বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

ধর্ম বিদ্বেষীরা কখনও
নেতাজিপ্রেমী হতে পারেন না
সন্দীপন বিশ্বাস

১৯৪৩ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের ঘটনা। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তখন সিঙ্গাপুরে। সেখানকার বিখ্যাত চেট্টিয়ার মন্দিরে যাওয়ার জন্য নেতাজিকে আমন্ত্রণ জানাতে এলেন বিশাল ধনী ব্যক্তি ব্রিজলাল জয়সওয়াল। তিনি মন্দির কমিটির প্রধান। তিনি বললেন, আজাদ হিন্দ বাহিনীর তহবিলে মন্দির কমিটি দশ লক্ষ ডলার দান করতে চায়। তবে একটাই অনুরোধ, নেতাজি যদি একবার মন্দিরে এসে চেকটা নেন, তবে অনেকেই তাঁকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেন। 
নেতাজি জানতেন, চেট্টিয়ার মন্দিরে কোনওদিন কোনও অ-হিন্দু ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। তাই নেতাজি বললেন, ‘আজাদ হিন্দ বাহিনীর একজন সর্বাধিনায়ক হিসেবে কোনও ধর্মস্থানে গিয়ে সেখানকার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকাটা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।’ 
ব্রিজলালজি তাঁকে বললেন, ‘আপনি তো হিন্দু? অসুবিধা কোথায়?’
নেতাজি উত্তরে তাঁকে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, সুভাষচন্দ্র বসু অবশ্যই একজন হিন্দু। কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কের একমাত্র পরিচয় তিনি ভারতীয়। তাই সেখানে যদি আমার সহকর্মীদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়, তবেই আমি যেতে পারি। আমার বাহিনীতে সব ধর্মের মানুষই আছেন।’ 
ব্রিজলালজি উপায়ন্তর না দেখে ফিরে গেলেন। তখন নেতাজির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর স্টেনো ভাস্করণ। তিনি বললেন, ‘স্যার, দশ লক্ষ ডলার কম নয় কিন্তু। সেটা আপনি ফিরিয়ে দিলেন?’ 
নেতাজি হেসে বলেছিলেন, ‘আমার বিবেক দশ লক্ষ ডলারের থেকে অনেক বেশি।’ 
পরদিন সকালে ব্রিজলালজি আবার হাজির। সঙ্গে মন্দির কমিটির আরও কয়েকজন লোক। তাঁরা এসে নেতাজির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আমাদের ভুল আমরা বুঝতে পেরেছি। আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন। আমরা শুধু ঈশ্বরের পুজো করি সামান্য ফুল দিয়ে, কিন্তু নেতাজি, আপনি বুকের রক্ত দিয়ে ভারতমাতার পুজো করেন। আপনারা সবাই চলুন মন্দিরে।’ 
নেতাজি এভাবেই ধর্ম ও সম্প্রদায় নিয়ে মানুষের ভ্রান্ত ধারণা ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের একশো সঙ্গী নিয়ে চেট্টিয়ার মন্দিরে উপস্থিত হন। সেখানে ছিলেন এস এ আইয়ার, জি এস ধীলন, হবিবুর রহমান, মহম্মদ জামান কিয়ানি, শাহনওয়াজ খান, আবিদ হাসান প্রমুখ। তাঁরা সকলেই মন্দিরে বিগ্রহের সামনে বসলেন। ভক্তিভরে প্রণাম করলেন এবং সমস্বরে বললেন, ‘জয়হিন্দ।’
এই কাহিনিটা বলার বিশেষ উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য রয়েছে। কিছুদিন আগেই গেল ভারতের ইতিহাসে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ। একটি নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জন্মদিন। অন্যটি ভারতের সাধারণতন্ত্র দিবস। এই দু’টি দিনকে কেন্দ্র করে ইদানীং বিজেপির মাতামাতি বেড়ে গিয়েছে। বিশেষ করে নেতাজিকে নিয়ে। যে  মানুষটির একদিন রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার কথা ছিল, সেই শ্রেষ্ঠ পুরুষকে নিয়ে কংগ্রেস এবং হিন্দুত্ববাদী দল শ্রদ্ধা জানানোর নামে রাজনীতি করে গেল। কংগ্রেসের 
