‘আমরা এখানে প্রশংসা শুনতে আসিনি। মানুষের সমস্যা ও অভাব অভিযোগ শুনে তার সমাধান করতে চাই। এটাই আমাদের এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য।’ কথাটা মেদিনীপুরের অভিনেত্রী বিধায়ক জুন মালিয়ার। ‘দিদির দূত’ হয়ে তিনি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার গোকুলপুর পঞ্চায়েতের কাজিপাটনা গ্রামে গিয়েছিলেন। গ্রামের মহিলারা তাঁকে ঘিরে ভাঙা রাস্তা সারানোর দাবি জানান। কারও কারও গলার স্বর ছিল একটু চড়া। কিন্তু তাতে একটুও বিব্রত হননি জুন। উল্টে গ্রামবাসীদের দাবিকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘সত্যিই রাস্তাটা খুব খারাপ। সারানো দরকার। সেকথা যথাস্থানে জানাব।’ যাঁরা বিক্ষোভ জমানোর আশায় ভিড় করেছিলেন তাঁরা একে অন্যের মুখ চাওয়াচায়ি করে চুপ হয়ে গেলেন।
তৃণমূলের যুবনেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’-এর হাল দেখতে গিয়েছিলেন দুবরাজপুরে। বিধানসভা ভোটে দুবরাজপুরে জয়ী হয়েছে বিজেপি। এলাকায় যেতেই এক মহিলার অভিযোগ, বারবার আবেদন করেও স্বাস্থ্যসাথী কার্ড পাননি। কারণ
তিনি একা। যুবনেতা বলেন, ‘এই সমস্যা দিদির কাছেও পৌঁছেছে। সংসারে কেউ একা থাকলেও এবার পাবেন স্বাস্থ্যসাথী কার্ড। জারি হয়েছে সেই নির্দেশিকাও।’ কথা শেষ হতেই মহিলার একমুখ হাসি। হাসলেন দেবাংশুও।
তবে, সেই হাসি স্থায়ী হল না। কারণ দুই মহিলা তাঁদের বাড়ি দেখানোর জন্য যুবনেতার হাত ধরে টানাটানি শুরু করলেন। তাঁদের মাটির বাড়ি, তবুও আবাস যোজনার টাকা পাননি। ‘দিদির দূত’ দুই কাকিমাকে কার্যত বগলদাবা করে পৌঁছে গেলেন তাঁদের মাটির বাড়িতে। আবাস প্রকল্পের ফিট ক্যান্ডিডেট। সেকথা স্বীকার করে যুবনেতা বলেন, ‘আপনাদের এই সমস্যা দেখার জন্যই তো দিদি আমাদের পাঠিয়েছেন। পরের দফায় নিশ্চয়ই পাবেন।’ ‘দিদি’র কথা শুনে মহিলারা চুপ। বরফ গলায় সাহসী হন দেবাংশু। জানতে চান, দিদির লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা, বিনাপয়সায় রেশন পাচ্ছেন তো? উত্তরে হাসিমুখে ঘাড় নাড়েন দু’জনেই।
সিউড়ি বিধানসভার চিনপাই পঞ্চায়েতের আলিপুরে গিয়েছিলেন বিধায়ক বিকাশ রায়চৌধুরী। একই সঙ্গে তিনি বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতিও। গ্রামে পানীয় জলের সমস্যা অনেক দিনের। তাই এলাকার লোকজন তাঁকে ঘিরে জলের দাবি জানালেন। সেই দাবিতে ছিল চড়া সুর। তবে বিকাশবাবু পরিস্থিতি সামলালেন ঠান্ডামাথায়। বললেন, ‘আপনারা জেলা পরিষদে একটা আবেদনপত্র জমা দিন। ১০ দিনের মধ্যে কাজ শুরু করব।’ সেকথা বলা মাত্র যাঁরা তাঁকে ঘিরে ধরেছিলেন, তাঁরাই বিকাশবাবুর হাত ধরে জিন্দাবাদ বলতে বলতে গ্রামে নিয়ে গেলেন।
