এবার সাধারণ মানুষের পেটে টান পড়ছে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়া ইকনমির(সিএমআইই) রিপোর্টে তা স্পষ্ট। সাধারণ মানুষের কাজের ও বেকারদের চাকরির সুযোগ তৈরিতে নরেন্দ্র মোদির সরকার ডাহা ফেল। অর্থনীতির হাল ঘোরানোর নামে শিল্পপতিদের বিস্তর সুযোগসুবিধা দেওয়া হয়েছে। তবে, তার ছিটেফোঁটাও সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছয়নি। তাই দেশে বাড়ছে বেকারত্ব। তবে, তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টি হল, বেকারত্ব বৃদ্ধিতে দেশে নজির গড়েছে বিজেপির ‘ডাবল ইঞ্জিনে’র রাজ্য হরিয়ানা। দেশের বেকারত্ব বৃদ্ধির গড় হার যেখানে ৮.৬ শতাংশ, সেখানে হরিয়ানায় বেকার বেড়েছে ৩৭.৪ শতাংশ। আর পশ্চিমবঙ্গে ৫.৫ শতাংশ। হ্যাঁ, ১০০ দিনের কাজের টাকা বন্ধ করে দেওয়ার পরেও। তা সত্ত্বেও কথায় কথায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে আঙুল তোলে বিজেপি নেতৃত্ব। এইজন্যই বলে, চালুনি ছুঁচের বিচার করে।
বছরে দু’কোটি বেকারের চাকরি দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। আর এখন বলছেন, দেড় বছরে দশ লক্ষ চাকরি। সেটাও অনিশ্চিত। তবে, বিজেপির নেতারা ভুলেও দু’কোটি চাকরির কথা বলেন না। উল্টে চাকরির প্রসঙ্গ উঠলেই মহামারীকে ‘ঢাল’ করে চলে বাঁচার চেষ্টা। কিন্তু করোনার আগেও বিজেপি প্রতিশ্রুতির ধারেকাছেও যেতে পারেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম মন্ত্রকের দেওয়ার তথ্য বলছে, ২০১৬-’১৭ সাল থেকে ২০২০-’২১ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন অফিসে ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় চাকরি হয়েছে মাত্র ৪লক্ষ ৪৫ হাজার ৪১৮জনের।
তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? বছরে দু’কোটি তো দূরের কথা, এক লক্ষ বেকারেরও চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেনি মোদিজির সরকার। উল্টে এই ক’বছরে রেল, ব্যাঙ্ক, পোস্টাল ও টেলিকমে লক্ষ লক্ষ পদ ফাঁকা হয়েছে। অসংখ্য পদের অবলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় সংস্থার অফিসে কর্মীদের স্বেচ্ছাবসরে বাধ্য করা হচ্ছে। রাজি না হলেই প্রত্যন্ত এলাকায় বদলি। টি বোর্ডের কর্মীদের সঙ্গে এমনটাই করা হচ্ছে। হেনস্তা হতে হতে অনেকে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন।
সরকারি চাকরির সুযোগ কমছে। তার সুযোগ নিচ্ছে অধিকাংশ বেসরকারি সংস্থা। করোনার লেজটুকুও আর এদেশে নেই। কিন্তু তার জুজু আছে পুরোমাত্রায়। মহামারী পরিস্থিতির অজুহাত খাড়া করে কর্মীদের বেতন কমাচ্ছে, বাড়াচ্ছে কাজের বোঝা। ফলে বেসরকারি সংস্থায় কাজের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব দু’-ই কমছে। সিএমআইই-র সাম্প্রতিক রিপোর্ট সেকথাই বলেছে।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেন্দ্র ২৭ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল। কাজের সুযোগ তৈরির নামে শিল্পপতিদের দেদার আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দেওয়া হিসেব বলছে, ৬০ লক্ষ উদ্যোগীকে ৭৮০০ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রীর দাবি সত্যি হলে বেকারত্ব কমার কথা। কিন্তু বৃদ্ধি পেল! তাহলে কি আর্থিক সহায়তা যথাস্থানে যায়নি, নাকি সবটাই ভাঁওতা?
উন্নয়নের সঙ্গে কাজের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। উন্নয়ন হলেই কাজের সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু ‘কর্মহীন উন্নয়নে’ সাধারণ মানুষের কোনও লাভ হয় না, পেট ভরে পুঁজিপতিদের। এক্ষেত্রেও সম্ভবত তেমনটাই ঘটেছে। তা না হলে দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে কেন?
