বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

কংগ্রেসকে আরও পরিণতমনস্ক হতে হবে
সমৃদ্ধ দত্ত

ভারত জোড়ো যাত্রায় যোগ দেওয়ার জন্য কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে সমমনস্ক দলগুলিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি লিখেছেন। ২১টি দলকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিজেপি বিরোধী এবং ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিকেই এই আহ্বান। অর্থাৎ বৃহত্তর প্রেক্ষিতে আগামী দিনে যাতে একটি বিজেপি বিরোধী জোট গঠন করা যায়। সেই লক্ষ্য নিয়েই কংগ্রেসের এই উদ্যোগ। শুধুমাত্র অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি, কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতি এবং গুলাম নবি আজাদের নতুন দল ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ আজাদ পার্টি এই আমন্ত্রণ তালিকা থেকে বাদ। কেন? কারণ আম আদমি পার্টি দিল্লি থেকে পাঞ্জাব একের পর এক নির্বাচনে প্রমাণ করে দিয়েছে যে, বিজেপির বিরুদ্ধে বিকল্প এসব রাজ্যে আম আদমি পার্টিই। কংগ্রেস ব্যর্থ। তেলেঙ্গানার কে চন্দ্রশেখর রাওকে কংগ্রেস বিশ্বাস করে না। তিনি যে কোনও সময় আবার বিজেপির হাত ধরতে পারেন। তাছাড়া তিনিও ওই রাজ্যে কংগ্রেসকে মুছে দিয়েছেন। তাই তিনি ব্রাত্য?
একদিকে রাহুল গান্ধীর একটি অবিশ্বাস্য কর্মসূচি নিয়ে গোটা ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলন ও মানুষের চর্চার গতিমুখ বদলে গিয়েছে। এভাবে সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার পথে অসংখ্য ভারতবাসীর সঙ্গে সংযোগ রক্ষার শপথ নিয়ে রোদে, বৃষ্টিতে, শীতে হেঁটে যে প্রায় অতিমানব এক ভাবমূর্তির নির্মাণ করছেন তিনি, সেটা ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে অবশ্যই থেকে যাবে। এতে রাজনৈতিক সাফল্য আসবে কি না সেটা ভবিষ্যৎ উত্তর দেবে। কিন্তু তিনি একটি ট্রেন্ড সেট করে দিয়ে গেলেন যে, ঘৃণা, বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতার বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে রাজনীতির অভিমুখ বদলের একটা কঠিনতম প্রয়াস নেওয়া যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর পদযাত্রায় আসছে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে। এবং আলোচনা তুঙ্গে যে, রাহুল গান্ধী নিজেকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলছেন। এক এক নতুন রাহুলের জন্ম হচ্ছে। এসবই যেমন ঠিক, তেমনই আবার অন্যদিকে, এই রাহুল গান্ধীর দলই অপরিণতমনস্ক তথা সুবিধাজনক রাজনীতি করছে নির্বাচনী সমীকরণের ময়দানে। এটা ভারী বিস্ময়ের। 
রাহুল গান্ধীর দল তৃণমূল কংগ্রেসকে আহ্বান করেছে ভারত জোড়ো যাত্রায় যুক্ত হওয়ার জন্য। যে ২১টি দলকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম তৃণমূল কংগ্রেস। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে এই ২১ দলকে যে চিঠি লিখেছেন, সেখানে ভারত জোড়ো যাত্রায় যোগদান করার জন্য তিনটি শব্দের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সমমনস্ক বিজেপি বিরোধী দলগুলিকে যে আদর্শের ভিত্তিতে ডাকা হচ্ছে, সেগুলি হল, সত্য, সহমর্মিতা এবং অহিংসা। অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেস এই তিনটি শর্তই পূরণ করে বলে কংগ্রেস মনে করছে। সেই কারণেই তো ২১টি দলের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসকেও আমন্ত্রণ করা হয়েছে। আজ লোকসভা ভোটের মাত্র এক বছর আগে কংগ্রেসের মনে হচ্ছে সত্য, সহমর্মিতা এবং অহিংসা— এই তিনটি বৈশিষ্ট্য তৃণমূলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর সেই বিশ্বাস থেকে এই দলকে আমন্ত্রণ। অথচ যখনই বিধানসভা অথবা পঞ্চায়েত কিংবা পুরসভা ভোট হয়, তখনই কংগ্রেসের আর এই বৈশিষ্ট্যগুলির কথা মনে থাকে না। 
