বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

বাজেট আসে যায়, গরিবের দিনবদল হয় না
হিমাংশু সিংহ

কাউন্টডাউন শুরু। লোকসভা ভোটের বাকি ৪০০ দিনেরও কম, আর নির্মলা সীতারামনের বাজেটের দেরি মাত্র ৭২ ঘণ্টা। তারও আগে পেশ হবে আর্থিক সমীক্ষা। কিন্তু এতটা পথ হেঁটেও আসল অসুখটা ধরা পড়ে না, চলতেই থাকে গড্ডলিকা প্রবাহ। কিংবা বলা ভালো, কেউ রোগটা ধরতেই উৎসাহী নন। তাতে যদি গদিটাই বেহাত হয়ে যায়! আমাদের দেশে রাজনীতি এবং তার দোসর নির্বাচনই, সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থ, প্রতিরক্ষা থেকে সমাজনীতি। বাজেটের যাবতীয় হইচই তৈরি করা তামাম সিদ্ধান্তও নিয়ন্ত্রিত হয় ভোটকে নজরে রেখেই। এবারই মোদি শাসনের দ্বিতীয় দফার শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। স্বভাবতই প্রত্যাশা অনেক। এই একটা দিন দেশের অর্থমন্ত্রী কত শত প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে যান দেশবাসীকে। এটা হবে, ওটা হবে। গরিবের মাথায় ছাদ, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, খাদ্য, শিক্ষা। পাকিস্তানকে জব্দ করতে সীমান্তে রাফাল। তারপর নিয়মের ধারাপাতে প্রতিদিন সূর্য ওঠে, চাঁদ উঁকি দেয়। বছর ঘুরে আবার একটা ১ ফেব্রুয়ারি আসে। কিন্তু হিসেবের খাতায় কাটাকুটি খেলেও কোনও সুরাহা পায় না গরিব মানুষ। গ্রাম থেকে শহর। কৃষি থেকে শিল্প। শহুরে গরিব থেকে প্রত্যন্ত এলাকার প্রান্তিক মানুষ, আদিবাসী, দলিত, কারও অবস্থারই পরিবর্তন হয় না। উল্টে ধনী আরও টাকার পাহাড়ে চাপে। আমির আরও চকচকে বহু কোটির গাড়িতে সওয়ার। ডানপিটে সফল শিল্পপতির স্ত্রীর জন্মদিনে নিত্যনতুন হাওয়াই জাহাজ কেনার নেশা জাগে। ঠিক ক’টা খামার বাড়ি এদিক ওদিক ছড়িয়ে, গুনতে বসে খেই হারিয়ে যায় প্রায়শই। নেতারা আবার ভোট এলেই দলবদল করে কামাই বাড়ায়। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষ সেই তিমিরেই। ভোট আসে ভোট যায়, দারিদ্র্য দূর করার প্রতিশ্রুতি ফেরি করে ক্ষমতায় বসে ধুরন্ধর রাজনীতির কারবারি। কিন্তু আসল গরিবের দিনবদল হয় না। প্রান্তিক মানুষের জন্য বরাদ্দও দালালদের হাত ঘুরে দরমার মলিন ঘরে ঢোকে যৎসামান্য! পাচার হয়ে যায় মিড ডে মিলের চালও। এটাই ভারতের সাড়ে সাত দশকের অর্থনৈতিক অভিযাত্রার বাস্তব খতিয়ান!
নরেন্দ্র মোদি এই মুহূর্তে তৃতীয়বার কুর্সিতে বসে ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন দেখছেন। নেহরুর ছবি, গান্ধী পরিবারের কীর্তি মুছে দেওয়ার সঙ্কল্পে মশগুল। তাই কে প্রধানমন্ত্রীর নামে আবাস পেল, কোন পরিযায়ী শ্রমিকটার হাঁটতে হাঁটতে প্রাণ গেল, তা নিয়ে ভাবার ফুরসত বড্ড কম। সামান্য চা ওয়ালার ব্যাটা থেকে নেহরু- গান্ধীদের ইতিহাস মুছে দেওয়ার এই সাঙ্ঘাতিক উত্তরণের পথে কাঁটা সরাতেই তিনি ব্যস্ত। সেই লক্ষ্যেই মুসলিম সংখ্যালঘুদের সঙ্গেও ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন দলকে। সংখ্যালঘু ভোট পেতে তাঁর আরও দাওয়াই, কোনও বিতর্কিত সিনেমা, শিল্পকর্ম নিয়ে অযথা মারমুখী হওয়া চলবে না হিন্দুত্ববাদীদের। খুব ভালো কথা। কিন্তু এই বিলম্বিত বোধোদয়ের পিছনেও অনুঘটক কিন্তু বিবেক নয়, সংবিধান নয়, সেই সস্তা ভোট রাজনীতি। ‘৪০০ দিন বাদে’ তৃতীয়বার কুর্সি দখলের তাগিদ। ভোটের ফল বেরিয়ে শপথপর্ব চুকে গেলেই দেখা যাবে আবার যে কে সেই। এমন আশঙ্কা কিন্তু মোটেই অমূলক নয়। তখন আবার জয় শ্রীরাম না বললেই জুটবে বেদম মার, সঙ্গে সামাজিক বয়কটও। মানুষ ঠেকে শিখবে মোদিজির হ্যাটট্রিকের সামাজিক মহিমা কী অপার!
