বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ন্তা শাসক নয়, জনগণই
মৃণালকান্তি দাস

ভারতের ইতিহাস পুনর্লিখন হবে! বিশেষ করে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিবৃত্ত। দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার পক্ষে সেটা নাকি বিশেষ জরুরি। এমনই নির্দেশ এসেছে দেশের শাসক দলের কাছ থেকে।
সঙ্ঘ পরিবারের তরফ থেকে এই প্রস্তাব অবশ্য নতুন নয়। তাঁরা শেখাতে চায়, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সারির নেতার নাম বিনায়ক দামোদর সাভারকর এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। আর হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, জনসঙ্ঘ ও ভারতীয় জনতা পার্টি হল আসল ন্যাশনালিজম-এর প্রবক্তা। ইতিহাস শিখিয়েছে, আমরা পরাধীন হয়েছি ১৭৫৭ সালে। সঙ্ঘ বলে, আমরা পরাধীন হয়েছি তার ঢের আগে। পাঠান-মোঘলদের হাতে। সঙ্ঘের কাছে ব্রিটিশের অধীনতাটা পরাধীনতা নয়, বরং মুসলিম অপশাসনের হাত থেকে মুক্তি। এ সব ভাবনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বাজপেয়ি-আদবানি জমানাতেই। মোদি জমানায় তা উৎকট চেহারা নিয়েছে। সেখানে জনসাধারণের ভাবনা, যুক্তিবোধের কোনও মূল্য নেই। আছে শুধু দেশবাসীর উপর শাসকের ভাবনা চাপিয়ে দেওয়ার ছল-কৌশল!
ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে পূর্ণ স্বরাজের ডাক দিয়ে যাত্রাপথের শুরু হয়েছিল ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি। স্বাধীনতা দিবসের তকমাও পেয়েছিল সেই দিনটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসনের শেকল ভেঙে ভারত যখন সত্যিই স্বাধীনতার মুখ দেখল— দিনটি ঘটনাচক্রে দাঁড়াল ১৫ আগস্ট। ফলে ২৬ জানুয়ারির অভিধাও ক্রমে পাল্টাল। আড়াই বছর পর ১৯৫০ সালে দেশের প্রথম সংবিধান কার্যকর করার সূত্রে বেছে নেওয়া হয়েছিল ঐতিহাসিক মাহাত্ম্যে পূর্ণ ২৬ জানুয়ারি দিনটিকেই। সেই থেকে বিংশ শতকের ভারতে যেদিনটি ছিল স্বাধীনতা দিবসের প্রথম দাবিদার, সেই ২৬ জানুয়ারির পরিচয় ভারতীয় জনসাধারণের কাছে দাঁড়াল: সাধারণতন্ত্র দিবস।
পরাধীনতার দীর্ঘ অধ্যায় পেরিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচার স্বপ্ন বাস্তব হয়ে উঠেছিল সেই দিন। শুরু হয়েছিল আমাদের গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা। এক নতুন লক্ষ্যের কথা ভেবেই ভারতীয় নাগরিকদের জন্য কাজ করেছিলেন সংবিধান প্রণেতারা। বিবিধের মাঝে মহান মিলনের লক্ষ্যে যাত্রাই ছিল তাঁদের স্বপ্ন। ভারতীয় সংবিধানের উপক্রমণিকায় জানানো হয়েছিল, ‘উই, দ্য পিপ্‌ল অব ইন্ডিয়া’। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নয়, এই সংবিধান ভারতের নাগরিকরা নিজেদের জন্য রচনা করেছিলেন। এই স্বাধীনতা, এই সাধারণতন্ত্র আমাদের প্রত্যেকের। সাধারণের জন্য সাধারণের তৈরি শাসনব্যবস্থা। ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের 
এই রাজার রাজত্বে’। সংবিধান নাগরিকদের সেই অধিকার দিয়েছিল।
স্বামী বিবেকানন্দের মতে, স্বাধীনতাই উন্নতির প্রথম শর্ত। যেমন মানুষের চিন্তা ও কথা বলার স্বাধীনতা রয়েছে, তেমনই তার আহার, পোশাক ও অন্য সব বিষয়েই স্বাধীনতার প্রয়োজন। স্বাধীনতা ইট-কাঠ-পাথর নয়, স্বাধীনতা একটা জীবন দর্শন, একটা বাঁচার ভঙ্গিমা। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, সেই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আমরা কি আদৌ পেয়েছি? নাকি তার থেকে ক্রমশ দূর থেকে দূরতর বিন্দুতে সরে যাচ্ছি। ব্যবহারিক রাজনীতিতে ৭৩ বছরের সংবিধানটিকে আজ ক্রমশই যেন দুর্বল, মলিন দেখাতে শুরু করেছে। প্রশ্ন ওঠা শুরু করেছে, স্বাধীনতা মানে কি শুধু সংখ্যাগুরুর ধর্মাচরণেরই স্বাধীনতা? ভারতীয় রাজনীতিতে যাঁরা বর্তমান শিরোনেতা, তাঁদের কাছে সাংবিধানিক নৈতিকতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকা যে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেটা ইতিমধ্যে যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সত্তরের দশকে জরুরি অবস্থার সময়ে যেমন ভারতীয় গণতন্ত্র ও তার প্রতিষ্ঠানগুলির উপর ‘সরাসরি’ আক্রমণ নেমে এসেছিল, এখনকার পরিস্থিতি সে রকম নয়। এখন যেটা হচ্ছে, তাকে বরং আমরা বলতে পারি সংবিধানের উপর ‘সহস্র কোপ’। 
ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, যদি দেখা যায় সরকার পক্ষ জনগণের দাবিকে উপেক্ষা করে, দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোনও আইন চাপিয়ে দিচ্ছে তখনই বিঘ্নিত হয় রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো। অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে সংগঠিত একনায়কতন্ত্র বা দলতন্ত্রের উত্থান। এই কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয় রাষ্ট্রের সব ধরনের কর্তৃত্ব। ঠিক এভাবেই ইতালিতে মুসোলিনি ও জার্মানিতে হিটলারের উত্থান হয়েছিল। প্রথম জীবনে হিটলারও একজন জনপ্রতিনিধি ছিলেন। ১৯৩২ সালে জার্মান সংসদ নির্বাচনে নাৎসি পার্টি গোটা দেশে একক বৃহত্তম দল হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। বহুদলীয় সরকার তৈরি হলেও মতভেদের জেরে তার পতন হয়। পুনঃনির্বাচনেও নাৎসিরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। এই অবস্থায় জার্মান সংসদ একটি বিশেষ আইন (এনাবলিং অ্যাক্ট) পাশ করে। পরে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গকে প্ররোচিত করে হিটলারকে চ্যান্সেলর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৩৪ সালে হিন্ডেনবার্গের মৃত্যু হলে হিটলার সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিজেকে ‘ফ্যুয়েরার’ ঘোষণা করেন।
রাষ্ট্রগবেষকদের অভিমত, ভারতে আজ কর্তৃত্ববাদ, সংখ্যাগুরুবাদ, জনপ্রিয়তাবাদ ইত্যাদি সব মিলেমিশে ভারতীয় সাধারণতন্ত্র এবং তার সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে বিপদগ্রস্ত করতে শুরু করেছে। বাক্‌স্বাধীনতা, সাম্যের অধিকার ইত্যাদি সংবিধান-স্বীকৃত বেশ কিছু মৌলিক অধিকারকে ইতিমধ্যেই এমন ভাবে সঙ্কীর্ণ কিংবা লুপ্ত করা হয়েছে, যা এই দেশ আগে কখনও দেখেনি। ইন্দিরা গান্ধীর ‘ইমার্জেন্সি’ ছিল সরাসরি ঘোষিত জরুরি অবস্থা, লুকোছাপা ছিল না। আজকের জরুরি অবস্থা হল সংবিধান-বিরুদ্ধ গুপ্ত ইমার্জেন্সি। এর মূলমন্ত্র জোর নয়, এর মন্ত্র প্রতারণা। তার চেয়েও বড় বিপদ হল এই ইমার্জেন্সি শুধু রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নয়, সমাজ-রূপান্তরও এর অন্যতম লক্ষ্য। নতুন রাষ্ট্রের সামাজিক ভিত্তি হবে এক ত্রিকোণ শক্তি— হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান। ৭৩ বছর পর আজ পিছন ফিরে তাকাতে গিয়ে মনে হচ্ছে, যে মন্ত্রের মূলে ছিল বহু স্বরের সৌহাদ্যপূর্ণ সহাবস্থান, সেই মন্ত্রোচ্চারণ এখন অস্পষ্ট। বিবিধতার চর্চায় যে সযত্ন প্রয়াস থাকা দরকার, তাতে ফাঁকি দিয়েছি আমরা। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সমাজ-পরিসর হয়ে এখন ব্যক্তিমানসেও অসহিষ্ণুতার ছাপ পড়ছে। দেশের বদলে দ্বেষের মন্ত্রে দীক্ষার কাজ চলছে এখন। পরমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা, তীব্র ঘৃণা 
এবং বিবাদের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পথে আমরা ক্রমাগত ভেঙে যাচ্ছি— এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন, তিন থেকে অজস্র। সাভারকর-গোলওয়ালকর-শ্যামাপ্রসাদের রোপণ করে যাওয়া ‘বিষবৃক্ষের’ বীজ থেকে আজ স্বাধীন ভারতের ফুটিফাটা দেওয়ালে যত্রতত্র গাছ গজাচ্ছে, দেওয়াল ভাঙল বলে...।
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? ধর্ম বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকা। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক যাতে তাঁদের পছন্দমতো ধর্ম পালন করতে পারেন তা দেখা। রাষ্ট্র পাহারাদার। কিন্তু মোদি জমানায় আমরা দেখতে পাচ্ছি ঠিক বিপরীতটাই। রাষ্ট্র যেন সমস্ত ধর্মের বা কোনও কোনও ধর্মের ঠিকাদারি নিয়েছে। কোনও ক্ষেত্রে কোনও বিশেষ ধর্মের, আবার কোনও ক্ষেত্রে অনেকগুলি ধর্মের ঠিকাদার। যে রাষ্ট্রের পাহারাদার হওয়ার কথা ছিল, সে হল ঠিকাদার। ধর্মের ভিন্নতা এবং মানুষের দিগ্‌দর্শনহীনতাকে কাজে লাগিয়ে শুধুমাত্র শক্তি মুঠোয় রাখতে রাজনৈতিক নেতারা চাল দেন, তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কথা না ভেবেই। মানুষ দিশাহারা, বিভ্রান্ত হয়ে ফাঁদে পা দেয়। তার সঙ্গে মিশে থাকে আগ্রাসী শক্তির উস্কানি।
এককোণে পড়ে থাকে তিনটি মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান। পড়ে থাকে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য। সাধারণতন্ত্র দিবসের হরেকরকম লোভনীয় ছাড়ের জাঁকজমকের আড়ালে সেই একই জং-ধরা গড়িয়ে-গড়িয়ে চলা নিরাপত্তাহীনতা! অপুষ্ট, অশিক্ষিত, নির্যাতনের শিকার দরিদ্র দেশবাসীর সেই অন্তহীন লড়াই। কর্মসংস্থানের বিবিধ সরণি উন্মুক্ত হলেও স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়েই পড়ে থাকল দেশের 
অজস্র মানুষ— কর্মহীন, খাদ্যবস্ত্রহীন। নারী নিরাপত্তা, দুর্নীতি রোধ ইত্যাদি প্রশ্নে লড়াই ফুরায় না সাধারণ মানুষের। শুধু শাসকের রং বদলায়, নীতি বদলায়, কিন্তু দিন বদলায় না!
আজও দিন-আনা দিন-খাওয়া ভারতবাসীর আতঙ্কিত প্রশ্ন— ‘কতবার ভিটে হারাব আর? কোথায় যাব?’ অথচ, আমরা শিখেছি, ভারত মানে অখণ্ড এক চেতনায় বাঁধা কোটি কোটি নাগরিকের একাত্মতা। ঠিক কতটুকু সহিষ্ণুতা আর কতটুকু স্বাধীনতার সীমা টপকে গেলে আচরণ উগ্রতায় রূপান্তরিত হতে পারে, এই সূক্ষ্ম ভেদাভেদটুকু জানা খুবই জরুরি। যাঁদের যাবতীয় প্রাপ্তি, প্রত্যাশা, হতাশা এই ভূখণ্ড ঘিরেই, সংবিধানের প্রতিটি শব্দ তাঁদের জীবনমন্ত্র হতে পারে। আমাদের স্বাধীনতার গণতান্ত্রিক চেতনা এগিয়েছে, নানা তাত্ত্বিকের হাত ধরে নয়, বরং নানা বিদ্রোহ ও সংগ্রামের পথ ধরে। এই কারণেই ভারতীয় গণতন্ত্রের চরিত্র নির্ধারণ করতে গিয়ে লেখক ভি এস নইপল একসময় বলেছিলেন, ‘আ মিলিয়ন মিউটিনিজ নাও’। ভারতের যে কোনও সময় যেন লক্ষ লক্ষ বিদ্রোহের সমষ্টি।
ভারতীয় গণতন্ত্র শুধুমাত্র ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার যন্ত্রমাত্র নয়। ভারতীয় গণতন্ত্রের একটি বিশিষ্ট চরিত্র আছে। এটি বহুস্বরের গণতন্ত্র। আমাদের স্বাধীনতা বহুস্বর বজায় রাখার স্বাধীনতা। দেশের অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা খর্ব করে ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবে কি না, সে কথার উত্তর দেবে ভারতের ‘সাধারণ’ জনগণ। ভারতের ভবিষ্যতের নিয়ন্তা তাঁরাই। শাসককে তাঁদের কাছে জবাবদিহি করতেই হবে। 
গণতন্ত্রে শাসক কখনওই ‘রাজা’ নন, আর তাই প্রশ্নাতীতও নন!

26th     January,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