চেষ্টা ছিল, নেতাজিকে খাটো করে জওহরলাল এবং গান্ধীজিকে বড় করে দেখানো। আবার অন্যদিকে, বিজেপির পূর্বসূরীরা স্বাধীনতা আন্দোলনের 
সময় নেতাজির বিরুদ্ধাচরণ করে যে পাপ করেছিলেন, তাকে মুছে দিতে বর্তমান নেতারা তাঁরই প্রেমে  গদগদ হয়ে উঠেছেন। নেতাজি-প্রেমের অভিনয়ে মেতেছে গেরুয়া বাহিনী। তাই নেতাজি-কন্যা অনিতা পাফ বসু যখন বলেন, বিজেপি তথা হিন্দুত্ববাদী পার্টির সঙ্গে নেতাজির আদর্শ কখনওই মেলে না, তখন 
পদ্ম-নেতাদের গোঁসা হয় এবং তাঁরা তাঁকে পাল্টা আক্রমণে নামেন। তবে মনে রাখা দরকার, পূর্বের নেতাজি-বিদ্বেষ নিয়ে এখনও বিজেপি নেতারা কিন্তু ভুল স্বীকার করেননি।  
দেশের সাধারণতন্ত্র নিয়েও একই কথা বলা যায়। বিজেপির যত বেশি দেশপ্রেমের ভঙ্গি, তার থেকেও বেশি পদে পদে সংবিধানকে অস্বীকার করার নিত্য চেষ্টা। আমাদের সংবিধানের মূল বার্তাই হল একতা, সাম্য। সব ধর্মের সমান অধিকার, নিজস্ব ধর্ম পালন করার অধিকার, প্রতিটি মানুষের সমানাধিকার। কিন্তু বিজেপির শাসনকালে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতা আন্দোলন কালে যখন দেশের সমস্ত মানুষ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় আত্মবলিদান দিচ্ছেন, তখন গেরুয়া নেতা ও সমর্থকরা চাইতেন ইংরেজ থাকুক, ওদের তাড়ানোর দরকার নেই। বরং দেশ থেকে মুসলমানদের তাড়ানো হোক। নানা স্বার্থে তাঁরা একের পর এক গোপন নোট পাঠিয়েছেন ইংরেজ প্রভুর কাছে। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামীর নমস্য কোনও আইকন বিজেপির তৈরি হয়নি। দলীয় বৃত্তের বাইরে সাভারকর আজও দেশবাসীর কাছ থেকে সেই স্বীকৃতি আদায় করতে পারেননি। সেই অভাব দূর করতে বিজেপি আজ ভোট-মুনাফার তাগিদে হঠাৎ করে নেতাজিকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। 
বহু অপ্রিয় সত্যকে চাপা দিতে আজ বিজেপির দরকার অনেকগুলি মুখোশের। মোদি জমানার প্রায় নয় বছর পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এরা আসলে ধর্মেতে বীর, কর্মেতে ধীর। ধর্ম সংক্রান্ত কাজে 
এদের যে বীরত্ব, আগ্রহ বা আগ্রাসী মনোভাব দেখা যায়, কর্মের ক্ষেত্রে তা পুরোপুরি উধাও। তাই 
কাজের ক্ষেত্রে, দেশের উন্নতির ক্ষেত্রে ব্যর্থতা তাদের পায়ে পায়ে শিকল হয়ে জড়িয়ে পড়ছে। সেই ব্যর্থতার কাঁটায় বিদ্ধ হচ্ছেন দেশের আপামর জনগণ। নেতাজির ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনার কণাটুকু এরা গ্রহণ করতে পারলে দেশের হাল ফিরে যেত। শুধু নেতাজিকে আঁকড়ে ধরে ভোটজয়ের কড়ি 
জোগাড় করার ছক। একদিন ব্রিজলাল জয়সওয়াল তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু মোদি-ব্রিগেড তা বুঝতে চাইবে না। একই সঙ্গে দেশাত্মবোধের 
পুরিয়ায় এবং ধর্মবিদ্বেষের পাশাখেলায় তারা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার স্বপ্ন দেখে চলেছে। ক্ষমতায় ফেরা যত কঠিন হয়ে উঠছে, তাদের হিন্দুত্বের আবেগও ততই কট্টর হয়ে উঠছে। 
