বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মানুষ, মিশন ও ঐক্যের বার্তা
পি চিদম্বরম

একজন রাজনৈতিক নেতা কোনও প্রকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়াই একটা ‘যাত্রা’ করতে পারেন, এমনটা মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন, আমি জানি। ইতিহাসে মিছিলের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে: আদি শঙ্কর (৭০০ খ্রিস্টাব্দ: বিতর্কিত, ধর্মীয়), মাও সেতুং (১৯৩৪-৩৫, সামরিক), মহাত্মা গান্ধী (১৯৩০, আইন অমান্য) এবং মার্টিন লুথার কিং (১৯৬৩, ১৯৬৫, নাগরিক অধিকার)।
আপনি এই নিবন্ধটি যখন পড়ছেন, রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা ১৩৬ দিনে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি পেরিয়ে এসেছে। রাজনৈতিক বিশ্বাস নির্বিশেষে, কিংবা অরাজনৈতিক ব্যক্তিরও দ্বিমত থাকতে পারে না যে দৃঢ়তা, সংকল্প এবং শারীরিক ধকল মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটা বেনজির প্রদর্শন হল এই যাত্রা। 
কেন বিজেপির শঙ্কা?
রাহুল গান্ধী বারবার বলেছেন যে, তাঁর যাত্রার কোনও রাজনৈতিক বা নির্বাচনকেন্দ্রিক মতলব নেই। ভালোবাসা, সৌভ্রাতৃত্ব, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়াই হল এই যাত্রার এক ও একমাত্র উদ্দেশ্য। এগুলোকে চতুরভাবে ‘রাজনৈতিক’ বা ‘নির্বাচনী’ হিসেবে দেগে দেওয়া যাবে না। এতেই, বিজেপি এবং অন্য সমালোচকরা ঘাবড়ে গিয়েছেন। এই যাত্রার যে সমালোচনা বিজেপি করছে তা যুক্তিবুদ্ধিহীন। রাহুল গান্ধীর এই যাত্রা বাতিল করার উপদেশ দিতে তাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ‘করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার বিপদ’-এর উপর জোর দিয়েছিলেন। এটা নিতান্তই ছেলেমানুষি! 
রাহুল গান্ধী ভয় পেয়ে গিয়ে থেমে যাননি। বরং সমালোচনার পরোয়া না করেই তাঁর কমর্সূচি চালিয়ে গিয়েছেন। তিনি মানুষের কাছে পৌঁছেছেন—বিশেষ করে যুবক, নারী, শিশু, কৃষক, শ্রমিক এবং সমাজের একেবারে প্রান্তিকজনদের কাছে। ভারতে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব যে ব্যাপক হারে রয়েছে; মুদ্রাস্ফীতির জ্বালায় প্রতিটি শ্রেণির মানুষ যে হাহাকার করছে; সমাজে ঘৃণার বার্তাবাহকরা যে সক্রিয়; এবং ভারতীয় সমাজ যে আগের চেয়ে অনেক বেশি বিভক্ত হয়ে গিয়েছে—তাঁর এই ব্যক্তিগত বিশ্বাস কতটা নিখাদ তারও প্রমাণ পেয়েছেন রাহুল। পথসভা ও বড় সমাবেশগুলোতে তিনি এই ব্যাপারে তাঁর গভীর উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন।
‘যাত্রা’-কালে রাহুল গান্ধী অপ্রত্যাশিত সাড়া পাওয়ায় বিজেপি উদ্বিগ্ন কেন? বিশ্বাস করার জন্য কিছু জিনিস দেখা জরুরি। রাহুল গান্ধীর সঙ্গে আমি কন্যাকুমারী, মাইসুরু এবং দিল্লিতে হেঁটেছি। প্রতিটা জায়গায় দেখেছি জনতার বি-রা-ট সমাবেশ। এই ব্যাপারটাই ঘটেছে প্রতিটা রাজ্যে এবং প্রতিটা জায়গায়: আমি এসবের ছবি এবং ভিডিও দেখেছি। যাত্রাপথের কোনও অংশেই কেউ বাস চড়েননি। অংশগ্রহণের জন্য কাউকে টাকাকড়ি দেওয়া হয়নি। এমন প্রতিশ্রুতিও কাউকে দেওয়া হয়নি যে তাঁদের খাবার প্যাকেট দেওয়া হবে। এসব পদযাত্রায় হাজার হাজার যুবক-যুবতী পা মিলিয়েছেন। রাস্তার দু’পাশে হাত নেড়ে, ফুল ছুড়ে, খুশি প্রকাশ করেছেন শত শত মানুষ। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মাঝবয়সি নারী-পুরুষ এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থেকে শিশু পর্যন্ত প্রায় সকলেই। অধিকাংশ মানুষের কাছেই রয়েছে মোবাইল ফোন এবং দেদার ছবি তুলছেন তাঁরা।
শিল্পী, সাহিত্যিক, পণ্ডিত, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রতিবন্ধী ইত্যাদির মতো বিশেষ ব্যক্তিরা আছেন। আমি যতটা দেখেছি, এই যাত্রার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল সাধারণ মানুষজন। তাঁরা একটি নীরব 
