মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলোই সমাজের আসল রূপ দেখতে পায়।
—হুমায়ুন আহমেদ
বহুল প্রচলিত একটা গল্প মনে পড়ল। রাজার উপর এক ভিক্ষুকের ভয়ানক ঈর্ষা। রাজার কতই না আরাম! তিনি সর্বক্ষণ ভালোমন্দ খেতে পারেন, দামি জামা পরেন, নরম গদির পালঙ্কে ঘুমোতেও পারেন। একদিন রাজার সঙ্গে দেখা করে সে কথা বলেই ফেললেন ভিক্ষুক। রাজা সব শুনে বললেন, ঠিক আছে। আজ তুমি আমার অতিথি। আমি যেমন জীবন কাটাই, তুমিও সেই আরামেই থাকবে। ভিক্ষুক দামি জামা পরলেন, চর্ব-চোষ্য খাওয়ানোও হল তাঁকে। তারপর নরম গদির পালঙ্ক। কিন্তু শুয়েই ভিক্ষুক দেখলেন, মাথার উপর একটা সুতোয় ঝুলছে তলোয়ার। ক্লান্তিতে যতই চোখ জুড়িয়ে আসে, ততই আতঙ্কে ভেঙে যায় ঘুম। এই বুঝি ছিঁড়ে পড়ল। সারারাত না ঘুমিয়ে ভোরবেলা ছুটে রাজার কাছে হাজির হলেন তিনি। বললেন, রক্ষে করুন মহারাজ। এভাবে ঘুমানো যায় না। রাজা হেসে বলেন, আমার অর্থ আছে, আরাম আছে, কিন্তু শান্তির ঘুম নেই। সেটাই তোমাকে বোঝালাম। তাহলে এই গল্পের মরাল কী? খুব সহজ—উচ্চবিত্তের টাকা থাকে, ঘুম থাকে না। আর নিম্নবিত্তের টাকা না থাকলেও শান্তির ঘুমের অভাব হয় না। কিন্তু মধ্যবিত্ত? এক অদ্ভুত জাঁতাকলে পেষাই হতে থাকা শ্রেণি। এদের খানিক টাকা আছে, কিন্তু তা দিয়ে রাজার আরাম হয় না। যদিও সমাজের একটা চাপ এই শ্রেণির উপর থাকে... স্টেটাস মেন্টেইন করার। সেই চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে রাতের ঘুমটাও যায় উড়ে। তার উপর চলতে থাকে সরকারের লাগাতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তা সে যে পার্টিই সরকারে থাকুক না কেন। সমাজের গিনিপিগ শ্রেণি হয়েই থেকে যায় মধ্যবিত্ত। কেন? খুব সাদামাটা হিসেব।
ভারতে দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা সর্বাধিক। ফলে এঁরাই যে কোনও দলের সবচেয়ে বড় ভোটব্যাঙ্ক। পার্টি জানে, এঁদের তুষ্ট রাখতে হবে। সেটাও খুব সহজ। কারণ এঁদের চাহিদা সবথেকে কম। বিনামূল্যে চাল-ডাল, মাথার উপর যেমন-তেমন একটা ছাদের ব্যবস্থা, আর ছেলেমেয়েদের বিনা পয়সায় সরকারি স্কুলে পড়াশোনা। সঙ্গে ১০০ দিনের কাজের গ্যারান্টি তো রয়েইছে। এতেই তাঁরা খুশি। এবং তাতে কোনও অন্যায় নেই। কোনও সরকার যদি উপযাজক হয়ে বলে, তোমাকে কাজকর্ম করতে হবে না, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব... তাহলে হাতের লক্ষ্মী পায়ে তাঁরা ঠেলবেন কেন? ভোগ্যপণ্যের প্রতি মোহমায়া এই শ্রেণির সাধারণত থাকে না। তাই হাতে নগদের জোগান না থাকলেও খুব অসুবিধা নেই। যদি পকেটে টাকা থাকে, তখন তাঁরা কেনাকাটা করেন। আর কখন টাকা হাতে থাকে তাঁদের? যখন এই শ্রেণির মানুষ কাজে নামেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মানুষ কিনবেই। দাম বাড়লেও কিনবে, কমলেও। সবসময় তার একটা ব্যালান্স অর্থনীতিতে থাকেই। ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের উপর নির্ভর করে অর্থনীতির সূচকের ওঠানামা। ভোগ্যপণ্য বিক্রি বাড়লে উৎপাদন শিল্পের গতি ও পরিধি দুই বাড়ে। অর্থনীতি সচল থাকে। যদি সমাজের বেশিরভাগ মানুষই কেনাকাটা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখেন, তাহলে তা মোটেই ইতিবাচক নয়। এই শ্রেণির হাতে টাকা না থাকাটা তাই অর্থনীতির কাছে অবশ্যই অভিশাপ। কারণ, নগদের জোগান না থাকলে দেশের অর্থনীতিতে তাঁরা তেমন কিছুই কনট্রিবিউট করেন না।
