‘গত দু’দশক ধরে পাকাপাকি শান্তি বিরাজ করছে গুজরাতে। ওদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।’ ভোটপ্রচারের চূড়ান্ত পর্বে অমিত শাহের মুখে এই ‘সাম্প্রদায়িক’ কথাগুলি কীসের ইঙ্গিত? সমঝদার মানুষ মাত্রই বলবেন, ‘ইশারাই কাফি।’ কোনও অজ্ঞাত কারণে মোদির সেনাপতি প্রচারের শেষ প্রহরে আস্থা রাখলেন সেই হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের রাজনীতিতেই। সেটা ভয়ে, না ভক্তিতে বলতে পারব না। তবে দেশের পোড়খাওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন সব শিষ্টাচার দূরে সরিয়ে সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজকে ‘ওদের’ বলে সম্বোধন করেন, তখন গোটা দলটার মাইন্ডসেটটা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। ভোট বালাইয়ের দোহাই দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের দু’নম্বর ব্যক্তি নিজেই যখন সঙ্কীর্ণ তাস খেলেন, তখন বোঝা যায় খাসতালুকে দলের জয় নিয়ে আতঙ্কটা কত তীব্র। নাহলে সংখ্যালঘু ঠান্ডা করার আস্ফালন!
প্রচার যত এগচ্ছে, ততই মনে হচ্ছে কোনও ছন্দপতনের আশঙ্কায় ভীত নরেন্দ্র মোদি! তাই উন্নয়নের দু’শো ফিরিস্তি দেরাজে সযত্নে তুলে রেখে আবার সেই কট্টর হিন্দুত্বের লাইনে ঝাঁপিয়েছে গেরুয়া শিবির। মোদি-রাজ্যে প্রথম দফার ভোটের আর ১০০ ঘণ্টাও বাকি নেই। তাই এই মুহূর্তে নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে উন্নয়ন মডেল ব্রাত্য। বিজেপির পাখির চোখ সঙ্ঘের সেই সঙ্কীর্ণ বিভাজনের রাজনীতি। ফোলানো ফাঁপানো ‘গুজরাত মডেল’ যে বাংলার সামাজিক সুরক্ষার একের পর এক প্রকল্পের সামনে নিতান্ত অসহায়, তা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে এই উচ্চকিত সাম্প্রদায়িক প্রচার। যেখানে বারেবারে উঠে আসছে অভিশপ্ত গোধরা ও দু’দশক আগে রাজ্য সরকারের সৌজন্যে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার দগদগে স্মৃতি। এবং তা থেকেই ‘ওদের’ ঠান্ডা করে দেওয়ার কীর্তির অবতারণা। সঙ্গে রয়েছে গত স্বাধীনতা দিবসে বিলকিস বানো কাণ্ডে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তদের মুক্তি ও বীরের সম্মান দেওয়া নিয়ে বিতর্ক।
এখানেই ফারাকটা স্পষ্ট। বাংলায় কিন্তু মানুষে মানুষে বিভেদ নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নির্বাচনী সাফল্য এনে দেয় লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, সবুজসাথীর মতো ৬৯টি জনকল্যাণমুখী সামাজিক প্রকল্প। রয়েছে নারীর ক্ষমতায়নের দিশারী কন্যাশ্রী। এর ঠিক বিপরীতেই দিকভ্রষ্ট অমিত শাহদের উন্নয়ন মডেল! দু’দশক আগের গোধরা কাণ্ড ও দাঙ্গার পর ক্রমাগত জয় এলেও গুজরাতে মোদি ব্রিগেডের আসন সংখ্যা কিন্তু ক্রমাগত কমেছে। উদ্বেগের কারণ জনসমর্থনের এই ভাটার টান। ২০০২, ২০০৭, ২০১২ এবং ২০১৭। বিজেপি জিতেছে যথাক্রমে ১২৭, ১১৭ এবং ১১৫টি আসন। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ভোটে অমিত শাহ হুঙ্কার ছেড়েছিলেন দেড়শো আসন জেতার, কিন্তু দল থেমে গিয়েছিল একশোরও নীচে। মাত্র ৯৯টি আসনে। বলা বাহুল্য, গুজরাতের ইতিহাসে একবারই ১৪৯ আসন জেতে কংগ্রেস। ১৯৮৫ সালে। আপাতত ওটাই রেকর্ড।