বার্তা পাঠাচ্ছেন যে, রাহুল গান্ধীর বার্তা তাঁরা শুনেছেন এবং বুঝেছেন। রাহুলের বার্তা হল—ভারত ভয়ানকভাবে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে, ঘৃণা ও হিংসায় আচ্ছন্ন। সামাজিক ব্যবস্থার এই পতন 
রুখতে আজ জরুরি—প্রেম, সৌভ্রাতৃত্ব, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ঐক্যকে আঁকড়ে ধরা।
দরিদ্রের উপস্থিতি
সর্বত্র বিপুল সংখ্যক গরিব মানুষ, এটাই আমাকে কষ্ট দিয়েছে। যাঁরা অস্বীকার করেন, তাঁরা উপস্থিত থাকলে বুঝতে পারতেন কত হাজার মানুষ গরিব এবং তাঁদের এই দারিদ্র্যের কারণ বেকারত্ব। বিশ্ব বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (গ্লোবাল মাল্টিডাইমেশনাল পভার্টি ইনডেক্স) ২০২২ অনুসারে, ভারতে জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ বা ২২ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ গরিব। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, বাকিরা ধনী! দারিদ্র্যের আর্থিক মাপকাঠিটা হল—শহর এলাকার জন্য প্রতিমাসে মাত্র ১,২৮৬ টাকা এবং প্রতিমাসে মাত্র ১,০৮৯ টাকা গ্রামীণ এলাকার জন্য। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৮.৩ শতাংশ।
আমি নিশ্চিত যে ভিড়ের মধ্যে শত শত এমন মানুষ আছেন যাঁরা গত নির্বাচনে বিজেপি কিংবা অন্য অকংগ্রেসি দলকে ভোট দিয়েছেন, কিন্তু তাঁদের মুখাবয়বে কোনওরকম শত্রুতার ভাব দেখিনি। 
অনেকেরই কৌতূহল রয়েছে, আর রয়েছে প্রায় প্রত্যেকেরই চোখে আশার ঝিলিক: এই যাত্রা কি আর একটু ভালো একটা আগামী কালের দিকে নিয়ে যাবে আমাদের?
বিজেপির শত্রুতা কেন?
ভালোবাসা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিস্তারের ধারণার প্রতি বিজেপি বিরূপ কেন? কারণ, ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ সত্ত্বেও, বিজেপি পরিকল্পিতভাবেই মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বাইরে রেখেছে এবং উপেক্ষা করেছে অন্যান্য সংখ্যালঘুদেরকেও। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদে কোনও মুসলিম ব্যক্তি নেই! বিজেপির লোকসভার সদস্য ৩০৩ জন এবং রাজ্যসভার সদস্য ৯২ জন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে একজনও মুসলিম নেই। সুপ্রিম কোর্টের একমাত্র মুসলিম বিচারপতি অবসর নিয়েছেন গত ৫ জানুয়ারি। হিংসা ছড়ানোর জন্য হিজাব পরা, ভিন্নধর্মে বিবাহ, তথাকথিত লাভ জিহাদ, গোরু পরিবহণ, হস্টেলে আমিষ খাবার পরিবেশন প্রভৃতি কিছু অজুহাত খুঁজে পেয়েছে বিজেপি সমর্থকরা। ঘটে গণপ্রহারে হত্যার ঘটনা। খ্রিস্টানদের গির্জায় ভাঙচুর করা হয়। সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের পাশাপাশি বসবাস রয়েছে, এমন একটি জায়গার যেকোনও পুলিস অফিসারকে জিজ্ঞাসা করে জবাব পাওয়া যায় যে, একটি শঙ্কিল-থমথমে পরিস্থিতির উপর নজরদারি করছেন তিনি।
রাহুল গান্ধী, এই মানুষটি সম্পর্কে কী বলা যায়? এই যাত্রার অভিজ্ঞতার প্রভাব রাহুল গান্ধীর উপর পড়তে পারে। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, তাঁকে বোঝার ব্যাপারে মানুষের ভাবনাতেও একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে এই ঘটনা। এমনকী, বিজেপি সদস্যরাও অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর দৃঢ়তা, সঙ্কল্প এবং শারীরিক ধকল সহ্য করার ব্যাপারটা স্বীকার করেন। বহু ব্যক্তি (যাঁরা, কংগ্রেসকে ভোট দেননি বলেই আমি জানি) আমাকে বলেছেন যে, রাহুল গান্ধীকে নতুনভাবে চিনলেন তাঁরা। আমার কাছে এটাই পরিষ্কার যে, মানুষটির বার্তা সমস্ত শ্রেণির লোকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
মানুষটি সম্মান অর্জন করেছেন। মিশনটা, সন্দেহাতীতভাবেই একটা সাফল্য। বার্তাটা ছড়িয়ে পড়েছে দূরে এবং চতুর্দিকে। এটাই ভালো, আপাতত।
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত

30th     January,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