এবার আসা যাক উচ্চবিত্তদের হিসেবে। ধনী বলতে যা বোঝায়, সরকারি হিসেবে তাঁদের প্রত্যেকেই মাসে ২ লক্ষ টাকার উপর আয় করেন। কারণ, মোদি সরকারের মাপকাঠিই বলছে, বছরে ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত নিম্ন আয়ের নাগরিক, আর মিডল ইনকাম গ্রুপ বা মধ্যম আয়ের নাগরিকদের আয় বছরে ১৮ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ, মাসে দেড় লক্ষ টাকা। এই হিসেব ধরলে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত উপার্জন করলে তাঁকে নিম্নবিত্ত ধরাই যায়। মোদ্দা কথা হল, সরকারি মাপকাঠি বলছে, মাসে যাঁরা ২৫ হাজার টাকার নীচে আয় করেন, তাঁরা আর্থিক দিক থেকে দুর্বল। টুইস্ট কিন্তু এখানেই। কারণ দু’টি।
১) মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট কার্যকর করার পর থেকে তফসিলি জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য সংরক্ষণ শুরু হয় দেশে। তারপর তাতে যোগ হয় ওবিসি। নরেন্দ্র মোদি সরকার জেনারেল ক্যাটিগরির জন্য আলাদা একটি সংরক্ষণ নিয়ে এসেছে। তার মাপকাঠি করা হয়েছে সেই ব্যক্তি বা পরিবারের আর্থিক অবস্থাকে। যদি কেউ আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে থাকেন, তিনি এই ক্যাটিগরিতে সংরক্ষণের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে সেক্ষেত্রে এসসি, এসটি বা ওবিসির সংরক্ষণ তিনি পাবেন না। আর আর্থিকভাবে দুর্বল হতে গেলে তাঁর বার্ষিক আয় কত হতে হবে? ৮ লক্ষ টাকা। মানে মাসে প্রায় ৬৭ হাজার টাকা। যদি এই পর্যায়ের উপার্জনকারীকে আর্থিকভাবে দুর্বল ধরা হয়, তাহলে লোয়ার ইনকাম গ্রুপের মাপকাঠি কেন ২৫ হাজারি হবে? আর্থিকভাবে সত্যিই দুর্বল হলে তো তাঁর আয়কর দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু সরকারিভাবে নিম্নবিত্ত বা গরিবরা এদেশে আয়কর দিয়ে থাকেন। আড়াই লক্ষ টাকা বার্ষিক আয় টপকে গেলেই তাঁকে ৫ শতাংশ হারে ট্যাক্স দিতে হয়। যাঁর আয় ৫ থেকে ১০ লক্ষ টাকা, তাঁকে দিতে হয় ২০ শতাংশ আয়কর। সঙ্গে যোগ হয় আগের স্ল্যাবের সাড়ে ১২ হাজার টাকা। তৃতীয় স্ল্যাব, অর্থাৎ ১০ লক্ষ টাকার বেশি আয় হলে ১ লক্ষ ১২ হাজার টাকার সঙ্গে ইনকামের ৩০ শতাংশ টাকা ট্যাক্স দিতে হয় ভারতীয় নাগরিককে। সরকারের হিসেবে নিম্ন মধ্যবিত্তের আয় হওয়া উচিত ৬ থেকে ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। এই শ্রেণির একাংশকে সরকারই ‘আর্থিকভাবে দুর্বল বলছে।’ তারপরও তাঁদের থেকে এই বিপুল হারে আয়কর কেটে নেওয়ার যুক্তি কী?
