বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

আপনারাই বরং সিলেবাসটা বদলে ফেলুন
শান্তনু দত্তগুপ্ত

সদাগর শুনি ইহা বলে অহঙ্কারে,অভাবে থাকিলে তবে পূজিব উহারে। ধনজন সুখভোগ যা কিছু সম্ভব, সকল আমার আছে আর কিবা অভাব।
ক্রিকেটে একটা কথা আছে—গো টু দ্য বেসিকস। কোনও কিছুই যখন ঠিকঠাক হচ্ছে না, ফিরে যাও গোড়ায়। টেকনিকটা ঝালিয়ে নাও। প্র্যাকটিসের সময় বাড়াও। আর শূন্য থেকে শুরু করো। সমাজ ব্যবস্থাও ঠিক ওই ক্রিকেটের মতো। টলমল করলে শিকড়ে ফিরে যেতে হবেই। এখন সেই সময় এসে গিয়েছে। ভারত আজ এক জটিল সময়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সমাজের পায়ের তলার জমিটা কীভাবে যেন প্রচার সর্বস্ব হয়ে গিয়েছে। সরকার বলছে, ‘তোমরা যা শিখেছ, যা জেনেছ, তার সবটাই ভুল! এসো, নতুন করে শেখো। আমরা শেখাব। আমরা বলব। তোমরা শুনবে। প্রশ্ন? করবে না। সেই অনুমতি তোমাদের দেওয়া হচ্ছে না। আমরা প্রশ্ন শুনি না। আর শুনলেও সেটা আগে থেকে জানিয়ে রাখতে হয়। আমরা তার উত্তর তৈরি করব। তারপর হবে লাইভ টেলিকাস্ট। তাৎক্ষণিক বলে কিছু হয় না। আমরা যতদিন শাসক থাকব, হবেও না। আমরা লিখব নতুন সিলেবাস। সমাজের, শিক্ষার, ধর্মের, বেঁচে থাকার।’ আমরা সেটাই শুনছি। বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি। কিন্তু এগিয়ে এসে বলছি না... রাজা তোর কাপড় কোথায়? অথচ, সেটাও তো আমাদের কর্তব্য! আমরাও যে ভুলে যাচ্ছি অমোঘ একটি টোটকা—‘যে ঠাকুর যে ফুলে তুষ্ট...’। হিন্দুত্বের (হিন্দুধর্ম নয়) ধারক ও বাহক নরেন্দ্র মোদি সরকারের হুঁশ ফেরাতে গেলে লক্ষ্মীর পাঁচালির থেকে ভালো মাধ্যম আর কীই বা হতে পারে। পাঁচালির এই কথাগুলোকে প্রতীকী বললেও ভুল হয় না। কারণ, এখানেও যে বেসিক শিক্ষা! সম্পদ মানেই যে টাকা নয়। হতে পারে সে বিদ্যা, আবার ভোটব্যাঙ্কও। কিন্তু তার জন্য অহঙ্কার করলেই মহা মুশকিল। তরী-সুদ্ধ ডুবতে হবে। ঠিক যেভাবে ডুবেছিল ভিন্ন দেশবাসী বণিক তনয়। বেসিক শিক্ষা, কিন্তু অকাট্য। মোদি সরকারের কর্তাব্যক্তিদের যা এখন ভীষণভাবে প্রয়োজন। কারণ, তাঁরা বুঁদ হয়ে রয়েছেন অহঙ্কারেই। ভাবছেন, যেখানেই হাত দেব, সোনা সেখানেই। মানুষকে যা বোঝাব, ওরা তাই বুঝবে। জিনিসের দাম বাড়বে, তাতে ওরা অভ্যস্ত হবে। সমাজে বিভাজন? ওরা মেনে নিতে বাধ্য। 
এটাই সরকারের ঠিক করে দেওয়া সিলেবাস। পড়তে হবে এটাই। 
সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সরকারের একটা নিবিড় সম্পর্ক থাকাটাই গণতন্ত্রের অলিখিত নিয়ম। সরকারের বার্তা, ভালো-মন্দ সবটাই আম জনতার কাছে পৌঁছে দেয় মিডিয়া। তার জন্য কখনও তারা সরকারি প্রকল্পের গুণগান করে, কখনও সমালোচনা। কিন্তু ভারতবাসীর সৌভাগ্য, আমরা এমন একজন প্রধানমন্ত্রীকে পেয়েছি, যিনি নিজে থেকে সব বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। কখনও মন কী বাত-এর মাধ্যমে, কখনও পরীক্ষা পে চর্চা, আবার কখনও জাতির উদ্দেশে ভাষণ। বাকি কিছু থাকলে সেটা টুইট করে দেন। মিডিয়ার মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজনই তাঁর পড়ে না। তাই সে পথে যান না তিনি। নিন্দুকেরা বলে, টিভির সামনে বলতে গেলেও তাঁর টেলিপ্রম্পটার লাগে। পড়ুয়াদের মুখোমুখি হতে গেলে আগে থেকে জমা করতে হয় প্রশ্ন। মনোনীত হলে মিলবে সুযোগ। ফলে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা এখন হয়ে গিয়েছে বিবৃতি ছাপার। ভালো লেখো, তাহলে তোমারও ভালো হবে। সমালোচনা গণতন্ত্রের শক্তি হতে পারে, কিন্তু বেশি করতে যেও না। কর্মফলের কথা তো গীতাতেই আছে।
বদলে গিয়েছে মিডিয়ার সিলেবাসও। কারণ সরকার বলছে, আমিই নিয়ন্ত্রক। আমিই শেষ কথা। তারা ভুলে যাচ্ছে গীতারই শ্লোক...
প্রকৃতে ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মানি সর্বশঃ
অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে।
অর্থাৎ, অহঙ্কারে মোহাচ্ছন্ন জীব প্রকৃতির গুণে সম্পন্ন কার্যকেই নিজের বলে দাবি করে। মনে করে, আমিই কর্তা।
সিলেবাসে বোধহয় এটাও নেই। 
আমাদের মহামান্য ভারত সরকার প্রাপ্ত ভোট এবং বিরোধীশূন্য আবহাওয়ার অহঙ্কারে মশগুল। নতুন ভারতের জন্মদাতা। বিস্মিত করার মতো বিষয় হল, ‘নতুন’ শব্দটিকে সার্থক করতে গিয়ে তাঁরা দেশের অতীতটাই বদলে দিতে চলেছেন। বদলে যাচ্ছে ইতিহাস, মুছে যাচ্ছে নাম, হারিয়ে যাচ্ছে চরিত্র। ইতিহাসকে জানতে পারছি আমরা নতুনভাবে। বলছে তারা, ইতিহাস লেখা হবে আবার। নতুন করে। গুরুত্ব পাননি যে ‘বিপ্লবী’রা, তাঁরাই উঠে আসবেন ইতিহাসের পাতায়। আরও বেশি করে। যেমন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নাথুরাম গডসে, সাভারকর। বীর সাভারকরের আত্মসমর্পণ সেখানে গুরুত্ব পাবে না। কীভাবে তিনি হিন্দুরাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য সঙ্কল্প করেছিলেন, সেটাই হবে ইতিহাসের অভিমুখ। কোন সাভারকর? যিনি লিখেছিলেন, ‘বলতে কোনও দ্বিধা নেই, লর্ড ডালহৌসি যত ভালো প্রশাসক ছিলেন, তার থেকে অনেক বেশি পাপকার্যে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তাঁর মতো অফিসারদের শুধুই স্বৈরতন্ত্রের মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তিনি ছিলেন নির্দেশের আজ্ঞাবহ দাস, পরিস্থিতি তাঁকে তৈরি করেছিল এবং প্রশাসক হিসেবে পাঠিয়েছিল ভারতে।’ এমন ইতিহাস সত্যিই তারিফ করার মতো। কারণ এই ডালহৌসিকেই আমরা চিনেছি স্বত্ববিলোপ নীতির প্রবর্তক হিসেবে। করদ স্বাধীন রাজ্যগুলি দখল করার জন্য এক মাস্টার স্ট্রোক। অপুত্রক রাজা হলে তো বটেই, অপদার্থ শাসক হলেও সেই রাজ্যের শাসন ক্ষমতা আসবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। অপদার্থতার মানদণ্ডও স্থির করতেন ডালহৌসি। একে একে নিঃস্ব হয়েছিল সাতারা, ঝাঁসি, নাগপুর, পাঞ্জাব।  