বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মার খেয়েছে ভোটে, তাই
বাংলাকে মারছে ‘ভাতে’
তন্ময় মল্লিক

বাজারের ব্যাগ হাতে বাড়ি ফিরছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুরের সুন্দিপুর গ্রামের গৃহবধূ সীমা মাজি। বিধানসভা নির্বাচনে এই সুন্দিপুর বুথের প্রায় ৯৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি। ভোট মেরুকরণের এমন নজির শুধু মুর্শিদাবাদ জেলায় কেন, রাজ্যে পাওয়াও বেশ কঠিন। সেই গ্রামের ভোটার সীমা মাজির মুখে হাসি ফোটে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের কথায়। এক গাল হেসে বলেন, ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা পাচ্ছি। রেশনের চালও পাচ্ছি।’ কিন্তু একশো দিনের কাজের প্রসঙ্গ তুলতেই তাঁর মুখ ভার। বললেন, ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। খুব কষ্টের মধ্যে আছি। রেশনের চাল আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকাই এখন ভরসা। কোনও রকমে চলছে সংসার।
প্রায় বছর ঘুরতে চলল ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। তা নিয়ে হচ্ছে রাজনীতি। কিন্তু পোড়া পেট তো রাজনীতি বোঝে না। সে শুধু চেনে অন্ন। হাঁস, মুরগি, ছাগল পুষে সেই উদরপূর্তির চেষ্টা চলছে গ্রামে গ্রামে। শুরু হয়েছে ‘বিকল্প আয়ে’র সন্ধান। অগ্রদ্বীপ পঞ্চায়েতের পলাশী গ্রামের মুর্শিদা বিবি, রিজিয়া শেখ, কতবানু শেখরা সেই উদ্দেশ্যেই গিয়েছিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে। এঁরা সবাই স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যা। ঠিক করেছেন, ছাগল পুষে সচল রাখবেন সংসারের চাকা।
শুধু মুর্শিদাবাদ, পূর্ব বর্ধমান বা বীরভূম নয়, ১০০ দিনের কাজ বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছে গোটা বাংলা। লক্ষ লক্ষ খেতমজুর, গরিব পরিবার এক অসহনীয় অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। রাজনীতির জাঁতাকলে পেষাই হচ্ছে রাজনীতিকদের তৈরি করা আইন। কোনও জবকার্ডধারী কাজের জন্য আবেদন করলে ১৫ দিনের মধ্যে কাজ দিতে হবে, এটাই নিয়ম। কিন্তু গেরুয়া শিবিরের ‘প্রেসার পলিটিক্সে’র সৌজন্যে লঙ্ঘিত হচ্ছে সেই আইনও। হাতে মারতে না পারলে ভাতে মারার কৌশলটা বহুদিনের। সেই নীতিতেই কি ‘ভোটে’ মারতে না পেরে বাংলাকে ‘ভাতে’ মারা শুরু হয়েছে? প্রশ্নটা কিন্তু দিন দিন জোরালো হচ্ছে।
এরাজ্যে জবকার্ডধারীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮ লক্ষ। এঁরা গরিব এবং খেটে খাওয়া মানুষ। প্রায় প্রত্যেকেই পঞ্চায়েত থেকে ১০০ দিনের কাজের টাকা পাবেন। তাঁরা এলাকার উন্নয়নে শ্রম দিয়েছেন, কিন্তু পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। রাজ্য সরকারের হিসেব অনুযায়ী সেই বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৬৭৪৩ কোটি টাকা। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টাইট দিতে গিয়ে গরিবের পেটে মারছে ‘লাথি’।
গরিব মানুষের হাতে টাকার জোগান নেই। গ্রামবাংলার অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়েছে মারাত্মক। একটা সময় গ্রামগঞ্জের দোকানগুলোয় বিকেল থেকেই ভিড় জমত। সন্ধ্যায় গমগম করত। তার রেশ থাকত রাত পর্যন্ত। আর এখন? সন্ধে নামতে না নামতেই বাজার ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যায় সালারের বাজারেও লোকজন নেই। অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। ঘড়িতে তখন সাড়ে ৬টা। দক্ষিণখণ্ড বাস স্ট্যান্ডের অবস্থা আরও খারাপ। একটিমাত্র সাইকেলের দোকান খোলা। বাকি সব বন্ধ। বিমল মণ্ডল মাংসের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করতে করতে বলেন, বাজারের অবস্থা খুব খারাপ। ১০০ দিনের কাজ নেই। মানুষের হাতে পয়সা নেই। বাজারে এসে কী করবে? বাজার আসা মানেই তো খরচ।
ভিড় কমছে পঞ্চায়েতেও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দুয়ারে সরকার’ চালু করার পর পঞ্চায়েতের কাজ হালকা হয়েছে অনেকটাই। এখন আর বাম আমলের মতো ব্যক্তিগত একটা কাজের জন্য মানুষকে 
বারবার পঞ্চায়েতে ছুটতে হয় না। খেতে হয় না নেতাদের মুখ ঝামটা। কারণ ‘দুয়ারে সরকার’ ক্যাম্পেই পূরণ হয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ চাওয়া-পাওয়া। এই পরিস্থিতিতে গরিব খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সেতুবন্ধনের ভূমিকায় ছিল ১০০ দিনের কাজ। এলাকার ড্রেন সংস্কার, পুকুর খনন, রাস্তার মেরামতির কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য গরিব মানুষরা পঞ্চায়েত সদস্য ও প্রধানের কাছে ভিড় জমাতেন। জীবনে সম্পর্ক তৈরির মূল ভিত্তিই হল চাওয়া-পাওয়া। প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেখানেও ধরেছে চিড়। তাতে গরিব মানুষ কষ্টে দিন গুজরান করলেও খুশি বিরোধীরা।