এবার ভোটের দরজায় কড়া নাড়ছে মোরবির সেতু দুর্ঘটনায় প্রায় দেড়শো মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু। এই ঘটনার গাফিলতির দায় কোনওভাবেই এড়াতে পারে না রাজ্যের বিজেপি সরকার। ‘ড্রাই স্টেট’ বলে গলা ফাটালেও গত কয়েক বছরে রাজ্যজুড়ে মদ ও মাদকের রমরমা আর এক শিরঃপীড়ার কারণ সঙ্ঘের। এর উপর আর একটা ভয়ও আছে। সেটা অঘটনের। হঠাৎ হিসেব উল্টে যাওয়ার। খেলা থেকে রাজনীতি সব মঞ্চেই এটা সমান দস্তুর। বিশ্বকাপের দৌড়ে অন্যতম ফেভারিট মেসিরা শুরুতেই হেরেছে আন্ডারডগ সৌদি আরবের কাছে। দুরন্ত জার্মানিকে হারিয়ে বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে এশিয়ার আর এক বিস্ময় জাপান। শুধু ফুটবল মাঠ নয়, ইতিহাসও বারেবারে ধাক্কা দিয়ে গিয়েছে প্রচলিত বিশ্বাস ও ধারণাকে। চমকে দিয়েছে দুনিয়াকে। সাতাত্তরের সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর পরাজয় কিংবা আঠারো বছর আগে লোকসভা ভোটে ‘ফিল গুড’ প্রচারে বাঘের পিঠে সওয়ার অটলবিহারী বাজপেয়ির গদিচ্যুত হওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে তেমন বড় অঘটন। সেরকম কিছুর আশঙ্কা কি চেপে বসেছে নরেন্দ্র মোদির মাথাতেও? আসলে বাইশ সালের এই শেষপর্বে দু’টি ফলের অপেক্ষায় দেশ ও দুনিয়া। বিশ্ব ফুটবলের সেরার মুকুট শেষ পর্যন্ত কোন দেশের মাথায় শোভা পাবে, আর গুজরাতে বিজেপির গত ২৭ বছরের নিরবচ্ছিন্ন রাজ্যপাট অক্ষুণ্ণ থাকবে কি না। এই বাধা পেরলে মোদির গুজরাতও পশ্চিমবঙ্গে বামেদের ৩৪ বছরের রেকর্ডকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলবে। সেও এক ইতিহাস তো বটে।
ঠিক সেই কারণে, সব জয় করেও ভয় কিছুতেই যেন যাচ্ছে না আধুনিক গুজরাত সম্রাটের। তিনমাস টানা চষে বেড়াচ্ছেন তাঁর চেনা রাজ্যটার অলিগলি, মন্দির ও রাজপথ। বলছেন, এই নতুন গুজরাত তাঁর হাতেই তৈরি। একথা মনে রেখে মানুষ যেন ভোট দেন! আমেদাবাদের ঝকঝকে নতুন সড়ক, সরকারি অনুদান, টাটাদের এয়ারবাস কারখানা, একের পর এক প্রকল্পের উদ্বোধন করেই ক্ষান্ত হননি তিনি। তাঁর নিত্যদিনের তোফা বিলি শেষ না-হওয়া পর্যন্ত ‘স্বশাসিত’ কমিশন নির্বাচনের দিন ঘোষণা আটকে রেখেছিল অজ্ঞাত কারণে। তবে দিল্লির সব কাজ ফেলে নেহাতই একটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটে প্রধানমন্ত্রীর এমন হাইভোল্টেজ প্রচার কবে দেখেছে দেশ? এ প্রশ্ন ওঠা কিন্তু মোটেই অসঙ্গত নয়।
বিশেষত সামনে যখন গুরুত্বপূর্ণ বাজেট। আগামী লোকসভা ভোটের আগে শেষ পূর্ণাঙ্গ আর্থিক ধারাপাতের ঘোষণা। সবাই জানে, পরের বছর নির্বাচনের দামামা বেজে গেলে হবে ভোট অন অ্যাকাউন্ট। সঙ্গে অভূতপূর্ব আর্থিক মন্দার হাতছানি। ব্যবসা, কর্মসংস্থান শিকেয়। বাজারে নগদের জোগান কম, বাড়ছে না মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। দগদগে জিএসটির আঘাত। যাঁরা আমির, তাঁরা আরও বড় ধনকুবের হচ্ছেন। অন্তত দু’জন তো বটেই। যাঁরা গরিব, তাঁরা আরও নিকষ কালো আঁধারে তলিয়ে যাচ্ছেন। তবু সব ছেড়ে তাঁর সযত্নলালিত গুজরাত মডেলের জয়গান করতেই ব্যস্ত দেশের ভালোমন্দের নিয়ন্ত্রক। তিনি ভালো করেই জানেন, প্রচারের ফানুস যতই উপরে উঠুক গুজরাতের আম জনতা, গরিব মানুষ ভালো নেই। গ্রামে তীব্র অসন্তোষ আছে। তার উপর মোরবির সেতু ভেঙে প্রায় দেড়শো মানুষের অকালমৃত্যু নিঃসন্দেহে ভোটের অন্যতম ইস্যু। তবে দ্বিধাবিভক্ত বিরোধী ভোটভাগের সবটুকু ফায়দা চেটেপুটে তুলে নিতে চান তিনি। তাই আপাতত ভোটবিভাজনই গুজরাতে বিজেপির জিয়নকাঠি।
