বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

বিচারব্যবস্থাকে ‘বশংবদ’ করার আপ্রাণ চেষ্টা
মৃণালকান্তি দাস

বিচারবিভাগ, সংসদ-বিধানসভা ও প্রশাসনের মধ্যে বিবাদ বা প্রতিযোগিতার কোনও জায়গা সংবিধানের আত্মায় নেই। একসময় এই মহার্ঘ ভাষণ দিতেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আবার সেই প্রধানমন্ত্রীই ইদানীং বলা শুরু করেছেন, ‘সরকার হোক বা সংসদ বা আদালত, এই তিনই সংবিধান রূপী এক মায়ের তিন সন্তান। তিনজনেরই দায়িত্ব ভারতমাতার সেবা করা।’ বিরোধীদের পাল্টা প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী কি বিচার বিভাগ, সরকার ও সংসদের মধ্যে ক্ষমতার যে পৃথকীকরণ সংবিধানে করা হয়েছে, আজ তা মানতে চাইছেন না? এই ফারাক তুলে দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা তৈরি করতে চাইছেন? নয়তো, কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু বারবার দেশের প্রধান বিচারপতিকে এমন চিঠি লিখবেন কেন? যে চিঠিতে ডিওয়াই চন্দ্রচূড়কে আইনমন্ত্রী লিখেছেন, কলেজিয়াম ব্যবস্থায় কেন্দ্রের প্রতিনিধিকেও যুক্ত করা উচিত। তাঁর প্রশ্ন, কেন বিচারপতিরাই বিচারপতিদের নিয়োগ করবেন, কেন কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কোনও ক্ষমতা থাকবে না!
দেশের প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের চার প্রবীণ বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত হয় কলেজিয়াম। দেশের শীর্ষ আদালতের বিচারপতি এবং অন্যান্য উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেয় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ শীর্ষস্থানীয় বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত ওই কলেজিয়ামই। তাঁরাই সম্ভাব্য বিচারপতিদের নাম সুপারিশ করেন। তার পরে সেই নামগুলি বিবেচনা করে সরকার। কলেজিয়ামের পুনর্বিবেচনার জন্য সরকার নাম ফেরত পাঠাতে পারে। কিন্তু কলেজিয়াম আবার সেই নামে সিলমোহর দিলে, তাতে সম্মতি জানাতে বাধ্য সরকার। কিন্তু বিচারবিভাগের বড় অংশের অভিযোগ, প্রস্তাব পাঠানো হলেও নানা কারণে বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করছে সরকার। ফলে আদালতে তৈরি হচ্ছে শূন্যপদ, দীর্ঘায়িত হচ্ছে বিচারপ্রক্রিয়া।
মোদি সরকারের তরফে দাবি, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের প্রতিনিধিরা কলেজিয়াম ব্যবস্থায় না থাকলে বিচারপতি নিয়োগে জনমতের কোনও প্রতিফলন দেখা যাবে না। বিচারবিভাগকে রাজনীতির ছোঁয়াচ থেকে দূরে রাখার জন্য এই দাবির আগাগোড়া বিরোধিতা করেছে শীর্ষ আদালত। বলেছে, ‘আমরাই সবচেয়ে স্বচ্ছ, কলেজিয়াম ব্যবস্থাকে বেলাইনের চেষ্টা করবেন না’! এরপরও দেশের আইনমন্ত্রী যেভাবে বিচারবিভাগকে লাগাতার নিশানা করা শুরু করেছেন তাতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। মোদি সরকার কি বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে চাইছে? সরকারের অনুগত ব্যক্তিদের দিয়ে এবার হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট ভরে তুলতে চাইছে? নাকি তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে চাইছে? মোদি সরকার ক্ষমতায় এসেই জাতীয় বিচারবিভাগীয় নিয়োগ কমিশন আইন তৈরি করেছিল। রাতারাতি সংসদে পাশ হওয়া সেই আইনে বলা ছিল, বিচারপতি নিয়োগ কমিশনে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি-সহ তিন প্রবীণতম বিচারপতির সঙ্গে কেন্দ্রের আইনমন্ত্রী ও দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তি থাকবেন। সুপ্রিম কোর্ট তা ‘অসাংবিধানিক’ বলে খারিজ করে দিয়েছিল। সেই সময় অরুণ জেটলি তীব্র নিন্দায় ফেটে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, মানুষের দ্বারা নির্বাচিত সরকার, সাংসদদের তৈরি আইনকে এমন কিছু বিচারপতি ক্ষমতার জোরে খারিজ করলেন যাঁরা মানুষের দ্বারা নির্বাচিত নন। কিন্তু সেদিন মোদি সরকারের কেউ একজনও একথা বলেননি, নির্বাচিত সরকার ভুল করে সংবিধানের বিরুদ্ধাচরণ করছে কি না তা-ও দেখা আদালতেরই কাজ।