বাজেট এলেই অর্থমন্ত্রীর ব্যস্ততা মূলত তিনটি বিষয়কে ঘিরে আবর্তিত হয়। ১. আয়কর ২. কৃষি, কৃষকের আয় ও গ্রাম এবং ৩. শিল্পকে ছাড় দিয়ে জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণ। বলা বাহুল্য, আয়কর ছাড়ের সীমা বাড়লে আদতে দেশের মাত্র ৬ থেকে ৭ শতাংশ মানুষের উপকারে লাগে। ৭৫ বছর পরেও সেটা দশ শতাংশ হল না।  ১৩৬ কোটির দেশে কর দেয় মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬.২৫ শতাংশ। বিশ্বাস না হলেও এটাই সত্যি। এদেশে এখনও মোট করদাতা মানুষের সংখ্যা ১০ কোটিও নয়।  আর দশ লক্ষ থেকে ১ কোটি পর্যন্ত আয়ের মানুষ ১ কোটিরও কম। আর এক কোটির উপর বার্ষিক আয়ের আমির মানুষের দেড় লক্ষের আশপাশে। আন্তর্জাতিক সমীক্ষা রিপোর্ট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ মাত্র ১ শতাংশ ধনীর হাতে। তাহলে আয়কর ছাড় দিয়ে কার লাভ? এপথে প্রকৃত গরিব প্রান্তিক মানুষের কোনও সুরাহা তো হয় না। একান্তভাবেই এটা মাস মাইনে পাওয়া সংগঠিত শ্রেণিকে পাইয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বাধীনতার পর ফিবছর বাজেট পেশ হয়েছে। কিন্তু ৭৫ বছর পেরিয়েও আর্থিক বৈষম্যই বেড়েছে। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষকে নিয়ে ভাবার সময় পাননি অর্থমন্ত্রীরা।
৯ বছর আগে ক্ষমতায় এসে মোদিজি কংগ্রেসের ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে তৎপর হওয়ার সঙ্গে বাইশ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার ডাকও দিয়েছিলেন। সেই বাইশ সাল আজ ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গিয়েছে। কৃষকের আয় কিন্তু দ্বিগুণ তো হয়নি, উল্টে কালা আইন এনে দিল্লির সীমানায় পাঞ্জাব হরিয়ানা সহ উত্তর ভারতের বর্ধিষ্ণু কয়েক হাজার চাষিকে এক বছরেরও বেশি এই সরকার পথে বসিয়ে ছেড়েছে। কয়েকশো বৃদ্ধ চাষি দিল্লির প্রচণ্ড ঠান্ডায় মারা গিয়েছেন। তারপরও যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁদের আন্দোলন প্রত্যাহার করানো হয়েছিল, তা আজও অপূর্ণই থেকে গিয়েছে। মানা হয়নি। অপূর্ণ থেকে গিয়েছে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইন পাশের মতো জরুরি দাবিও। মোদি সরকার যাই বলুন, দেশের কৃষক সম্প্রদায় কিন্তু মোটেই ভালো নেই। কৃষকের অবস্থা না বদলালে গ্রাম ভালো থাকতে পারে না। গ্রাম অবহেলিত থেকে গেলে দেশের সার্বিক আর্থিক অগ্রগতিও রুদ্ধ হতে বাধ্য। বিগত ৯ বছরে এটাই বাস্তব। এখন আবার একশো দিনের কাজ প্রকল্পকে পঙ্গু করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। শহরে চাকরি নেই, গ্রামে ফিরে একশো দিনের কাজও উধাও। মানুষ যাবে কোথায়? বছরে দু’কোটি চাকরি আজ শুধু সোনার নয়, তার সঙ্গে হীরে খচিত পাথরবাটি! পাঁচ ট্রিলিয়নের অর্থনীতি বলতে কটা শূন্যর ধাক্কা তা অজানা দেশের এক শতাংশ মানুষেরই। তবু খোয়াব দেখাতে নেতানেত্রীদের কী প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা।
২০১৭ সালের ১ জুলাই জিএসটি চালুর সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু গত সাড়ে পাঁচ বছরে জিএসটি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার পদে পদে ল্যাজেগোবরে। এর ফলে শুধু ব্যবসায়ীরাই নয়, মার খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। বলা হয়েছিল, প্রথমটায় অসুবিধা হলেও এরফলে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা আখেরে লাভবান হবেন। কিন্তু বাস্তবে জটিলতা বেড়েই চলেছে। একজন ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীকে এর পরিকাঠামো তৈরি করতেই বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। কিন্তু কিছুই সরল হচ্ছে না, জিনিসের দামও কমছে