বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

তিন বছরের শিশুর ‘জন্মদিন’ নিয়েও রাজনীতি?
হিমাংশু সিংহ

গত বিধানসভা ভোটে ছিল শাসক তৃণমূলের নেতা কিনে বাজিমাতের চেষ্টা। এবার যেনতেনপ্রকারেণ জেলে ভরার দাওয়াই। সঙ্গে একের পর এক কেন্দ্রীয় প্রকল্পে টাকা বন্ধ করার অগণতান্ত্রিক ফরমান। বিজেপি বেশ বুঝতে পারছে বাংলায় তাদের পায়ের তলার চোরাবালি ক্রমেই আরও গভীর হচ্ছে। ভোটারদের মনের তল না পাওয়ার টালমাটাল কিসসায় বঙ্গে দল ও সংগঠন ডুবছে। ফলে দলবদলু নেতা কর্মীরা তৃণমূলের ঘরে আর সিপিএমের ক্যাডাররা পুরনো শিবিরে ফেরত যাচ্ছে অক্লেশে, যাকে বলে গেরুয়া দলের একেবারে স্বখাত সলিলে অবস্থা। একের পর এক অর্থনৈতিক অবরোধ এবং সব এজেন্সি লাগিয়ে শাসকদলের নেতা, মন্ত্রীদের বন্দি করেও লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। তাই হতাশায় রাজনীতি ছেড়ে ব্যক্তি আক্রমণের পথকেই বেছে নিয়েছে দলবদলু কেষ্টবিষ্টুরা। তিন বছরের এক শিশুর জন্মদিন নিয়ে মিথ্যে টুইট করতেও বাধছে না তিন দশকেরও বেশি রাজনীতির ময়দানে থাকা নেতার। স্রেফ দিল্লির নেতাদের কাছে নম্বর বাড়াতে এত নীচে নামা কি শোভা পায়! এত নিম্নরুচির কথাবার্তা বাংলার রাজনীতিতে আমদানি করার দায় কিন্তু গেরুয়া শিবিরকে আজ নয় কাল নিতেই হবে।
কথায় বলে ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও।’ স্রেফ একটি আপ্ত বাক্য নয়, নির্মম শিক্ষাও বটে। রাজনীতির দৈনন্দিন ওঠাপড়াতেও তা সমান সত্য। কিন্তু ইদানীং হরেক কিসিমের ক্ষমতা দখলের কারবারিরা কোনও নীতি আদর্শ মানেন না। ফলে বারেবারে লঙ্ঘিত হয় সুস্থ রাজনৈতিক বিতর্কের পরিসর থেকে বৃহত্তর সমাজের ন্যূনতম চাহিদাটুকু। বঙ্গ রাজনীতিও মোটেই এর বাইরে নয়। সেই কারণে কলুষিত হচ্ছে গোটা পরিমণ্ডল। বেরিয়ে আসছে গা ঘিনঘিনে গন্ধ, যা একান্তভাবেই এই বাংলায় ছিল না কোনওদিন!
মনে আছে, ‘বঙ্গেশ্বর’ জ্যোতি বসুর জন্মদিন এই কলকাতায় পালিত হতো অত্যন্ত ধুমধাম করে। একবার নয়, বহুবার তার সাক্ষী থেকেছি আমরা। সুভাষ চক্রবর্তী তাঁর রাজনৈতিক গুরুর বয়সের সমান ওজনের কেক নিয়ে প্রতি বছর ৮ জুলাই ঘটা করে হাজির হয়ে যেতেন ইন্দিরা ভবনের দরজায়। আয়োজনের দায়িত্বে থাকত ‘পথের পাঁচালি’। সঙ্গে যেত কয়েকশো স্কুলের ছেলেমেয়ের বর্ণাঢ্য মিছিল। ঘিরে থাকতো পুলিস, নামকরা অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা। শুনেছি, জ্যোতি বসু স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তারিয়ে তারিয়ে তা উপভোগ করতেন অনেকটা সেকেলে জমিদারদের মতো। বিকেলেও নিভৃতে চলত শুভেচ্ছা জানানোর পালা। বয়স যাই হোক, এভাবে জন্মদিন পালনে তো কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। সমালোচনারও কিছু থাকতে পারে না। কেউ রাজনৈতিক পরিসরে সেকথা কখনও তোলেওনি। পুরো ব্যাপারটা কতটা কমিউনিস্টসুলভ সেই প্রশ্নও ওঠেনি। শত বিরোধিতা সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বিরোধী নেতা-নেত্রীরা জ্যোতিবাবুর জন্মদিন পালন  নিয়ে কোনওদিন তেমন হইচইও করেননি। কত পুলিস হাজির, কটা গাড়ি পাহারায়, তার বিচারও হয়নি কখনও। মিথ্যে টুইট করা তো দূর অস্ত! কিন্তু ইদানীং সৌজন্য, ভদ্রতা ও যাবতীয় শিক্ষা-সংস্কারকে দূরে সরিয়ে শুধু অসভ্য আক্রমণই রাজনীতির পাথেয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমনকী মিথ্যে টুইটও। 
হালে গত এক সপ্তাহ ধরে তিন বছরের এক শিশুর জন্মদিন পালন নিয়ে নোংরা রাজনীতি শুরু হয়ে গিয়েছে। কেন? তাঁর পিতা এই মুহূর্তে বাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা বলে? নাকি তাঁর ও তাঁর দলের সঙ্গে এতকিছুর পরও সরাসরি লড়াইয়ে পেরে ওঠা যাচ্ছে না বলে? একে তো রাজনীতি বলে না, ব্যক্তিগত ঈর্ষা বলে। আর কে না জানে হতাশা থেকেই ঈর্ষার জন্ম। অথচ খবর নিয়ে জানা গেল, সেদিন জন্মদিনের কোনও অনুষ্ঠানই ছিল না। ছিল ডায়মন্ডহারবারের সদ্যোজাত এক ফুটবল ক্লাবের সাফল্য ও অগ্রগতি উদযাপনের উৎসব। সেখানে ডায়মন্ডহারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতি মোটেই বিস্ময়কর কোনও ব্যাপার হতে পারে না। বরং তিনি এই কৃতিত্ব দাবি করতেই পারেন যে তাঁর সৌজন্যেই একটা নতুন দলের পথচলা শুরু হয়েছে ফুটবল পাগল বাংলায়। জেলার এমপি গেলে দু-দশজন পুলিসকর্তা সেখানে থাকবেন, একথা বলাই বাহুল্য। তারপর যদি তিনি রাজ্যের শাসক দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হন, তাহলে তো কথাই নেই। সেখানে নতুন ক্লাবের কিছু নামকরা খেলোয়াড়ও উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সংবর্ধিত করা হয়। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করলাম, ক্লাবের অনুষ্ঠানকে বেমালুম একটি শিশুর জন্মদিনের সঙ্গে জুড়ে মিথ্যে কটাক্ষ করা হল। কত পুলিস, কত বাজনা তা নিয়ে নিম্নরুচির এই কটাক্ষ কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ করতে পারে কি? ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গল্পের গোরুকে গাছে তুলে দেওয়ার মধ্যে কোনও বাহাদুরি নেই। এটা একটা দুষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি মাত্র। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত হতাশারও বহিঃপ্রকাশ। ভুললে চলবে না, যতই বীরত্ব দেখান তাঁর অতীত কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাঁর প্রবীণ পিতা তৃণমূলের টিকিটে জয়ী এমপি। তাঁর পারিবারিক সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্য তৃণমূলের আমলে যে বেড়েছে, তা সবারই জানা। এই পরিবারটির উত্থানের পিছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা অস্বীকার করে, সব ফুল মোদির চরণে অর্পণ করলে, তা নিঃসন্দেহে অকৃতজ্ঞ মানসিকতারই পরিচয় বহন করে। 