ভারতের সংবিধানের একটি মৌলিক স্তম্ভ হল নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা। সংবিধান প্রণেতারা ভারতের শাসনব্যবস্থাকে তিনটি বিভাগে ভাগ করেন। সরকার, আইনসভা এবং বিচারবিভাগ। আইনসভা আইন তৈরি করবে, সরকার তা দেশে প্রচলন করবে এবং বিচারবিভাগ নিরপেক্ষভাবে সেই আইনের বৈধতা যাচাই করবে। এই তিনটি স্তম্ভ দেশ চালানোর ক্ষেত্রে অপরিহার্য এবং এই তিনটি স্তম্ভের মধ্যে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যদিও বিচারবিভাগে মোদি সরকারের ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা নিয়ে একাধিক অভিযোগ উঠেছে।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ সরব হয়েছিলেন, সরকারের ইঙ্গিতে স্পর্শকাতর মামলা যাচ্ছে নির্দিষ্ট বিচারপতিদের কাছে। সেই মামলা গড়াচ্ছে সরকারের পক্ষেই। সুপ্রিম কোর্টের বিচার অবশ্যই মহামান্য। সেই বিচারের পিছনে কোনও প্রভাব বা পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠতে পারে না। কিন্তু আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বিচারের সিদ্ধান্ত নিয়ে নীতিগতভাবে দ্বিমত পোষণ করা যায়। বলা যায় যে, অযোধ্যা মামলার রায়ে বিতর্কিত জমিতে মন্দির নির্মাণের ছাড়পত্রে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের শাসকবর্গ এবং তাঁদের সহমর্মীদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বড় সুবিধা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটটি বাস্তব বলেই, প্রধান বিচারপতির আসন ছাড়বার চার মাসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির মনোনীত সদস্য হিসেবে রাজ্যসভায় প্রবেশ করে শ্রীযুক্ত রঞ্জন গগৈ দেশের নাগরিকের মনেই প্রশ্ন তুলেছেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিরআসনে একবার বসার পরে সংসদের সদস্য হলে আইনে বা সংবিধানে আটকায় না ঠিক, কিন্তু সংসদীয় শাসনতন্ত্রের নৈতিকতা লঙ্ঘিত হয় না কি? আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগের সীমারেখা অপমানিত হয় না কি? অবসরের পরেই বিচারপতিদের সরকারি পদে বসানো হতে থাকলে অবসরের আগে রায়ে তার প্রভাব পড়ার সম্ভবনা আছে। গত আট বছরে মোদি সরকার একাধিক ক্ষেত্রে বিচারপতিদের অবসরের পরেই তাঁদের সরকারি পদে বসিয়েছে। সম্প্রতি বিচারপতি হেমন্ত গুপ্তকে অবসরের পরেই নয়াদিল্লি আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। উল্টো দিকে একাধিক আইনজীবী বা হাইকোর্টের বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগের সুপারিশে আপত্তি বা টালবাহানা করেছে। কেন আপত্তি, তার সরকারি ব্যাখ্যা মেলেনি। তবে দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই বিচারপতিরা বর্তমান সরকারের শীর্ষব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অতীতে রায় দিয়েছিলেন।