২০২১ সালের নির্বাচনের সময় ১৪ এপ্রিল রাহুল গান্ধী পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলায় গোয়ালপোখরে নির্বাচনী জনসভা করেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেসকে রাজ্য পরিচালনায় সুযোগ দিয়েছিল মানুষ। কিন্তু তৃণমূল সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। বাংলার মানুষকে কাজের জন্য রাজ্যের বাইরে চলে যেতে হয়। এই সরকার কাটমানির সরকার, এই দল কমিশনের দলে পর্যবসিত হয়েছে। তৃণমূলকে আক্রমণ করে তিনি আরও বলেছিলেন, আমরা কোনওদিন কিন্তু বিজেপি, আরএসএসের সঙ্গে কোনও জোট করিনি। আমাদের লড়াই আদর্শ ও নীতির লড়াই। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই রাজনৈতিক লড়াই। রাহুল বলেছিলেন, বিজেপি জানে যে, কংগ্রেস কোনওদিন তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। তাই তারা কংগ্রেস মুক্ত ভারতের স্লোগান দেয়। কই তৃণমূল মুক্ত ভারতের স্লোগান তো কখনও বিজেপি দেয় না? 
রাহুল গান্ধীর ওই মন্তব্য ছিল বিধানসভা ভোটের সময়। অর্থাৎ তখন তৃণমূল ছিল অসৎ। আর এখন লোকসভা ভোটের আগে যখন সব দলকে একজোট না করলে আবার বিজেপি ক্ষমতায় আসবে, তখন তৃণমূল সৎ হয়ে গেল?  গত দু’বছরে রাহুল গান্ধী কি তাঁর দলের বাংলা শাখাকে একবারও নিষেধ করেছেন যে, আমরা আগামী দিনে মোদিকে হারাতে চাই, তাই তৃণমূলকে আক্রমণ করা চলবে না? আমাদের তৃণমূলের সঙ্গে জোট করা দরকার? এরকম বলেছেন? 
কংগ্রেস কোন কোন রাজ্যে বিজেপির সঙ্গে সরাসরি টক্কর দিতে পারবে? রাজস্থান, ছত্তিশগড়, কর্ণাটক, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড। বাকি কোনও রাজ্যে কংগ্রেসের একক শক্তি নেই। হিমাচল আর উত্তরাখণ্ডে নগণ্য সংখ্যক লোকসভা আসন। তাহলে রইল বাকি তিনটি রাজ্য। অর্থাৎ কংগ্রেসের সবথেকে বেশি জোট দরকার। আর তাই লোকসভা ভোট এলে কংগ্রেস সকলকে আহ্বান করে। আবার ভোট চলে গেলে পরবর্তী বিধানসভা ভোটে অন্যরকম মূর্তি। গুলাম নবি আজাদ কংগ্রেস ছেড়ে চলে গিয়ে নতুন দল গড়েছেন। সেটা তাঁর অপরাধ। আর সেই কারণে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি ভারত জোড়ো যাত্রায়। 
কংগ্রেসের এই যুক্তির কোনও বাস্তবতা আছে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শারদ পাওয়ারও তো কংগ্রেস ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। শারদ পাওয়ারের দল ছাড়ার ইস্যুই ছিল সোনিয়া গান্ধীকে মেনে নিতে না পারা। তাহলে তাঁদের আমন্ত্রণ করা হলে আজাদকে বাদ দেওয়া যায় কী যুক্তিতে? প্রশ্ন উঠতেই পারে, এটা কংগ্রেসের কর্মসূচি। কংগ্রেস স্থির করবে কাকে ডাকা হবে, কাকে ডাকা হবে না! একেবারেই সঠিক। কিন্তু এই আমন্ত্রণ তো আদতে আগামী দিনে বৃহত্তর জোটেরই প্রাক প্রস্তুতি! তাহলে আর আম আদমি পার্টি, আজাদের দল কিংবা কে সি আরকে বাদ দেওয়ার অর্থ কী? বিজেপিকে পরাস্ত করার ক্ষমতার প্রমাণ তো এরা ইতিমধ্যে দিয়েছে! সুতরাং এদের মহাজোটে নিলে জোটেরই লাভ।
 বিজেপিকে হারাতে হলে কংগ্রেসকে সর্বাগ্রে মনে রাখতে হবে যে, ২০১৯ সালে তারা ৫৪৩ টি আসনের মধ্যে সাকুল্যে ৫২টি আসনে জয়ী হয়েছিল। কংগ্রেসকে ভুললে চলবে না যে তারা বাংলায় ২০২১ সালে শূন্য। কংগ্রেসকে মনে রাখতেই হবে যে, তারা রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ের সরকার ধরে রাখতে না পারলে প্রকৃত অর্থেই ভারত হবে প্রায় কংগ্রেস মুক্ত। একমাত্র হিমাচল থাকবে সঙ্গে। 
এসব তথ্য মনে রাখলে সর্বাগ্রে যা চলে যাবে, তা হল ইগো। রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলির একমাত্র ক্ষমতা আছে বিজেপিকে নাস্তানাবুদ করা।  তাই যারা যেখানে শক্তিশালী, তাদের সেখানেই গুরুত্ব দিতে হবে। সোজা কথায় মূল লক্ষ্য যদি হয় বিজেপিকে পরাস্ত করা, তাহলে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হয়ে বিচার করতে হবে যে, কোন রাজ্যে কী স্ট্র্যাটেজি হওয়া উচিত। যেখানে কংগ্রেস শক্তিশালী, সেখানে কংগ্রেসকেই ময়দান ছেড়ে দিতে হবে অন্য দলগুলির। আবার অন্যত্র কংগ্রেসকে আপস করতে হবে।
কিন্তু নিজের সুবিধামতো এই দলকে জোটে ডাকলাম, ওই দলকে ডাকলাম না, ওই দলকে চার বছর আক্রমণ করলাম, আর পঞ্চম বছরে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলাম নিজের স্বার্থে, এরকম অপরিণতমনস্ক রাজনীতিকে অপারচুনিস্ট পলিটিক্স বলা হয়। ভরসা হল, রাহুল গান্ধী নিজেকে সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলতে সচেষ্ট হয়েছেন। তিনি সম্প্রতি বলেছেন আগের রাহুল গান্ধীকে আমি মেরে ফেলেছি। তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে আর নেই। আমরা নতুন রাহুল গান্ধীকে বহিরঙ্গে দেখতে পাচ্ছি। এবার লোকসভা ভোটের আগে তাঁর রাজনীতির স্ট্র্যাটেজিকে দেখতে চাই। 

13th     January,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