নরেন্দ্র মোদি ১২ বছর ২৫৭ দিন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এই উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী প্রধান রাজ্যটার। তাঁর ‘গুজরাত মডেল’-এর সাফল্যের উপরই রচিত হয়েছে গত সাড়ে আট বছর দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকার কীর্তি। তাঁর সেই আত্মশ্লাঘায় ধাক্কা লাগলে আগামী চব্বিশ সালে ফের জিতে দিল্লির কুর্সিতে বসার স্বপ্নে একফোঁটা চোনা পড়ে যেতে বাধ্য। চাওয়ালার সন্তানের একটাই প্রতিজ্ঞা, নেহরু-গান্ধীদের সব কীর্তি মুছে দিতে হবে যে! সেই কারণেই ভয় কিছুতেই যাচ্ছে না দোর্দণ্ডপ্রতাপ গুজরাতি প্রধানমন্ত্রীর। অথচ, কোনও জনমত সমীক্ষা এখনও পর্যন্ত গেরুয়া ভরাডুবির কথা লেখেনি। গতবার বিজেপির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা কংগ্রেসও এবার অনেকটাই হীনবল। পাঁচ বছর আগে যে তিন নেতা গুজরাতের রাজনীতিতে ঝড় তুলেছিলেন তাঁদের মধ্যে দু’জন, হার্দিক প্যাটেল ও অল্পেশ ঠাকুর এবার বিজেপিরই পতাকার তলায়। তাঁদের কিনে নেওয়া হয়েছে বলে অসম্মান করব না, কিন্তু পর্দার পিছনে কারণটা তো রহস্যে ঢাকা। একমাত্র জিগনেশ মেভানি এখনও বিরোধী পতাকার নীচে। বরং নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গুজরাত মডেলের মিনারে আঘাত হানতে মরিয়া অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ। দিল্লি ও পাঞ্জাবের রিপ্লে আমেদাবাদের মাটিতে হলে তা হবে ভারতীয় রাজনীতির বর্তমান একমুখী স্রোতে নিশ্চিতভাবে এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা।
তবে বেশ কয়েকটা বসন্ত কাটিয়েও গুজরাতে একটা রেকর্ড এখনও মোদি-শাহদের হাতছাড়া। অমিত শাহ প্রায়ই বলেন, এবারও বলেছেন, গুজরাতে দেড়শো আসন জিতে ক্ষমতায় ফিরব। কিন্তু দু’দশক আগে, ২০০২ সালের নির্বাচনে গুজরাত দাঙ্গার পটভূমিতেও ১২৭টি আসন জিতেছিল বিজেপি। তারপর গুজরাত মডেলের আলোয় আরও তিনবার জিতলেও আসন সংখ্যা ক্রমে কমেছে। ২০১৭ সালের গুজরাত নির্বাচনে বিজেপির আসন সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৯৯! আর কংগ্রেস ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে ৭৭টি আসন জিতে। রাজ্যপাট কোনওক্রমে বাঁচলেও পাঁচ বছর আগের ওই ফল মোটেই গেরুয়া শিবিরের কাছে স্বস্তিদায়ক ছিল না। তারপরই শুরু হয় পাটীদার আন্দোলনের নেতা হার্দিক প্যাটেলকে ছলেবলে দলে টানার উদ্যোগ।
গত বিধানসভা ভোটে এই বাংলাতেও ‘গুজরাত মডেল’-এর টোপ দিয়েছিল স্থানীয় দলবদলুরা। স্বপ্ন দেখিয়েছিল ডাবল ইঞ্জিন রাজ্যের। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাতে বিন্দুমাত্র সাড়া দেয়নি। বরং নিন্দুকদের মুখে ছাই দিয়ে একুশের ভোটেও দু’শোরও বেশি আসনে জিতে প্রতিষ্ঠিত মোদি মিথকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে রাজি হয়নি বাংলার মানুষ। এবার নিজভূমেই গুজরাত মডেলের অগ্নিপরীক্ষা। ৮ ডিসেম্বরের ফল ইঙ্গিত দেবে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের গতিপ্রকৃতিরও। তাই সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে কোনও বাজি ধরতেই পিছপা নন নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড।