বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

প্রত্যাশা যে আপনারই কাছে
শান্তনু দত্তগুপ্ত

শ্রদ্ধেয় মোদিজি,
সাধারণতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে আপনাকে কোটি কোটি সেলাম। এই বছর দশেক আগেও ভারতবর্ষের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ব্যক্তি ছিলেন শচীন তেন্ডুলকর। মাঝে সানি লিওনিকে নিয়েও গোপনে-সঙ্গোপনে প্রচুর চর্চা হয়েছে, গুগল বাবাজীবন তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে বিরক্তও হয়েছে। কিন্তু সেগুলি নিতান্তই বালখিল্য ব্যাপার। আলগোছে হাওয়ার মতো এসেছে, হারিয়েও গিয়েছে। কিন্তু গত ন’বছরে আমাদের দেশে আলোচনায় থেকে গিয়েছে একটিই নাম—আপনার। ওই যে কথায় বলে না, শয়নে-স্বপনে-জাগরণে... আপনি তার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এই দেশবাসী না চাহিলেও আপনারে ভুলতে পারে না। আপনার কর্মকাণ্ডই যে এত বিস্তৃত! ঘুম থেকে উঠে বাজারের থলি হাতে বেরতে গিয়েই পকেট হাতড়াতে হয়... এই টাকায় হবে তো? আরও লাগলে কোথায় পাব? ১০ বছরের মেয়েটা স্কুলের জন্য নতুন জুতো চাইলে বলতে হয়, এমাসে হবে না মা, সামনের মাসে চেষ্টা করে দেখব। ডাক্তার দেখাতে গেলে কনসাল্টেশন ফিজ যা লাগে, ওষুধের দাম তার তিনগুণ। আর এসবের নিত্যসঙ্গী মোক্ষম এক দুশ্চিন্তা... চাকরিটা থাকবে তো? রুটিন শুনেই বুঝতে পারছেন, এরা হল গিয়ে মধ্যবিত্ত। কম কামাবে, বেশি ট্যাক্স দেবে, আর প্রচুর অভিযোগ করবে। কী মুশকিল বলুন তো! আপনার কতই না কাজ, তার মাঝে বারবার এরা কি না আপনার নামে দু’গাল ভাত কম খায়, আর বেশিবেশি নিন্দা করে! দিনে যে কতবার আপনাকে বিষম খেতে হয়, আমরা বিলক্ষণ বুঝতে পারি। কিন্তু কীই বা করা যায় বলুন, প্রধানমন্ত্রী আপনি... দেশের মাইবাপ। এটুকু বোধহয় আপনাকে শুনতেই হবে। কারণ আপনার প্রতি প্রত্যাশাটাই যে এই শ্রেণির বড্ড বেশি! 
দর্শনশাস্ত্রে প্রত্যাশা শব্দের সংজ্ঞা বলা হয়েছে, ‘কোনও কর্মকাণ্ডের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সম্পর্কে তীব্র বিশ্বাস’। এখানেই একটু গোল বাধে। প্রত্যাশা আর বিশ্বাস কি এক জিনিস? আমরা আপনার কাছে আশা করি, আপনি কোনও না কোনওদিন আমাদের সবার অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে ফেলে দেবেন। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, এই কাজটা আপনি কখনও করবেন না। দু’টো কীভাবে এক হয়? তাও পণ্ডিত ব্যক্তিরা যখন বলে গিয়েছেন, নিশ্চয়ই কোনও না কোনও কানেকশন আছে। তাঁরা আরও বলেছেন, প্রত্যাশাই আমাদের বাস্তবের দিশা নির্ণয় করে। আমাদের চারপাশে যারা আছে, তাদের জীবনেও এই প্রত্যাশার প্রভাব পড়ে। 
নিম্নবিত্ত যারা খেটে যাওয়া মানুষ, দু’বেলা পেট পুরে খাওয়ার বেশি প্রত্যাশা তাদের সাধারণত থাকে না। মূলত এরা অসংগঠিত ক্ষেত্র। নির্মাণকাজ বা অন্যান্য শিল্প গতি পেলে এদের হাতে খানিক কাজকর্ম আসে। গ্রাম ছেড়ে তারা শহরে যায়, কাজ করে, টাকা জমায়, আবার ফিরে আসে গ্রামে। কিন্তু আপনার এই জমানায় শিল্পের হাল কেমন? গত ত্রৈমাসিকের হিসেব বলছে, উৎপাদন ক্ষেত্রের বৃদ্ধি ধাক্কা খেয়ে ৬.৩ শতাংশে নেমে গিয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া বাকি জিনিসপত্রের চাহিদা কমেছে। আর চাহিদা না থাকলে সংস্থাগুলি যে উৎপাদন বাড়াবে না, সেটাই স্বাভাবিক। ফলে কাজ হারাচ্ছে অসংগঠিত ক্ষেত্র। একই অবস্থা গ্রামীণ অর্থনীতিতে। এই সেক্টরের সবচেয়ে বড় উপার্জনের জায়গা ১০০ দিনের কাজ। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আপনার সরকার নানা অছিলায় টাকা আটকে রাখছে। ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষ... যাঁদের খাওয়া পরা এই প্রকল্পের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল, তারা পড়েছে আতান্তরে। 
