যোগী আদিত্যনাথ কি অনামিকা শুক্লাকে চেনেন? নাঃ, তিনি কোনও সেলিব্রিটি বা গো-রক্ষক নন, একজন ‘প্রাক্তন শিক্ষিকা’। এঁর বিশেষত্ব হল, ধাপ্পাটাকে তিনি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। একসঙ্গে ২৫টি স্কুল শিক্ষকতা করেছেন তিনি। টানা ১৩ মাস। আর সব স্কুল মিলিয়ে বেতন তুলেছেন ১ কোটি টাকারও বেশি। স্কুল ম্যানেজমেন্ট বুঝতে পারেনি, উত্তরপ্রদেশের শিক্ষাদপ্তরও না। করোনা মহামারী তখন সবে কোমর বেঁধে আসরে নেমেছে, ঠিক সেই সময় এমন নির্মম সত্যের উদ্ঘাটন। যোগীবাবার শিক্ষামন্ত্রী সতীশ দ্বিবেদী নিজেই স্বীকার করেছিলেন, ‘এমন গণ্ডগোল যে চলছে, তার কিছুই আমরা জানতাম না। মিডিয়া রিপোর্ট থেকে জেনেছি।’ এই মহান দুর্নীতি জানার পর তড়িঘড়ি অ্যাকশন নিয়েছিল সরকার। নোটিস পাঠানো হয়েছিল অনামিকা শুক্লাকে। তিনিও সশরীরে এসে ইস্তফা দিয়ে গিয়েছিলেন। এফআইআর হয়েছিল, প্রতারণার দায়ে জেলও। মনে হয়েছিল, টানটান দুর্নীতি-রহস্যের নির্লিপ্ত সমাপ্তি। কিন্তু সত্যিই কি তাই? মাঝে ঠিক দু’বছর। মাস কয়েক আগেই নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তরপ্রদেশ এসটিএফের এক অফিসার বলেছেন, ‘২ হাজার ৪৯৪ জন শিক্ষক ভুয়ো। এই সংখ্যাটা জেনারেট করেছে মাত্র তিন বছরে। প্রত্যেকেই চিহ্নিত হয়ে গিয়েছে। ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জেনে রাখবেন, এটা হিমশৈলের চূড়ামাত্র’। বিজেপি সরকারের পুলিস বা এসটিএফ খুব দক্ষ। সর্বদা সক্রিয়। হোক না নিয়োগ দুর্নীতি, তার জন্য কেন্দ্রীয় এজেন্সি ডাকার দরকার নেই। এরাই তদন্ত করে দিচ্ছে। দেবেও। যতদিন সরকারে বিজেপি আছে।
* * *
‘প্রশ্নপত্র বিক্রি আছে ভাই?’
কোনও মক টেস্ট বা এবিটিএ টেস্ট পেপার নয়, উত্তরাখণ্ড রাজ্য সরকারি চাকরি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। চাকরির বিজ্ঞপ্তি বেরনোর আগে থেকেই শুরু হয়েছে কোমর বাঁধা। লিস্ট আগে থেকেই তৈরি। তবে নোটিফিকেশন প্রকাশের পর ক্যান্ডিডেট হু হু করে বাড়বে। তার জন্যও জায়গা থাকছে। খুব বেশি নয়, প্রত্যেক প্রশ্নপত্র পিছু ধার্য ১৫ লক্ষ টাকা। দরাদরি চলবে না। লখনউয়ের প্রেস থেকে নিয়ে আসতে হবে। ঝক্কি অনেক। অ্যাডভান্সড পেমেন্ট চাই।
২০১৬ থেকে উত্তরাখণ্ডে চলছে চাকরির এই ধাপ্পাবাজির খেলা। পাহাড়ি রাজ্যের আট থেকে আশি সবাই জানে, অথচ বিজেপি নেতারাই নাকি জানেন না। জিজ্ঞেস করলে আকাশ থেকে পড়েন। স্থানীয়রাই যদি খবর না পেয়ে থাকেন, তাহলে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ পাবেন কীভাবে? তাঁরা তো হয়তো এটাও জানেন না যে, একই নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত রাজ্য পুলিসের দু’টি ইউনিটকে দেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তারও হয়েছে কয়েকজন। কিন্তু বাঘা বাঘা যে প্রভাবশালীদের আত্মীয়রা হেলায় চাকরি পেলেন, তাঁদের কিছু হল কি? বিজেপির ‘স্বর্গরাজ্যে’ উত্তর আন্দাজ করার দরকার নেই। আর তার জন্য পুরস্কারও নেই। পুলিস, আমলা, ক্লার্ক—সর্বত্র দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। যুবপ্রজন্ম পথে নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। তাও তদন্ত করতে সিবিআই আসেনি!