অধিকাংশ ‘দিদির দূতে’র অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম। প্রথমেই শুনতে হচ্ছে আবাস যোজনার ঘর দেওয়ার ও ভাঙা রাস্তা সারানোর দাবি। তা নিয়ে কোথাও কোথাও কথায় কথা বাড়ছে। কিন্তু তাকে বিক্ষোভ ভাবাটা ভুল। বরং বলা ভালো, এটা জনগণের ‘চার্টাড অব ডিমান্ড’। জনপ্রতিনিধিদের কাছে জনগণের ‘দাবি সনদ’। সেই দাবির তালিকা দীর্ঘ হলেও রাজ্যের শাসক দল ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্কে’র নোটিস ঝুলিয়ে দেয়নি। উল্টে দিদির দূতরা প্রতিদিন নতুন নতুন জায়গায় যাচ্ছেন এবং মানুষের কথা শুনছেন। এর ফলে রাজনীতির পাতায় সংযোজিত হচ্ছে আর এক ‘নতুন অধ্যায়’।
আগে ভোটের সময় নেতারা মানুষের দরজায় যেতেন। দিতেন প্রচুর প্রতিশ্রুতিও। তারপর ভোট মিটলেই তাঁদের টিকি দেখা যেত না। নেতাদের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই রাজনীতিতে জন্ম নিয়েছিল একটি শব্দবন্ধ ‘ভোটপাখি’। ভোটের আগে এই সব পাখির কিচির-মিচিরে কান পাতা দায়। কিন্তু ভোট মিটলেই ফুড়ুত। এই সব নেতার জন্যই একদা জনপ্রিয় হয়েছিল এই গান, ‘আমি ভোটেরও লাগিয়া ভিখারি সাজিনু / ফিরিনু গো দ্বারে দ্বারে/ আমি ভিখারি না শিকারি গো/ওরে হ্যাঁ ছাড়া কেউ না বলিল না/ ক্যানভাস করিনু যারে।’
মমতার নির্দেশে সেই জনপ্রতিনিধিরা ‘দিদির দূত’ হয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন মানুষের দরজায়। পরিষেবা পাওয়ার জন্য পঞ্চায়েত ও প্রশাসনের দরজায় ঘোরাটাই ছিল প্রথা। আর এখন? সরকারি পরিষেবা মানুষ ঠিকমতো পাচ্ছে কি না, যাচাই করছেন জনপ্রতিনিধিরা। সেই কাজ করতে গিয়ে তৃণমূল নেতারা বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের অবস্থানও
বুঝতে পারছেন। ফলে এই কর্মসূচি এনে দিয়েছে সংশোধনের সুযোগ।
জনসংযোগই জনপ্রতিনিধির শিকড়। যাঁর শিকড় যত গভীরে তাঁকে উপড়ে ফেলা তত কঠিন। ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ কর্মসূচিতে মুছে যাচ্ছে মঞ্চ আর জনতার দূরত্ব। সাধারণ মানুষ ‘দিদির দূত’দের কাছে গিয়ে কেউ বলছেন, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা পাই না। কেউ বলছেন, আবাস যোজনার ঘর চাই। কেউ কেউ নেতাদের বিরুদ্ধে টাকা নেওয়ার অভিযোগও করছেন। কারণ রাজ্যবাসী এখনও বিশ্বাস করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে কথাটা পৌঁছে দিলেই হবে কাজ। সেই আশায় ‘দিদির দূত’ গ্রামে এলেই মানুষ দল বেঁধে রাস্তায় দাঁড়াচ্ছে। আর দাঁড়াবে না-ই বা কেন? এর আগে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের অভাব, অভিযোগ জানানোর সুযোগ কবে কোন দল, কোন সরকার দিয়েছে?
