছে। নয়া করকাঠামো জনপ্রিয় হলে কর বাঁচানোর টোপ দিয়ে ফি-বছর এজেন্টদের মার্চ মাসের ব্যবসা মাঠে মারা যাবে যে! আর একটা ছোট্ট তথ্য দিই। ১৩৬ কোটির এই গরিব দেশে কর দেয় ১০ কোটিরও কম মানুষ! আর বেকারের সংখ্যা ৪৪ কোটি। এর মধ্যে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, দক্ষ অদক্ষ সব শ্রেণির যুবক যুবতীরাই আছেন। এই বাজেট কার মুখে হাসি ফোটাবে?
অমৃত কালের প্রথম বাজেট। গরল বর্ষণ নয়, প্রত্যাশা ছিল অমৃতকুম্ভ প্রাপ্তির। অর্থমন্ত্রী শুরুও করেছিলেন ছক্কা মেরে। বললেন, ৯ বছর আগে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত ছিল দশম স্থানে। আর এখন পৃথিবীর পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতি। নিঃসন্দেহে পাঁচ ট্রিলিয়নের স্বপ্নে তা দেওয়া মোদি শাসনের উজ্জ্বল কীর্তি। কৃষকের আয় দ্বিগুণের ধারেকাছে না গেলেও নিরন্তর সুখস্বপ্নের কল্পনাকে মর্তে নামিয়ে আনার মিথ্যে জাল বিস্তারও নিঃসন্দেহে সাফল্য।   লকডাউনকে হারিয়ে জিডিপি ৭ শতাংশের আশপাশে। তার জন্য কৃতিত্ব দাবি করতেও ভুল করলেন না নির্মলা। অথচ ভারতীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি গ্রাম ও যুব সমাজের কর্মসংস্থান নিয়ে তেমন কিছুই বলতে শোনা গেল না তাঁকে। বিগত ৪৫ বছরের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বেকার সমস্যার সুরাহার কোনও চেষ্টাই বাজেটে নেই। দোসর জিনিসের দাম। উল্টে করোনার দুর্দিনে যে একশো দিনের কাজ গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রেখেছিল, অক্সিজেন জুগিয়েছিল তার বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। আসন্ন মন্দার যে আশঙ্কা আর্থিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, তার মোকাবিলার কোনও উদ্যোগই কিন্তু চোখে পড়েনি। কার্যত প্রান্তিক মানুষের জন্য একটাও ঘোষণা ভোটের আগের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট খতিয়ানে স্থান পায়নি। 
শুধু একশো দিনের কাজেই ব্যাপক কাটছাঁট হয়নি, কমিয়ে দেওয়া হয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বরাদ্দও। বড়লোকের অবশ্য এতে কিছুই যায় আসে না। তাঁদের জন্য পাঁচতারা নার্সিংহোম, বেসরকারি হাসপাতাল সর্বদা প্রস্তুত। কয়েক লক্ষ টাকা খরচ হলেও ধনীর কী যায় আসে। যায় আসে প্রান্তিক মানুষের, গ্রামের এককোণে পড়ে থাকা অসহায় গরিবের। বৃহৎ কর্পোরেট ও শহুরে উচ্চবিত্ত মানুষের হাতে সরকার যতই তামাক খাক, ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড আজও কৃষি ও গ্রাম। অদ্ভুত এক সরকারি উদাসীনতায় ওই দু’টি ক্ষেত্রই চরম উপেক্ষিত। এক কথায়, মোদিজির ভোট বাজেটে গ্রামের মানুষ ও গ্রামীণ অর্থনীতি সম্পূর্ণ ব্রাত্য। ভাবটা এমন, গরিব মানুষকে নিয়ে কোনও মাথাব্যথাই নেই সরকার বাহাদুরের। বোঝাই যাচ্ছে, রেকর্ড তৃতীয়বার কুর্সিতে বসার দৌড়ে মোদিজির তুরুপের তাস শহরের ভোট। তাই ব্রাত্য কৃষিক্ষেত্র। বরাদ্দ কমেছে ৫ শতাংশ। রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনাটিও চরম অবহেলিত। বরাদ্দ ছাঁটাই ৩১ শতাংশ। বরাদ্দ একধাক্কায় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনাতেও। অর্থাৎ আর্ন্তজাতিক যে সমীক্ষা রিপোর্ট বছরের শুরুতেই ঝড় তুলেছিল, যাতে বলা হয়েছিল, ভারতে ১ শতাংশের হাতে ৪০ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত তার রিপোর্টের সত্যতাই কি বাজেট বক্তৃতাতেও প্রমাণিত হচ্ছে। আরও বলা হয়, মোট জিএসটি আদায়ের ৬৪ শতাংশই আসে ৫০ শতাংশ গরিব, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগপতিদের থেকে। অথচ দেশটা কিন্তু এখনও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বৃহৎ শিল্পপতিদের অঙ্গুলিহেলনে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের আকস্মিক পতনও তাই সরকারের মাথাব্যথার কারণ। প্রশ্ন উঠছে কোন জাদু বলে বিপুল পরিমাণ অর্থ এমন সংস্থায় বিনিয়োগ করেছে এলআইসি ও স্টেট ব্যাঙ্ক, তা নিয়েও। সরকারি অনুগ্রহ ছাড়া এ জিনিস অসম্ভব!
যুবশক্তির জন্য অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা ৪৭ লক্ষ স্টাইপেন্ড। অথচ দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা ৪৪ কোটি। তাহলে এই যোজনা সম্পূর্ণ সফল হলেও মোট বেকারের মাত্র ১ শতাংশও উপকৃত হবে কি না সন্দেহ। আর প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনা? এজন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ৩৬টি কেন্দ্র খোলা হচ্ছে খুব ভালো কথা। কিন্তু রোবোটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স, দ্রোণ প্রযুক্তির উপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার অর্থ এটাও একটি বিশেষ শ্রেণির জন্য আলাদা করে দেওয়া হল। এতে প্রত্যন্ত গ্রামের গরিব ছেলেমেয়েরা কি উপকৃত হবেন? না পুরোটাই শহুরে ধনী বাড়ির যুবক যুবতীদের কথা ভেবে?
বাজেটে চূড়ান্ত উপেক্ষিত সংখ্যালঘুরাও। তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও সংখ্যালঘুদের জন্য টাকা কিন্তু কমে গিয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য আগেরবার বরাদ্দ ছিল ১৬০ কোটি। আর এবার ভোটের আগের বছর তা ছেঁটে করা হয়েছে মাত্র ১০ কোটি। অর্থাৎ কমল প্রায় ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ রামরাজ্যের বাজেট বরাদ্দেও বিভাজনের চোখ রাঙানির উচ্চকিত উপস্থিত। তাহলে সবকা সাথ সবকা বিকাশ শুধু কথার কথা মাত্র! বাজেট তৈরিতেও পুরোমাত্রায় সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবাদ কাজ করেছে। সেই সঙ্গে কর্পোরেটদের উপর নিঃশর্ত নির্ভরতা। কিন্তু এই পথে কি মোকাবিলা করা যাবে আসন্ন মন্দার, বেকার সমস্যা ও মূল্যবৃদ্ধির? নাকি অমৃতকালে এক ভয়ঙ্কর সঙ্কটের অপেক্ষায় দেশের অর্থনীতি। উত্তরটা ভবিষ্যতের গর্ভে।

5th     February,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