বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

নোট বাতিল ও তার তিনটি দিক
পি চিদম্বরম

কোনও সন্দেহ নেই যে, বিমুদ্রাকরণ সংক্রান্ত আইনি লড়াইয়ে কেন্দ্রীয় সরকার জয়ী হয়েছে। মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ, ৪:১ রায়ে পিটিশনারদের সমস্ত আপত্তি খারিজ করে দিয়েছে। সর্বোচ্চ আদালত একবার আইন ঘোষণা করে দিলে, আদালতের সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া সকল নাগরিকের জন্যই বাধ্যতামূলক। ভিন্নমতের রায়টি শুধুমাত্র ‘আইনের অন্তরের সুর এবং ভবিষ্যৎ 
দিনের বুদ্ধিমত্তার প্রতি’ একটি আবেদন হিসেবে 
গণ্য হবে।
আইনি দিক
তার তৈরি ছয়টি প্রশ্নে আদালত কী বলতে চেয়েছে?
১. আরবিআই আইনের ধারা ২৬, উপধারা (২) 
মতে কেন্দ্রীয় সরকারকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সমস্ত সিরিজের ব্যাঙ্ক নোট (এক বা একাধিক 
মূল্যের) বাতিল বা বিমুদ্রাকরণে তা ব্যবহার করা যেতে পারে।
২. ধারা ২৬, উপধারা (২) বৈধ এবং ‘এক্সেসিভ ডেলিগেশন’-এর উদাহরণ হিসেবে তা বাতিল করা যাবে না।
৩. তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটি ত্রুটিপূর্ণ 
ছিল না।
৪. বিতর্কিত বিমুদ্রাকরণ ‘টেস্ট অব প্রোপোরশনালিটি’-তে উত্তীর্ণ হয়েছে। 
৫. পুরনো নোট পাল্টে নতুন নোট নেওয়ার জন্য যে সময় দেওয়া হয়েছিল সেটাও ছিল যুক্তিসঙ্গত।
৬. নির্ধারিত সময় পেরনোর পর বাতিল নোট (পাল্টে দেওয়ার জন্য) গ্রহণ করার ক্ষমতা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নেই।
আইনের ‘টেকনিক্যাল’ প্রশ্নগুলিকে বাদ দিয়ে সাধারণ পাঠকের আগ্রহের বিষয়গুলি রয়েছে উপরের তালিকার ১ এবং ৩ নম্বরে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ডিমানিটাইজ করার ক্ষমতা প্রসঙ্গে আদালতের বক্তব্য হল, নির্দিষ্ট এই ব্যাপারে আরবিআইয়ের সুপারিশ থাকলে এটি সংসদের ক্ষমতার সমান। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটি নিয়ে আদালত বলেছে যে, আরবিআইয়ের কেন্দ্রীয় বোর্ড সমস্ত প্রাসঙ্গিক কারণগুলি বিবেচনা করে দেখেছিল এবং প্রাসঙ্গিক কারণগুলি বিবেচনা করে দেখেছিল মন্ত্রিসভাও। 
আদালতের কিছু পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে পাঠকের আগ্রহ থাকবে: নোটবন্দিকরণের উদ্দেশ্যগুলি 
অর্জিত হয়েছে কি না, সেই প্রসঙ্গে আদালত 
বলেছে যে, এই প্রশ্নে এগনোর মতো দক্ষতা তার 
নেই। সাধারণ মানুষের দুর্দশার ব্যাপারে আদালত বলেছে যে, শুধুমাত্র কিছু নাগরিকের কষ্ট হয়েছিল, তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্তটি আইনের চোখে খারাপ হয়ে যাবে না।
সুতরাং, আইনি বিষয়গুলি নিয়ে সিদ্ধান্তটা সরকারেরই পক্ষে গিয়েছে। 
রাজনৈতিক দিক
আইনি প্রশ্নগুলির পরিপ্রেক্ষিতে যেসব উত্তর মিলেছে তাতে হয়তো ওই সংক্রান্ত যুক্তিগুলির উপর যবনিক পড়েছে, কিন্তু অন্য দুটি ডাইমেনশন বা মাত্রা নিয়ে বিতর্ক শুরু হবে। দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দ্য হিন্দু এবং দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র সম্পাদকীয়তে সেগুলির উল্লেখ রয়েছে।
অতীতে দু’বার—১৯৪৬ এবং ১৯৭৮ সালে, উচ্চ মূল্যের ব্যাঙ্ক  নোট বাতিল করা হয়েছিল। 
সেটা করা হয়েছিল সংসদে প্রণীত আইনের জায়গায় একটি অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশ জারি করে। সেটা 
ছিল আইন প্রণয়নের চূড়ান্ত ক্ষমতার (প্লেনারি লেজিসলেটিভ পাওয়ার) প্রয়োগ। তৎকালীন আরবিআই গভর্নর সেই বিমুদ্রাকরণকে সমর্থন দিতে অস্বীকার করেন। তাই সংসদ একটি আইন পাশ করেছিল। ভালো বা খারাপ ফলাফল এবং জনগণের দুর্ভোগের (যা ন্যূনতম বলে প্রমাণিত হয়েছিল) দায়, যাঁরা এমন আইন পাশ করেছিলেন সেই সাংসদদের উপরেই বর্তায়। তখন এই ব্যাপারে সংসদে একটি বিতর্ক হয়। সিদ্ধান্তটি অনুমোদনের আগে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সম্ভবত সমস্ত দিক বিবেচনাও করা হয়েছিল।