অর্থাৎ, আপনার কাছে প্রথম এবং প্রধান প্রত্যাশা দু’টি—কর্মসংস্থান এবং মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম। এই দুইয়ের সঙ্গেই যে জীবনের অ আ থেকে চন্দ্রবিন্দু জুড়ে আছে। বলতে দ্বিধা হয়, এই দুই সমস্যা তো গত কয়েক বছরে ভারতবাসীর কাছে জলভাত হয়ে গিয়েছে। তারপরও আপনার সরকার কি সাধারণ মানুষের সুরাহার জন্য কিছু ভেবেছে? হয়তো ভেবেছে। আমরাই দেখতে পাচ্ছি না। তাই আশা করছি, এবার আপনি আমাদের সেই সুরাহার চাবিকাঠি দেখানোর জন্য কিছু না কিছু করবেন। আপনি বলবেন নানাবিধ প্যাকেজের কথা। আমরা বলব, ঋণসর্বস্ব। বরং ইএমআইয়ের বোঝা ভারী হয়েছে। কারণ, সাধারণ মানুষের হাতে টাকার জোগান বাড়েনি। দেশের যে চার-পাঁচ শতাংশ মানুষ আয়কর দেয়, তারা হাপিত্যেশ করবে... অস্থির হয়ে উঠবে। দুর্নীতি তাদের দিয়ে হয় না। নিজের পেট কেটেই তারা আপনার রাজকোষ ভরবে। আর আপনি ছাড় বাড়িয়ে যাবেন কর্পোরেটের। মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী কিন্তু বার্ষিক সাড়ে ৭ লক্ষ টাকা আয়ের গণ্ডি পেরলে ২০ শতাংশ, আর ১০ লক্ষ পার করলে ৩০ শতাংশ আয়কর দেবে। খুব ন্যায়সঙ্গত কি? 
আপনি বলবেন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র কথা। ব্যবসাই নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। শুরু তো করেছিলেন। কিন্তু তাতে কি কোনও নির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ প্ল্যানিং ছিল? না, ছিল না। তাই একটার পর একটা প্রজেক্ট শুরু হয়েছে, আর থমকে গিয়েছে। কারণ, মার্কেটের চাহিদা ও সরবরাহের বেসিক ফর্মুলার সঙ্গে তার কোনও সামঞ্জস্য ছিল না। ভরসা ছিল বিদেশি বিনিয়োগে। সেটাও বাস্তবে খুব একটা কার্যকর হয়নি। আপনার সরকার ভেবেছিল, উৎপাদন ক্ষেত্রকে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ গ্রোথ দেবে মেক ইন ইন্ডিয়া। ভাবনাটা সদ্যোজাতকে ক্লাস এইটের অঙ্ক করতে দেওয়ার মতো। ফল যা হওয়ার, সেটাই হয়েছে। এখনও আমরা ধুঁকতে থাকা শিল্প এবং অর্থনীতিকে ভেন্টিলেশন থেকে বের করে আনার উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। সরকারি সূচকে খুচরো বা পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার কমছে। কিন্তু মানুষের জীবনে তার কোনও প্রভাব নেই। পেট্রল-ডিজেলের দামও গত আট মাস ধরে পাহাড়চূড়ায় উঠে বসে আছে। আর আপনার মন্ত্রীরা কী বলছেন? তেল কোম্পানিগুলি তাদের লোকসান সামলে নেওয়ার পরই দাম কমবে জ্বালানির। কেমন সেই লোকসান? মানুষের কথা ভেবে নাকি কোম্পানিগুলিকে গত কয়েক মাসে দাম বাড়াতে দেওয়া হয়নি। এখন তাদেরটাও তো দেখতে হবে নাকি! তাই তারা এই মুহূর্তে লোকসান ‘পূরণ’ করছে। এই কাজটা মিটে গেলেই কমবে জ্বালানির দাম। আর কবে মিটবে লোকসান? লোকসভা ভোটের আগে? তখন তারা দাম কমাবে, আর তার প্রভাব পড়বে ভোটের যন্ত্রে? আপনার আন্তরিকতা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু পাবলিক যে এইসব কথা বলছে! তাদের ঠেকাব কীভাবে? তারা খোঁচা দিচ্ছে, বিজেপি সরকার নাকি ভোটের জন্য অপেক্ষা করছে। সঠিক সময়ে দাম কমাবে জ্বালানির। তখন