না। জিএসটি চালুর আগেই নোট বাতিল করে ব্যবসায়ী সমাজের কোমর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেই ঘা আজও সারেনি। উল্টে বৈদেশিক বাজারে পেট্রল ডিজেলের দাম কমলেও তার সুফল এদেশের মানুষের কাছে পৌঁছয়নি। পেট্রল ডিজেলের এই বর্ধিত মূল্য থেকে সরকারের মোটা টাকা মুনাফা হয়েছে। কিন্তু তার ধাক্কায় জিনিসের দাম গরিবের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে মোদি সরকারের স্বপ্নের উজ্জ্বলা গ্যাস প্রকল্প। অত দাম দিয়ে রান্নার গ্যাস কেনার চেয়ে গ্রামের মহিলারা আবার কাঠখড় পুড়িয়ে রান্নার পথেই ফিরে গিয়েছেন।
মূল্যবৃদ্ধি ও পাল্লা দিয়ে বেকারত্ব, এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। মানুষের রোজগার কমছে। বেকার চাকরি পাচ্ছে না। অথচ জিনিসের দাম প্রতিদিন বাড়ন্ত। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অসহায়। শুধু সুদ বাড়িয়েই ক্ষান্ত। এতকিছুর পড়েও শিল্পের গতি, বিশেষত উৎপাদন শিল্পের অগ্রগতিও মোটেই আশানুরূপ নয়। সাত বছর আগে নোট বাতিল করে সরকার এদেশের উদ্যোগপতিদের কোমর সেই যে ভেঙে দিয়েছেন, তা আর জোড়া লাগেনি। জাল  নোটের কারবারি, কালো টাকার রাঘববোয়ালদের মেরুদণ্ড ভাঙেনি, ক্ষতিও হয়নি। উল্টে আজ তাদের রমরমা আরও বেড়েছে। সরকারের অদ্ভুত ফরমানে প্রাণ গিয়েছে শুধু ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের। সেই মৃত্যুকে আরও ত্বরান্বিত করেছে দু’বছরের কোভিড পরিস্থিতি ও লকডাউন। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোনও সুযোগও পায়নি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা। আর  মোদিজির সাধের মেক ইন ইন্ডিয়া? অরুণাচল ও লাদাখ সীমান্তে চীনকে আপাতত রোখা গেলেও ভারতীয় বাজার দখল কিন্তু বন্ধ করা যায়নি। মোবাইল, ব্লুটুথ স্পিকার থেকে শুরু করে রকমারি আলো আর খেলনার বাজার, সব আজ চীনের দখলে। নানা ফরমান, নিষেধাজ্ঞাতেও কাজ হয়নি।
মোদি সরকার এসেই আলাদা করে রেল বাজেটের রীতি তুলে দিয়েছে। ব্যয় কমাতেই নাকি এই ব্যবস্থা। খুব ভালো কথা। কিন্তু টিকিটের দাম না বাড়ালেও ঘুরপথে কিন্তু যাত্রীদের উপর কোপ পড়ছেই। অধিকাংশ ট্রেনকেই সুপারফাস্ট তকমা দিয়ে যেমন টিকিট মূল্য বাড়ানো হয়েছে, তেমনি স্পেশাল ট্রেনের নামেও বেশি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। ইদানীং আবার বন্দে ভারতের নামে নতুন তামাশা শুরু হয়েছে। এখন চলছে মাত্র আটটি, কিন্তু টার্গেট ৫০০টি। নিঃসন্দেহে রেল বেসরকারিকরণেরই এটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এমনও শোনা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে রাজধানী ও দুরন্তর মতো কুলীন ট্রেন তুলে দিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে জায়গা করে নেবে বন্দে ভারত। এভাবেই ঘুরপথে দূরপাল্লার ট্রেনের টিকিটের দামবৃদ্ধির পথেও হাঁটছে সরকার। রেলেরই তথ্য বলছে, ৪১ হাজার কোটি বাড়তি আয় হয়েছে, কিন্তু প্রবীণ সহ রেল যাত্রীদের একগুচ্ছ কনসেশন ফেরেনি। থমকে গিয়েছে বিলগ্নিকরণও।
আসলে সবই ফক্কা। কিন্তু তবু স্নো-পাউডার বুলিয়ে একটা ভোট জেতার মতো পটভূমি তো তৈরি করতেই হবে। কঠিন পরীক্ষা অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের। যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। গরিব থেকে কর্পোরেট সবার জন্য একটা ছদ্ম খুশির বাতাবরণ তৈরি করতে না পারলে যে ম্যাচটাই ফস্কে যাবে। তাই আর্থিক ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রেখে এবার মানুষের চোখে ‘ধুলো’ দেওয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জ অর্থমন্ত্রীর।

29th     January,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