সিএমআইই-র রিপোর্ট বলছে, বেকারত্ব বৃদ্ধিতে উপরের দিকের রাজ্যগুলির মধ্যে বিজেপি শাসিত হরিয়ানা ছাড়াও আছে ত্রিপুরা, গোয়া প্রভৃতি। এছাড়াও রয়েছে কংগ্রেস শাসিত রাজস্থান, হিমাচলপ্রদেশ, আপ শাসিত পাঞ্জাব ও দিল্লি। এমনকী বাম শাসিত কেরলের চেয়েও বাংলায় বেকারত্ব বৃদ্ধির হার অনেক কম। কেরলে যেখানে ৭.৪ শতাংশ, সেখানে বাংলায় সাড়ে পাঁচ।
এটা অবশ্যই বাংলার বড় সাফল্য। কারণ কেন্দ্রীয় সরকার ১০০ দিনের প্রকল্পে রাজ্যের প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা আটকে রেখেছে। ১০ মাস ধরে বন্ধ প্রকল্পের কাজ। এই প্রকল্প শুধু বাংলা নয়, গোটা দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। ২০০৫ সালে কংগ্রেস সরকার এই প্রকল্প চালু করেছিল বলেই ভারতবর্ষে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারীর সংখ্যা দ্রুত কমানো গিয়েছে।
অনেকেই বলেন, নরেন্দ্র মোদির ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গড়ার ডাক কোনও দিনই সফল হবে না। কারণ কংগ্রেস আমলে চালু হওয়া দু’টি প্রকল্প ইন্দিরা গান্ধীর দলকে অমরত্ব দিয়েছে। এক, ১০০ দিনের কাজ প্রকল্প(মনরেগা), দুই, মিড ডে মিল। এই দু’টি প্রকল্প চালু হয়েছিল বলেই দেশটা কালাহান্ডি হয়ে যায়নি। দুর্নীতিকে অজুহাত করে সেই ১০০ দিনের কাজ বাংলায় দশ মাস বন্ধ রেখেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। প্রতি পদে পদে প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, বিজেপি বড়লোকের দল।
দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনই প্রকৃত শাসকের লক্ষ্য। কিন্তু দুষ্টকে দমন করতে গিয়ে শিষ্টের ক্ষতিসাধন কখনওই বিবেচকের কাজ হতে পারে না। বাংলায় ১০০ দিনের কাজে যে দুর্নীতি হয়েছে, তার প্রতিকার অবশ্যই হওয়া উচিত। টাকা নয়ছয়ে যুক্তদের শাস্তি হোক। আত্মসাতের টাকা সুদে আসলে ফেরানো হোক। প্রয়োজনে জেলে ভরা হোক। কিন্তু গোটা প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হল কেন? ভোটে জিতেছে বলেই কি গরিব মানুষের পেটে লাথি মারার অধিকার কেন্দ্রীয় সরকার পেয়ে গিয়েছে? দুর্নীতি ইস্যুতে বিজেপি সত্যিই কি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়ে চলে? তাহলে উত্তরপ্রদেশে ১০০দিনের কাজে টাকা আটকে দিচ্ছে না কেন?
ভুয়ো জবকার্ড তৈরিতে রেকর্ড গড়েছে যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ। সেখানে সাড়ে সাত লক্ষ ভুয়ো জবকার্ড বাতিল করা হয়েছে। ভুয়ো জবকার্ডকে হাতিয়ার করে উত্তরপ্রদেশে ১০০ দিনের কাজে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো সেখানেও টাকা বন্ধ করে তদন্ত করা উচিত ছিল। কিন্তু মোদিজির সরকার তা করেনি। ডাবল ইঞ্জিন সরকার বলেই কি সাত খুন মাফ?
বাংলাকে নানাভাবে জব্দ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি। আবাস যোজনায় আট মাস আটকে রাখার পর টাকা দিয়েছে। কিন্তু মাত্র তিন মাসে দশ লক্ষ বাড়ি তৈরির কাজ শেষ করতে হবে বলে শর্তও চাপিয়েছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে এত বাড়ির কাজ শেষ করা একপ্রকার অসম্ভব। অনেকে বলছেন, বিজেপি নেতৃত্ব অনেক অঙ্ক কষে শেষমুহূর্তে আবাস যোজনার টাকা ছেড়েছে। কাজ করতে না পারলে রাজ্য সরকারকে ‘অপদার্থ’ প্রমাণের চেষ্টা করবে বিজেপি। পঞ্চায়েত ও লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচারের সেই অস্ত্রটা তৈরির চেষ্টা চলছে।
এসব সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারের এই চ্যালেঞ্জটা নিয়েছেন। কারণ একুশের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহকে হারানোর পর তিনি বুঝে গিয়েছেন, বিজেপির সঙ্গে তাঁকে লড়তে হবে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে। তাই চ্যালেঞ্জের মুখে তিনি ভয়ে পিছু হটেন না। পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। তার মোকাবিলাও করেন। তিন মাসের মধ্যে ১০ লক্ষ বাড়ি তৈরির কাজ শেষ করাটা তেমনই এক চ্যালেঞ্জ।
নরেন্দ্র মোদির সরকার ১০০ দিনের কাজ বন্ধ করে দিয়ে বাংলাকে অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে। রাজ্যে বিপুল সম্পদ সৃষ্টির সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ তাঁদের হকের কাজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতিতে তার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলায় চলছে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। চলছে বিকল্প রোজগারের সন্ধান। বেকার যুবক যুবতীদের কথা মাথায় রেখে চালু হয়েছে ‘কর্ম সংবাদ’ পোর্টাল। চাকরিদাতাদের সঙ্গে চাকরিপ্রার্থীদের যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছে প্রশাসন। বিভিন্ন কারখানায়, বেসরকারি সংস্থায় কাজ পাচ্ছেন বেকাররা। সেই সুবাদেই বিজেপি শাসিত রাজ্যের সঙ্গে টক্কর নিচ্ছে কেন্দ্রের বিষনজরে থাকা বাংলা। আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে নবান্নের চোদ্দতলায় পৌঁছনো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফের প্রমাণ করে দিলেন, চোখে চোখ রেখে লড়াই করে এগিয়ে যাওয়াটা রয়েছে তাঁর রক্তে।
সব কা সাথ, সব কা বিকাশ, সব কা বিশ্বাস। এমন স্লোগানে কে না মজে? গোটা দেশের সঙ্গে বিশ্বাস করেছিল বাংলাও। ফলশ্রুতি, বাংলা থেকে লোকসভায় গিয়েছিলেন বিজেপির ১৮জন। যার অধিকাংশই গ্রামীণ এলাকার। সুযোগ পাওয়ামাত্র বিজেপি গ্রামের সেই গরিব মানুষের পেটেই লাথি মারছে। সামনে পঞ্চায়েত ভোট। তাই বলটা এবার খেটে খাওয়া মানুষের কোর্টে।