ওই যে বললাম, এর সবটাই চরম হতাশা থেকে তৈরি হয়েছে। একুশের বিধানসভা ভোটের বিপর্যয় কাটার কোনও দিশা নেই। উল্টে আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে জেলায় জেলায় গেরুয়া দলের নিচুতলার প্রতিনিধি খুঁজতে হিমশিম অবস্থা। সঙ্গে গা-ঝাড়া দেওয়া বামেদের ভোটবৃদ্ধি সঙ্কটে ফেলেছে। বাধ্য হয়ে তাই টেট পরীক্ষার্থীদের পর্যন্ত ভোটে দাঁড়ানোর টোপ দিতে হচ্ছে। কিন্তু এক শিশুর জন্মদিন ঘিরে মিথ্যে রটিয়ে রাজ্যেরই একজন পোড়-খাওয়া নেতা যা করলেন, তাকে আর যাই হোক সভ্যতার উদাহরণ বলা যায় না। 
এইখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এখনও অন্যদের কয়েক যোজন দূরত্ব। অনবধানতাবশত দলের বিধায়ক অখিল গিরি রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু সম্পর্কে কিছু কটু মন্তব্য করেছিলেন। প্রকাশ্যে একজন জনপ্রতিনিধির ওই কথা বলা উচিত হয়নি। এটা অবাঞ্ছিত এবং অপরাধ। সেজন্য দল তাঁকে ভর্ৎসনাও করেছে। ভবিষ্যতে এরকম ঘটনা আর ঘটলে কঠোরতম শাস্তি হবে বলেও সতর্ক করা হয়েছে তাঁকে। এমনকী, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে অখিলের ওই মন্তব্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনাও করেছেন। প্রমাণ করেছেন, শুধু সড়ক কাঁপানো আন্দোলন নয়, ক্ষমা চাইতে গেলেও বুকের পাটা লাগে। নিছক দলবদলু এলেবেলেদের ওই হিম্মত থাকে না। সেই কারণেই পৃথিবীর বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বলে যারা নিজেদের দাবি করে, সেই বিজেপি একজন শিশুর জন্মদিন নিয়ে অসত্য প্রচারের পর ক্ষমা চাওয়া দূর অস্ত, সামান্য দুঃখ প্রকাশটুকুও করেনি। রাজ্যের আদিবাসী মহিলা মন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদার প্রতি যে অন্যায় কটাক্ষ ছুড়ে দেওয়া হয়েছে, তার জন্যও কি গেরুয়া শিবিরের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল না?
এখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিম্মত ও সৎ সাহসের প্রশংসা করতে হয়। তিনি কিছু আড়াল করেননি। ভুল তো ভুলই। অখিল গিরির মন্তব্য সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই দলের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু তিন বছরের এক শিশুর জন্মদিন নিয়ে টুইটে মিথ্যাচার করেও ক্ষমা চাইতে বা দুঃখপ্রকাশ করতে মহান গেরুয়া নেতাদের পা কাঁপে। গলা ধরে আসে। কেন? 
একে তো দেশের সমস্যা ও সঙ্কট লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জীবনকে দুঃসহ যন্ত্রণায় ভরিয়ে দিয়েছে। কাজ নেই, ব্যবসা মার খাচ্ছে। তবু গেরুয়া নেতাদের আক্কেল ফেরে না। তারা ভাবছেন, শুধু এজেন্সি লাগিয়ে আর উদয়অস্ত তৃণমূলের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে এরাজ্যে ক্ষমতায় আসবেন! কিন্তু, মানুষ যে সজাগ। তারা জানে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, সবুজসাথী সহ ৬৯টি জনহিতকর প্রকল্প অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে। এই কঠিন সময়ে গরিবের পাশে দাঁড়াবার কেউ থাকবে না। তাই ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের মতো এবার পঞ্চায়েত ভোটেও গেরুয়া দলটাকে খালি হাতে ফিরতে হবে। রাম-বাম জোট করেও লাভের লাভ কিছুই হবে না। বাংলার মানুষ ভুল ক্ষমা করতে প্রস্তুত, কিন্তু মিথ্যার বেসাতি, প্রবঞ্চনা সহ্য করতে নারাজ।

20th     November,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