করোনার জন্য গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ধাক্কা খেয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদরা গরিব মানুষের হাতে টাকার জোগান বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁদের মতে, মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার এটাই হল সহজতম রাস্তা। সেই উপদেশ মানায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিরোধীদের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে ‘পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি’ করার কটাক্ষ। তবে, মোদিজির সরকার হাঁটছে সম্পূর্ণ বিপরীত রাস্তায়। গরিব মানুষের হাতে টাকা দেওয়ার বদলে চলছে আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা। বিশেষ করে বাংলায়। তারজন্য কখনও দুর্নীতি, কখনও সরকারি গাইড লাইন, কখনও প্রকল্পের নাম বদলের অজুহাতকে সামনে আনছে। 
১০০ দিনের কাজ বন্ধ থাকায় রাজ্যের গরিব মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। সেটা উপলব্ধি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত ৫ আগস্ট দিল্লিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। দাবি ছিল, তদন্ত চলুক কিন্তু চালু হোক ১০০দিনের কাজ। অনুরোধে চিঁড়ে ভেজেনি। একই দাবিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তৃণমূল সাংসদরাও। কিন্তু লাভ হয়নি। ৭ নভেম্বর রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে দিয়েছিলেন যাবতীয় তথ্য। কিন্তু তাতেও বরফ গলেনি।
কেন্দ্রীয় সরকারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকার এপর্যন্ত ১১টি চিঠি দিয়েছে। তার মধ্যে আটটিই হচ্ছে ‘অ্যাকশন টেকেন’ রিপোর্ট। কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকার কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা বিস্তারিত জানানো হয়েছে। প্রদীপবাবুর দাবি, কেন্দ্রীয় সরকারের চাহিদামতো সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারপরেও প্রকল্পের টাকা দেয়নি। 
১০০ দিনের কাজের অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে কেন্দ্রীয় টিম এরাজ্যে দু’দফায় আসে। ২০২১ সাল পর্যন্ত কাজের জন্য ৫কোটি ৩৭ লক্ষ টাকা ও ২০২২ সালে ১৫টি জেলা থেকে ৪২ লক্ষ টাকা উদ্ধার করার নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় টিম। এছাড়াও রাজ্যের সোশ্যাল অডিটে  আরও প্রায় আড়াই কোটি টাকার অনিয়ম সামনে আসে। সব মিলিয়ে সেই টাকার পরিমাণ প্রায় ৮কোটি ২৮ লক্ষ। এখনও পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ২কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা। বাকি টাকা উদ্ধারের কাজও চলছে।
এরাজ্যে ১০০ দিনের কাজে অনিয়ম হওয়া কর্মদিবসের সংখ্যাটা কত? রাজ্যের হিসেব অনুযায়ী, ২০২১-’২২ অর্থবর্ষে ৩৬ কোটি ৪২ লক্ষ কর্মদিবস সৃষ্টি হয়েছে। তারমধ্যে কেন্দ্রীয় টিম ২০হাজার ১৬১টি এবং রাজ্যের সোশ্যাল অডিট ১ লক্ষ ১৬ হাজার শ্রমদিবসের দিকে আঙুল তুলেছে। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ১লক্ষ ৩৭ হাজারের বেশি নয়। যা মোট শ্রমদিবসের মাত্র ০.০৩৭ ভাগ। আর এই তথ্যকে হাতিয়ার করেই ১০০দিনের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্র। এরপরেও ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’র তত্ত্ব সামনে আনাটা কি খুব ভুল হবে?
বিজেপি ভাবছে, ১০০ দিনের কাজে টাকা বন্ধ করে দিলে গরিব মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর ক্ষেপে গিয়ে ঝুঁকবে গেরুয়া শিবিরের দিকে। পঞ্চায়েত ভোটে কিছু কিছু জায়গায় বিজেপির এই গেমপ্ল্যান সফল হলেও হতে পারে। কিন্তু শুধু কিছু ভোট পাওয়ার আশায় ১০০ দিনের মতো একটা জনপ্রিয় সামাজিক প্রকল্পকে গোটা রাজ্যে বন্ধ করে দিতে হবে? দুর্নীতি যারা করেছে, তাদের ঘাড় ধরে জেলে ঢোকানো হোক, কিন্তু লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের পেটে লাথি মারা হচ্ছে কেন? একটা বা দু’টো পরীক্ষা কেন্দ্রে গণটোকাটুকি হলে কি বাতিল করে দেওয়া যায় গোটা বোর্ডের পরীক্ষা?
আসলে রাজনীতির সর্বোৎকৃষ্ট উপাদান হল গরিব খেটেখাওয়া মানুষজন। তাদের রুগ্ণ কণ্ঠের প্রতিবাদের আওয়াজ বড়ই ক্ষীণ। বেশি দূর যায় না। সেইজন্য তারাই বারবার হয় রাজনীতির শিকার। একুশের নির্বাচনে বিজেপিকে ভোটে ‘মেরেছে’ বাংলা। তাই এবার বিজেপি বাংলার মানুষকে মারছে ‘ভাতে’। এরেই কয়, রাজনীতি।

19th     November,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