শুধুমাত্র কোহিনুরের লোভে লর্ড ডালহৌসি দখল করেছিলেন পাঞ্জাব। ১২ বছর বয়সি মহারাজা দলীপ সিং বাধ্য হয়ে কোহিনুর তুলে দিয়েছিলেন ডালহৌসির হাতে। সেই হীরে তিনি মহারানি ভিক্টোরিয়াকে উপহার দিয়ে নাম কামিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁরই আগ্রাসনে বার্মা দখল করে ব্রিটিশরা। তাঁর একগুঁয়ে কিছু নীতির এবং সংস্কারের জন্য অসন্তোষ দানা বাঁধে সেনার মধ্যে। তারই ফল সিপাহী বিদ্রোহ। নতুন ইতিহাসে এইসব থাকবে তো? নাকি মুঘলসরাই স্টেশন, মুঘল গার্ডেনের মতো এই ইতিহাসও মুছে যাবে পাতা থেকে। আমরা পড়ব, সাভারকর ছিলেন দেশের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী, আর ডালহৌসি সেরা প্রশাসক! 
এটাই কি হতে চলেছে স্কুল-কলেজের সিলেবাস? 
এই ভারত নতুন নয়, বদলে যাওয়া। পুরনোকে মুছে দিয়ে নতুনের জন্ম হয় না। অতীতের শিক্ষার ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আবিষ্কার হয় নতুনের। সেটাই সাফল্যের প্রথম ধাপ। আম আদমির সিলেবাস পরিবর্তন হবে, দেশ কিন্তু ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড সদস্য হয়ে উঠতে পারবে না। কারণ দেশবাসী তখন পিছিয়ে যাবে। প্রতিদিন। প্রতিনিয়ত। লড়াই হবে মূল্যবৃদ্ধির, একমুঠো অন্নের, বেঁচে থাকার। ধসে পড়বে অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা। তাই মানুষের নয়, সিলেবাস বদলাতে হবে মোদিজিকে, তাঁর সরকারকে। প্রোপাগান্ডার রাজনীতি ছেড়ে মুখোমুখি হতে হবে মানুষের। বলতে হবে, প্রশ্ন করুন। আমরা উত্তর দেব। আগে থেকে তুলে রাখা প্রশ্ন নয়। আচমকা, যেমন খুশি প্রশ্ন। ভুল হলে বলুন, স্বীকার করব। শুধরে নেব। এটাই তো হওয়া উচিত সরকারের সিলেবাস! সুবিধা মতো কাজ নয়, বিরোধিতা মানেই প্রাপ্য টাকা আটকে দেওয়া নয়, কাজ হবে মানুষের জন্য। 
প্রশ্ন মানুষ করবে। আজ, কাল, বছর খানেকের মধ্যে। ভোট আসছে। তখন কিন্তু প্রশ্নপত্র বা সাজেশন কমন নাও পড়তে পারে। সিলেবাস যাই হোক, উত্তর কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেবে ভোটাররা। অহঙ্কারের অনুচ্ছেদের বাইরে পড়াশোনা না করলে সেটাই হবে মোদি সরকারের মারাত্মক ভুল। মনে পড়বে লক্ষ্মীর পাঁচালির সেই লাইন, ‘অহঙ্কার দোষে দেবী শিক্ষা দিলা মোরে/অপার করুণা তাই বুঝালে দীনেরে’। পরীক্ষার সময় ততক্ষণে শেষ। খাতা জমা পড়ে যাবে। নম্বর দেবে গোটা দেশ। তখন কি আর মোদিজি বলতে পারবেন, এটা সিলেবাসে ছিল না?

31st     January,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