বিরোধীরাও টের পাচ্ছে, কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, দুয়ারে সরকারের মতো ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ও বাংলার রাজনীতিতে মাইলফলক হতে চলেছে। তাই বিঘ্ন ঘটাতে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছে বিরোধীরা। জেলায় জেলায় পাঠানো হচ্ছে কেন্দ্রীয় টিম। কারণ স্পষ্ট। রাজনৈতিকভাবে তৃণমূলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা নেই বিজেপির। তাই শ্বাসকষ্টে ভোগা বঙ্গ বিজেপিকে অক্সিজেন জোগাতে দিল্লি থেকে লাইন দিয়ে আসছে ‘দাদার দূত’। তাতেও খুব একটা সুবিধে হবে না বুঝেই শুরু হয়েছে কর্মসূচি বানচালের চেষ্টা।
পূর্ব বর্ধমান জেলার বৈকুণ্ঠপুর পঞ্চায়েত এলাকায় ফাঁস হয়েছে সেই ঘৃণ্য চক্রান্ত। আবাস যোজনায় নাম নেই অভিযোগ তুলে বিডিওকে ঘিরে তুমুল বিক্ষোভ দেখানো হয়েছিল। তা দেখে অনেকে ভেবেছিলেন, সেটা গরিব ও বঞ্চিত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত
বিক্ষোভ। কিন্তু সেদিন যাঁদের বিক্ষোভ দেখাতে
নিয়ে গিয়েছিল তাঁদের অনেকেরই নাম আছে
আবাস তালিকায়। নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে বিক্ষোভকারীরা বিডিও-র কাছে গিয়ে ক্ষমাও চেয়েছেন। যাঁর প্ররোচনায় বিক্ষোভ সেই নামটাও তাঁরা ফাঁস করে দিয়েছেন।
তবে, সবচেয়ে হইচই পড়েছে উত্তর ২৪ পরগনার চড়কাণ্ডে। খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষ ‘দিদির দূত’ হিসেবে গিয়েছিলেন ইছাপুর-নীলগঞ্জ পঞ্চায়েতে। মন্ত্রী যখন গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন কিছুটা দূরে বিজেপির মণ্ডল সভাপতির গালে চড় মারে এক তৃণমূল কর্মী। বলাই বাহুল্য, কাজটা অন্যায় এবং অবশ্যই নিন্দনীয়। পোড়খাওয়া রাজনীতিক রথীনবাবু ওই বিজেপি নেতার কাঁধে হাত রেখে পরিস্থিতি সামালে দেন। ফলে জল বেশি দূর গড়ায়নি। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, এমনটা হল কেন?
তৃণমূল শিবিরের দাবি, খাদ্যমন্ত্রীর কর্মসূচিতে বিঘ্ন ঘটানোর প্ল্যান কষেই বিজেপি নেতা সেখানে গিয়েছিলেন। উল্টেদিকে বিজেপি নেতার দাবি, মন্দির যাওয়ার রাস্তাটা সারানোর দাবি জানানোর জন্য তিনি সেখানে হাজির হয়েছিলেন। তর্কের খাতিরে ধরেই নেওয়া গেল, বিজেপির মণ্ডল সভাপতির দাবি সত্যি। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? রাজ্যের সাধারণ মানুষের মতো বিজেপি নেতারাও বিশ্বাস করেন, সমস্যার কথা ‘দিদির দূত’কে জানালে হবে সমাধান। এই কর্মসূচির সাফল্য এখানেই।
তবে, এমনটা হয়েই থাকে। স্বাস্থ্যসাথী চালুর সময় দিলীপ ঘোষ কী বলেছিলেন? ‘এই কার্ডে চিকিৎসা তো দূরের কথা, কেউ এক কাপ চাও কেউ দেবে না।’ অথচ দিলীপবাবুর পরিবারের সদস্যরা স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের জন্য চুপি চুপি লাইন দিয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুয়ারে সরকারকে ‘যমের দুয়ারে সরকার’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। আবার সেই ‘দুয়ারে সরকার’কেই দেশের সেরা প্রকল্পের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। আর এখন দিদির দূত কর্মসূচিকে ‘দিদির ভূত’ বলে কটাক্ষ করে বিজেপি নেতারা সমস্যা সমাধানে তাঁরই দ্বারস্থ হচ্ছেন।
দিদির দূতের কাছে দাবিসনদ পেশ করাকে বিরোধীরা ‘বিক্ষোভ’ ভেবে উল্লসিত হতেই পারেন। তৃণমূল নেতাদের গলদঘর্ম অবস্থা দেখে কেউ ভাবতেই পারেন, পঞ্চায়েতে বেকায়দায় পড়বে শাসক দল। তবে, ঘাম হওয়াটা অনেক সময় জ্বর ছেড়ে যাওয়ার লক্ষণ। এক্ষেত্রেও কি তেমনটাই হচ্ছে?