দাম্ভিক সরকার, জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বলীয়ান হয়ে অনেক সময় মনে করে যে, তাদের কথায় ক্রমাগত সায় দেওয়াই বিচারব্যবস্থার দায়িত্ব। গত বছর ধরে বিচারবিভাগের কিছু সিদ্ধান্ত সরকারের অনুকূলেই গিয়েছে। নতুন প্রধান বিচারপতি হয়তো কিছুটা এই প্রবণতার উপর রাশ টানছেন। শেষ যিনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন তাঁর আমলের কিছু রায় এবং বর্তমান প্রধান বিচারপতির কিছু বক্তব্য মনে হচ্ছে সরকারের পছন্দ হয়নি। যেমন, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এন ভি রামনার আমলে সুপ্রিম কোর্ট দেশদ্রোহিতার আইনকে স্থগিত করে। এই আইনের আওতায় চলা সমস্ত মামলার উপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। সরকারকে বলা হয় তাদের এই আইন বিষয়ে বক্তব্য কোর্টকে জানাতে। বিজেপি গোটা দেশজুড়ে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বহু মানুষকে জেলে পুরেছে। এই আইনকে ব্যবহার করে তারা বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করেছে। অতএব, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় তাদের না-পসন্দ হওয়ারই কথা। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় চন্দ্রচূড়ের আমলে নির্বাচন কমিশনার যেভাবে নিয়োগ করা হয়েছে তা নিয়ে পদ্ধতিগত প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্ট। নতুন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করতে এত তাড়াহুড়ো করা হল কেন এই প্রশ্ন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা তুলেছেন। এই সমস্ত অস্বস্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হলে সরকারের বিপদ বাড়বে। অন্যদিকে দৃষ্টি ঘোরানো জরুরি। অতএব, ফের কলেজিয়ামের বিরোধিতা করা...।
ফলে দেশের আইনমন্ত্রী এবং দেশের উপ রাষ্ট্রপতি বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে লাগাতার বিবৃতি দিচ্ছেন। বলা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের কেউ কেউ লক্ষ্মণরেখা মানছেন না। তাঁরা নাকি সরকারি নীতি তৈরি করার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করছেন। আসলে বিজেপি তথা মোদি একটি আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক দল ও নেতায় পরিণত হয়েছে। দেশে বিরোধীদের দুর্বলতার ফলে গেরুয়া শিবির বিপুল ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে। মোদি সরকারের যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা এখনও সেই সাংবিধানিক সংস্থাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করতে পারেনি, তা হল সুপ্রিম কোর্ট তথা দেশের বিচারব্যবস্থা। বিচারপতিরা যদি সরকারের বশংবদ ব্যক্তি হয় তাহলে নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা ধারণাটির কোনও মানে থাকে না। সরকার তখন নিজস্ব গা-জোয়ারি নীতিগুলিতে তাদের অধীন বিচারপতিদের দিয়ে আইনি ছাপ লাগিয়ে নেবে। অনেকটা পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থার ধাঁচে!
আপাতত, অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদি তাঁদের আইনমন্ত্রীকে কলেজিয়াম ব্যবস্থার বিরোধিতার রাগে বাঁশি বাজানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। কতটা বাঁশি বাজল, মানুষ কতটা মোহিত হল, সুপ্রিম কোর্ট কতটা সহ্য করল— এই সব বিষয় পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক হবে। গণতন্ত্রের অছিলায় দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে জল মাপছে গেরুয়া শিবির। লক্ষ্য একটাই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা! যে ব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতাকে শিকেয় তুলে, সংসদে আইন পাশ করে দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রও ঘোষণা করা যায়। জেলে ঢোকানো যায় যাঁকে-তাঁকে...।

19th     January,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