অর্পিত কার্যনির্বাহী ক্ষমতা (ডেলিগেটেড এগজিকিউটিভ পাওয়ার) প্রয়োগের মাধ্যমে নোট বাতিল করা হয়েছিল ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর। এই ক্ষেত্রেও কি একই কথা বলা যেতে পারে? এই প্রশ্নে সংসদের কোনও ভূমিকা ছিল না। নোট বাতিলের উদ্দেশ্যের ব্যর্থতা কিংবা অতঃপর যে অর্থনৈতিক পরিণাম হয়েছে, তার জন্য জনপ্রতিনিধিদের দায়ী করলে ধোপে টিকবে না। ২০১৬ সালে দেশে নগদ অর্থ চালু ছিল ১৭.২ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২২ সালে অঙ্কটা বেড়ে হয়েছে ৩২ লক্ষ কোটি টাকা। আয়কর বিভাগ বা তদন্তকারী সংস্থাগুলি প্রায়ই ‘কালো টাকা’ (হিসেববহির্ভূত নগদ অর্থ) খুঁজে বের করে। এটা কারও গণনার মধ্যে জায়গা পায় না। জাল নোট শনাক্ত করা হয় রোজই। তার মধ্যে নতুন ৫০০ এবং ২০০০ টাকার নোটও থাকে বিস্তর। সন্ত্রাসবাদ নিয়ে প্রতি সপ্তাহে রিপোর্ট বেরচ্ছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, একদিকে যেমন সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিরীহ নাগরিকরা নিহত হচ্ছেন, তেমনি সন্ত্রাসবাদীদেরকেও হত্যা করা হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগান চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতেই। তাই এনএমএফটি (নো মানি ফর টেরর) বিষয়ে মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনের জন্য ভারত সরকার একটি স্থায়ী সচিবালয় চালাবার প্রস্তাব দিয়েছে। বিমুদ্রাকরণের কোন উদ্দেশ্য অর্জিত হয়েছে? কোনওটিই নয়। এই বিষয়ে সংসদে অবশ্যই আলোচনা করতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর একটি প্রশ্ন আছে। সরকারের অর্পিত নির্বাহী ক্ষমতা কি সংসদের চূড়ান্ত আইন প্রণয়ন ক্ষমতার সমান হতে পারে? আরবিআই আইনের ধারা ২৬, উপধারা (২) মতে প্রশ্নটির জন্য যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা সরকারের পক্ষে গিয়েছে। কিন্তু প্রশ্নটি অন্যান্য আইনের ক্ষেত্রে উঠলে কি অভিন্ন উত্তরই হবে? এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে বিতর্কের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে সংসদকে।
অর্থনৈতিক দিক
ডিমানিটাইজেশনের অভিজ্ঞতা, আর্থিক পরিণতি কিংবা মানুষের দুর্ভোগ যা হয়েছে, সেগুলি নোটবন্দির উদ্দেশ্যের সঙ্গে আনুপাতিক ছিল কি না—আদালত সেই প্রশ্নের মধ্যে প্রবেশ করতে চায়নি। আদালত সংযম দেখিয়ে বিষয়টি সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত বিবেচনার উপরই ছেড়ে দিয়েছে। যাই হোক, মানুষের ভাববার বিষয়গুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল—সিদ্ধান্তের ভিতরে বোধ-বিবেচনা কতটা ছিল এবং মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের আর্থিক দুর্দশার দিকটি। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে রয়েছে ৩০ কোটি দিনমজুর, ছোট ও মাঝারি শিল্প-বাণিজ্যের (এমএসএমই) সঙ্গে যুক্ত অগুনতি মানুষ এবং কৃষিপণ্যের দাম আচমকা পড়ে যাওয়ার কারণে বিপন্ন কৃষকরা। অধিকন্তু, ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকের পরে (বিমুদ্রাকরণ যেসময় হয়েছিল)—২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধির হার প্রতি বছর হ্রাস পেয়েছে। তারপরে নতুন আঘাত হানে মহামারী এবং স্বভাবতই যোগ হয় আরও অর্থনৈতিক দুর্দশা। 
এই বিষয়গুলি নিয়ে জনগণ বিতর্ক চালিয়ে যাবেই।
আইনি যুক্তিতে সরকার ব্যাপকভাবে জয়ী হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক যুক্তিতে এই বিতর্ক শেষ হয়নি।  সংসদকে এতে অবশ্যই যুক্ত থাকতে হবে। অর্থনৈতিক যুক্তিতে সরকার অনেক আগেই পরাজিত হয়েছে, কিন্তু তা স্বীকার করবে না।
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত 

9th     January,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