২) দেশের গরিব জনগণের মাপকাঠি স্থির করার আর একটি উপাদান হল প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা। গ্রামীণ আবাস প্রকল্পে সরকার কিন্তু ঠিক করেছে, পারিবারিক আয় ১০ হাজার টাকার বেশি হলে কোনও ব্যক্তি এই যোজনায় নাম লেখাতে পারবেন না। মানে, সরকার তাঁর বাড়ি তৈরি করে দেবে না। তাঁর বাড়িতে ফ্রিজ থাকতে পারবে না, দু’চাকার মোটরচালিত যানও নয়। এমন একটা মানদণ্ড ধরে বিচার করলে এই শ্রেণিকে গরিব বলতে অসুবিধা নেই। তাহলে বাকি মাপকাঠিগুলি এর সঙ্গে মিলছে না কেন?
এখানেই এক্সপেরিমেন্ট। আর গিনিপিগ মধ্যবিত্ত। সরকার ধরে নিচ্ছে, কোনও ব্যক্তি আড়াই লক্ষ টাকা বছরে আয় করছেন মানে, তিনি কর দিতে বাধ্য। সরকারি সুবিধার জন্য যা খুশি হিসেব থাকুক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। ওটা ভোট রাজনীতির জন্য তোলা থাক। সারা বছর কোষাগার তো ভরাতে হবে! মধ্যবিত্তরা চাকরি হারাবে, মূল্যবৃদ্ধির আঁচে পুড়বে, ধার করবে, ট্যাক্স দেবে, তারপর ভোগ্যপণ্যও কিনবে। কারণ, অর্থনীতি সচল রাখার দায় তো তাদেরই! রক্ত জল করে তারা ইনকাম করবে, আর তার একটা অংশ সরকার কেটেও নেবে। এ এক বিষম বিড়ম্বনা। তার উপর সরকারি সুবিধার আর্জি জানাতে গেলে তাদের শুনতে হবে, মশাই আপনার ক্রাইটেরিয়া মিলছে না। বাড়িতে অশান্তি, বাইরেও। মাথার উপর সুতোয় ঝুলছে তরবারি। শান্তির ঘুম? দূরঅস্ত। সমাজের আসল রূপটা দেখতে দেখতেই রাত কাটে তাদের। আর ভোট এলে শত ক্ষোভ নিয়েও লাইন দিতে হবে বুথের সামনে। মধ্যবিত্ত জানে, তারা পার্টির ভোটব্যাঙ্ক নয়... কিন্তু ভোট পাওয়ার ঘুঁটি। এই শ্রেণি সেটাই মেনে নিয়েছে।
সরকার চলছে, রাজনীতিও। নেতারা আসবেন, ভাষণ দেবেন... মধ্যবিত্তের সুরাহা হবে না। এটাই নতুন ভারতের দস্তুর। বণিকসভা থেকে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ... প্রত্যেকেই বলছেন, আয়করের স্ল্যাব বদল করুন। জিএসটি কমান। একমাত্র তাহলেই মধ্যবিত্তের হাতে টাকা আসবে। অর্থনীতির চাকা ঘুরবে। তাতে কি কান দিচ্ছে মহামান্য ভারত সরকার? এখনও তার কোনও নামগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনীতি দিয়ে ঢাকা চেহারার আড়ালে তারা সুবিধা দেবে ধনীদের, উৎকোচ তত্ত্বে ভোটব্যাঙ্ক সুনিশ্চিত করবে। নাঃ, তালিকায় জায়গা হচ্ছে না মধ্যবিত্তের।