* * *
‘কর্ণাটকে সরকারি চাকরি পাওয়ার অঙ্কটা বেশ সহজ। পুরুষ হলে ঘুষ দিতে হবে, আর মহিলা হলে কমপ্রোমাইজ।’ গত আগস্ট মাসে অভিযোগটা করেছিলেন কর্ণাটক প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রিয়াঙ্ক খাড়্গে। পাওয়ার ট্রান্সমিশন কর্পোরেশনের প্রায় দেড় হাজার পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল। খাড়্গের অভিযোগ ছিল, ‘৬০০টা পদের জন্য ঘুষ খাওয়া হয়েছে। অন্তত ৩০০ কোটি টাকার কেলেঙ্কারি।’ গুরুতর অভিযোগ। স্মার্ট ওয়াচের সাহায্যে প্রশ্নপত্র লিক করার দায়ে এক পরীক্ষার্থী গ্রেপ্তারও হয়েছিল। তারপর? সিবিআই বা ইডি কিন্তু তদন্তে আসেনি। আর হ্যাঁ, অদূর ভবিষ্যতে আসার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
* * *
২০১৪ ছিল হরিয়ানায় পরিবর্তনের ভোট। বিজেপির স্লোগান ছিল, ‘বিনা পরচি, বিনা খরচি’। অর্থাৎ, সরকারি চাকরি পেতে গেলে কোনও সুপারিশ চলবে না, ঘুষও তো নয়ই। হরিয়ানার মানুষের মনে ধরেছিল প্রচারটা। কিন্তু গত সাত বছর ভোটারদের হতাশ করেছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং স্টাফ সিলেকশন কমিশন—সরকারি নিয়োগের প্রধান দুই খুঁটিই জড়িয়েছে কেলেঙ্কারিতে। এ এবং বি গ্রুপের অফিসার হোক, কিংবা সরকারি দপ্তরের শূন্যপদ, সর্বত্র দেদার দুর্নীতি। একের পর এক চাকরির পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি জারি, আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তা বাতিলও হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের নম্বরে হেরফের, ওএমআর শিট বদলে দেওয়া, প্যানেল বদল... প্রতি সেক্টরেই এ রাজ্য পাশ করেছে ডিস্টিংশন নিয়ে। গ্রেপ্তার হয়েছে অনেকেই। কিন্তু তারাই কি রাঘব বোয়াল? নাঃ, কারণ সেইসব কর্তাব্যক্তিদের কেউ ছুঁতে পারেনি। বা ছুঁতে চায়নি। রাজ্য পুলিসের তদন্তে তাঁরা হয়তো বিশেষ ইমিউনিটি পেয়েছেন এবং নিঃশব্দে চলে গিয়েছেন অভিযোগের আড়ালে।
* * *
শ্রদ্ধেয় নরেন্দ্র মোদিজি,
ভোটের প্রচারে হোক বা সরকারি অনুষ্ঠানে, বারবার আপনি বলে থাকেন, দুর্নীতির ব্যাপারে আপনার সরকার জিরো টলারেন্স। অর্থাৎ, এক পয়সার দুর্নীতি হলেও আপনি কঠোরতম ব্যবস্থা নেবেন। প্রয়োজনে সিবিআই-ইডি তদন্ত করবে। শাসক-বিরোধী নির্বিশেষে শাস্তি হবে। গত আট বছর ধরে এই কথাগুলো শুনে আমাদের কারও কারও ধারণা হয়েছিল, সত্যিই বোধহয় বিজেপির শাসনে অনিয়মের জায়গা নেই। আমরা বিরোধী রাজ্যে বাস করি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপির রাজ্য শাসন ঠিক কেমন হয়, তা আমাদের জানা নেই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি যা দেখা যাচ্ছে, আগামী ১০ বছরেও তেমন সম্ভাবনা নেই। তাই আমরা মন দিয়ে শুনি ডাবল ইঞ্জিন রাজ্যের সাফল্যের নামচা। আপনি বলেন। বারবার। নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে গত কয়েক মাসে বাংলায় তোলপাড় চলছে। প্রাক্তন মন্ত্রীর এক পরিচিতের ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে। দলিল-টলিলও মিলেছে বলে দাবি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের। মানুষ বিশ্বাস করে, বাংলায় চাকরি পাইয়ে দেওয়া নিয়ে কেলেঙ্কারি একটা হয়েছে। গোটা দেশের মিডিয়া এই খবর কভার করছে। বড় বড় করে ছাপছে। তা ছাপুক। ক্ষতি নেই। নির্বাচিত সরকারের কোনও প্রতিনিধি অনিয়ম করলে তার কুকীর্তি ফাঁস হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই আবহেই একটা প্রশ্ন আপনার কাছে রাখতে ইচ্ছে করে—সব রাজ্যের জন্য এক নিয়ম নয় কেন? যে চারটি রাজ্যের উদাহরণ প্রথমে দেওয়া হয়েছে, তার প্রত্যেকটিতে আপনার দলের শাসন। দুর্নীতির বোঝায় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। নামমাত্র তদন্ত চলছে সর্বত্র। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ওই খবরগুলো প্রথম সারির জাতীয় মিডিয়া মহলে খুব চর্চিত নয়। গত কয়েক বছরে একবারের জন্যও হরিয়ানা বা উত্তরাখণ্ডের মতো রাজ্যের পাহাড়প্রমাণ কেলেঙ্কারি নিয়ে মারমার কাটকাট হয়নি। সংবাদমাধ্যমের ওই একাংশ হয়তো ভেবেছে, এই খবর ফলাও করে প্রচার করলে আপনি রুষ্ট হবেন। যতটা সম্ভব বিজেপির দুর্নীতি তারা চাপা দিয়ে রেখেছে এবং এখনও রাখছে। এরা বোঝে না, আপনি তো দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্স! সত্যিটা সামনে এলে মোটেও আপনার রাগ হবে না। বরং আপনি সাধুবাদ দেবেন এবং কঠোর ব্যবস্থা নেবেন দোষীদের বিরুদ্ধে। আপনার ওইসব ডাবল ইঞ্জিনের প্রশাসকরাও তেমন! এক একটা অনিয়মের চূড়া দেখা গিয়েছে চার-পাঁচ বছর আগে। চুনোপুঁটিরা গ্রেপ্তার হয়েছে। বিরোধীরা বারবার দাবি করছে, পুলিস আসল দোষীদের মহান কাজকর্ম ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছে... তারপরও কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে তদন্ত করানোর কথা তাদের মনে হয়নি। আদালত বলেনি, হরিয়ানা বা কর্ণাটকের নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিলাম। তাই হিমশৈলের চূড়া দেখেই আমরা খুশি। আপনার দলের খোলকরতাল বাজানেওয়ালারাও উদ্বাহু হয়ে নাচছে আর বলছে, এই দেখো... বিজেপি সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। সত্যিই কি তাই? তাহলে ছোট ছোট রাজ্যগুলির হাজার হাজার ছেলেমেয়েরা পথে নেমে কেন বিক্ষোভ দেখাচ্ছে? কেন তারা বলছে, ঘুষের নিয়োগ বন্ধ করো? তার মানে ঝুড়ির উপর যে শাকগুলো দেখা যাচ্ছে, সে সব ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়। আপনার হাতে তো দেশের তামাম গোয়েন্দা সংস্থা... আপনি যদি কোনও বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেন, তারা ২৪ ঘণ্টায় রিপোর্ট দিয়ে দেবে। দয়া করে তাদের নির্দেশ দিন। সম্পূর্ণ বিষয়টা আপনি জানলে বহু যোগ্য প্রার্থীর সুরাহা হবে। বাংলায় বিরোধী দলনেতা হাত গুনে বলে দেন, অমুকের বাড়িতে তল্লাশি হবে, তমুক গ্রেপ্তার হবে। এজেন্সিও সেই পথে চলে। তাহলে উত্তরাখণ্ডের বিরোধী নেতা, কংগ্রেসের ভুবনচন্দ্র কাপরি যখন বলেন... ‘পশ্চিমবঙ্গে শুধু শিক্ষাদপ্তরে দুর্নীতির খোঁজ পেয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সিবিআই-ইডিকে নামিয়ে দিল। আর আমাদের রাজ্যে তো প্রতিটা সরকারি দপ্তরে নিয়োগ কেলেঙ্কারি। এখানে এজেন্সি তদন্ত করছে না কেন?’ তখন কিন্তু তাঁর কথা শোনা হয় না। নিন্দুকে বলে, বিজেপি হলেই ছাড়। নিশ্চয়ই তা নয়! আমরা বিশ্বাস করি, আপনি এর কোনওটাই জানেন না। জানলেই ব্যবস্থা হবে। আমাদের রাজ্যে কিন্তু নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি হলেই কেউ না কেউ মামলা করে তা স্থগিত করে দেয়। এক হাজার প্রার্থী যদি দুর্নীতির শিকার হয়ে থাকেন, তার জন্য ভুগতে হয় লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতীকে। আপনি বোধহয় এটাও জানেন না। আপনি বারবার বলেন, রাজনীতির থেকে মানুষ ঊর্ধ্বে। আশা করি সবটা জানার পর আপনি নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবেন। আইন এবং নিয়ম সবার জন্য এক হবে। লোকসভা ভোট আসছে। অন্তত রাজনীতির এই ভরা মরশুমে সাধারণের দিকে মুখ তুলে চাইবে সরকার। এটাই প্রার্থনা।