মূল্যবৃদ্ধিও লাগাম পরে অনুগত চাকরের মতো গেরুয়া বাহিনীর সামনে বসে যাবে। বাজার চাঙ্গা হবে। সরকারি চাকরি পাওয়া যাবে। ততদিন আমরা ধুঁকব, মাসের শুরুতে হিসেব কষব... এবার কত টাকা ধার করতে হবে। দু’বেলা খাবার, মাথার উপর ছাদ, একটু শান্তি, সামান্য আরাম। এগুলো তো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি নয়! প্রতিদিনের অধিকার। এর জন্য আম আদমিকে ভোটের জন্য অপেক্ষা করতে হবে কেন? এটা কি সরকারের নিত্যকাজ নয়? ভগবদ্‌গীতায় কর্ম এবং অকর্মের প্রসঙ্গ রয়েছে। অকর্মের মানে কী? খারাপ কাজ? না, গীতা কিন্তু বলছে অকর্ম মানে কর্মশূন্যতা। কিছু না করে বসে থাকা। আপনার সরকার সেই পথেরই পথিক নয় তো? কাজ করলে ভুল হয়, কিন্তু না করলে? ভুলের সম্ভাবনাই নেই! আপনার লোকজন তাই কাজ কম, কথা বেশি বলে। কথায় তো আর ট্যাক্স বসে না! খুব বেশি হলে আপনি বছরে একবার কর্মসমিতির কোনও সভায় একটু ধমক দেবেন, ‘অবান্তর কথা বলবেন না। মানুষের কাছে যান। কাজ করুন।’ ব্যস, ওখানেই শেষ। কোন সিনেমার ট্রেলার বেরল, সেই নিয়ে আপনার নেতা-মন্ত্রীদের কতই না মাথাব্যথা! হিন্দুশাস্ত্র, সংস্কৃতি নাকি শেষ হয়ে গেল। হিন্দুত্ব তাঁদের গরিমা, হিন্দুত্বের তাসই তাদের ভোটের ভরসা। একবার তাঁদের প্রশ্ন করে দেখতে পারেন, কোন গ্রন্থকে এই দেশে হিন্দুশাস্ত্রের আধার বলে মানা হয়? তাঁরা বলতে পারলে আপনার অনেক সুবিধা হতো। কিন্তু অনেকেই ‘মনুসংহিতা’র কথা মাথা খুঁড়েও বের করতে পারবেন না। এই ‘মনুসংহিতা’র এক দারুণ ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। লিখেছিলেন, ‘মনুতে আছে যে, যুদ্ধকালে শত্রুসেনা যে তড়াগপুষ্করিণ্যাদির জলে স্নান পানাদি করে, তাহা নষ্ট করিবে। যে হিন্দুধর্ম্মে তৃষিতকে এক গন্ডুষ জলদানের অপেক্ষা আর পুণ্য নাই বলে, সেই হিন্দুধর্ম্মেরই এই গ্রন্থে বলিতেছে যে, সহস্র সহস্র লোককে জলপিপাসাপীড়িত করিয়া প্রাণে মারিবে। এটা কি হিন্দুধর্ম্ম? যদি হয়, তবে এরূপ নৃশংস ধর্ম্মের পুনর্জ্জীবনে কি ফল? বস্তুতঃ এ হিন্দুধর্ম্ম নহে, যুদ্ধনীতি মাত্র,—কি উপায়ে যুদ্ধে জয়লাভ করিতে পারা যায়, তদ্বিষয়ক উপদেশ।’ এখনকার পরিস্থিতি দেখে ভয় হয়, আপনার সৈনিকরাও কি যুদ্ধজয়ে নেমেছে? যেনতেনপ্রকারেণ হারাতে হবে বিরোধীদের, সমাজকে, ঐক্যবদ্ধ ভারতকে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে। 
১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। ভারতের প্রথম সাধারণতন্ত্র দিবস। ওই দিনটিতে গৃহীত হয়েছিল সংবিধান—আমাদের গণতন্ত্রের ভিত। ভাষণে সেদিন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেছিলেন, ‘আমাদের গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ন্যায়, স্বতন্ত্রতা ও ঐক্য নিশ্চিত করা। এই বিশাল দেশের প্রত্যেক সীমান্তে বসবাসকারী মানুষের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী, ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে সদ্ভাব রাখা।’ এটাই তো ভারতবর্ষ! ধর্ম নয়, রং নয়, বিভাজন নয়... শুধুই ভারত। ‘তুমি বিদ্যা তুমি ধর্ম্ম/তুমি হৃদি তুমি মর্ম্ম/
ত্বং হি প্রাণাঃ শরীরে’... আমাদের জাতীয় গীত, আমাদের শিক্ষা—হিন্দু-মুসলিম নয়, ভারতীয় হওয়ার। মোদিজি, আমরা নিশ্চিত, ‘পথভোলা’ 
দলীয় কর্মীদের ভারতের চিরন্তন শিক্ষায় ফিরিয়ে আনতে পারবেন আপনিই। আপনার কাছে আমাদের এটাই যে শেষ প্রত্যাশা।

24th     January,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