সাভারকর থেকে আজকের বিজেপি—উগ্র হিন্দুত্বের সেই ধারা প্রতিদিন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে রক্তাক্ত করে চলেছে। এই হিন্দুত্ব মোটেই দেশের সিংহভাগ হিন্দুদের নয়। এই হিন্দুত্বকেই দেশাত্ববোধ বলে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা চলছে। কিন্তু পাপ যেমন বাপকে ছাড়ে না, তেমনই সত্যকে কখনও চাপা দিয়ে রাখা যায় না। বিবিসির মোদি সংক্রান্ত তথ্যচিত্রে সেই সত্যের আংশিক প্রকাশ হয়েছে মাত্র। সেই আংশিক সত্যকে চাপা দিতে মরিয়া চেষ্টা বিজেপির। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে দুই খণ্ডের কড়া ডোজের তথ্যচিত্র, ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন’। দুই খণ্ডের তথ্যচিত্রে প্রশাসক মোদির কার্যকলাপ নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তাঁর উদ্দেশ্য ও ভূমিকা নিয়ে চুলচেরা বিচার করা হয়েছে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদির নানা কাজের সমালোচনা করা হয়েছে সেই তথ্যচিত্রে। এর মধ্যে আছে গোধরা কাণ্ড, সিএএ, এনআরসি, কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার ইত্যাদি। মোদি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘নরেন্দ্র মোদির শাসনকালে দেশের আবহ বদলে গিয়েছে। তিনি যতটাই জনপ্রিয় হয়েছেন, ততটাই বিভেদ সৃষ্টি করেছেন।’ এটাই তো বিজেপির মূল এজেন্ডা। সেই এজেন্ডা নিয়েই তারা স্বাধীনতা পূর্ব কাল থেকে একটু একটু করে এগিয়েছে। মুসলিম ইতিহাস মুছে ফেলতে তারা বদ্ধপরিকর। তাই মুসলিম সম্পর্কিত সমস্ত নাম তারা বদলে ফেলছে। কিন্তু এভাবে কি সত্যিই ইতিহাসকে মুছে ফেলা যায়?
শুধু ইতিহাস নয়, দেশের সংস্কৃতির মধ্যেও জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে হিন্দুত্ব, মিথ্যা ইতিহাস। সম্প্রতি শাহরুখ খান অভিনীত ‘পাঠান’ নিয়ে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ কী খাবেন, মানুষ কী পরবেন ও পড়বেন, মানুষ কী দেখবেন, সরকার যদি তা ঠিক করতে নামে, সেটা হয়ে দাঁড়ায় দেশের সাধারণতন্ত্রের বার্তাকেই অস্বীকার করা। মানুষের এই মৌলিক অধিকার ভাঙার স্পর্ধা দেখান একমাত্র ফ্যাসিস্তরাই। মানুষ সবসময় নিজেই তার বিনোদনের ভাষা খুঁজে নেয়। রাষ্ট্রের খবরদারি বা চোখ রাঙানিকে সে ঘৃণা করে। এতে সবসময় বিপরীত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। শাহরুখের ছবির ক্ষেত্রেও তাই হল। ছবিটি পাঁচদিনে সাড়ে পাঁচশো কোটি টাকার ব্যবসা করে ফেলল। মানুষের অধিকারকে খর্ব করলে মানুষ পাল্টা রুখে দাঁড়াবেই। ছবিটিকে আটকানোর চেষ্টা না হলে হয়তো পাঁচদিনে ‘পাঠান’ এই ব্যবসা দিতে পারত না। উল্টে তারা ‘কাশ্মীর ফাইলস’-এর মতো প্রোপাগান্ডামূলক ছবি করে মানুষকে গেলানোর চেষ্টা করছে। একেই বলে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজিম। 
সুতরাং নেতাজিকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে গেলে এবং সাধারণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষা করতে গেলে দরকার ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, মানুষকে ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার না করা, মানুষের সমানাধিকারকে স্বীকতি দেওয়া এবং তার মৌলিক অধিকারগুলিকে যথাযথভাবে পালন করার সুযোগ দেওয়া। সেক্ষেত্রে দেশ এমনিতেই হাসবে। একইসঙ্গে বিদেশিরাও প্রশস্তিমূলক তথ্যচিত্র বানাবেন।

1st     February,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