বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

বেঁচে ফেরার আশায়
রাজ্যভাগের গেরুয়া খেলা
হারাধন চৌধুরী 

মোগল সাম্রাজ্যের অন্তিম দশায় ভারতবর্ষব্যাপী এক চরম বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সম্রাট ঔরংজেবের মৃত্যুর পর দিকে দিকে সুবেদার, মনসবদাররা হাতির পাঁচ পা দেখতে শুরু করেন। যেখানে যিনি সম্রাটের তরফে শাসনকার্যে নিযুক্ত ছিলেন, সম্রাটের ছন্নছাড়া দশার সুযোগ নিয়ে সেখানেই তিনি ‘স্বাধীন’ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তাঁরা নিজ নিজ এলাকা ভিত্তিক একটি করে ‘স্বাধীন রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হায়দরাবাদের সুবেদার নিজাম-উল-মুলক আসফ জা এবং কর্ণাটকের নবাব সাদত উল্লা খাঁ। এইভাবে ‘স্বাধীনতার জোয়ারে’ ভেসে গেল উত্তর, মধ্য, পূর্ব, পশ্চিম সারা ভারতবর্ষ। বিশাল ভূখণ্ডের নানা প্রান্তে এইভাবে গজিয়ে ওঠে ৫৬২টি প্রিন্সলি স্টেট বা দেশীয় রাজ্য। কাশ্মীর, হায়দরাবাদের মতো সুবিশাল রাজ্যের পাশাপাশি তৈরি হল বিলবাড়ি নামক এক অতি ক্ষুদ্র রাজ্যও। বিলবাড়ি রাজ্যের আয়তন এক বর্গ মাইলের কিছু বেশি মাত্র। ১৯৪১ সালে সেখানে জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২৭। ওই রাজ্যের বাৎসরিক আয় ছিল ৮০ টাকা! একটি রাজ্যের আয় হিসেবে অঙ্কটা সবকালেই অতি নগণ্য। তবু বিলবাড়ির ছিল প্রিন্সলি স্টেটের মর্যাদা! জায়গাটি বর্তমান গুজরাতে এবং তৎকালীন বরোদা এজেন্সির অন্তর্গত। এইভাবে ভারতবর্ষের ৪৫ শতাংশ জায়গা দেশীয় রাজ্যগুলির মাধ্যমে বেহাত হয়ে গিয়েছিল। যেখানে বাস করত দেশের মোট জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে বিলবাড়িই ছিল ক্ষুদ্রতম দেশীয় রাজ্য। তবে দশ বর্গ মাইলেরও কম আয়তনের রাজ্য ছিল ২০২টি। এমন ১৩৯টি রাজ্য ছিল যেগুলির প্রতিটির আয়তন পাঁচ বর্গ মাইলের কম। কমবেশি এক বর্গ মাইল ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট রাজ্য ছিল প্রায় ৭০টি।
প্রবণতাটি কিন্তু মোগল আমলের সঙ্গে বিদায় হয়নি। দিকে দিকে রাজ্যভাগের দাবি নিয়ে স্বাধীন ভারতও বারবার তোলপাড় হয়েছে। এমন দাবির নেপথ্যে থাকে গণ অসন্তোষ। এসব অসন্তোষের আঁতুড়ঘর আর্থ-সামাজিক বৈষম্য। রাজনীতি ও প্রশাসনে সব শ্রেণির সন্তোষজনক প্রতিনিধিত্ব ছাড়া সমাজে সাম্যের একটা স্বাভাবিক অভাব থাকে। যার পেটে খিদে, সে-ই জানে, খিদের জ্বালা জিনিসটা কী। এই খিদে শুধু পেটের নয়, মর্যাদারও। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সব শ্রেণির সন্তোষজনক প্রতিনিধিত্ব এইজন্যই জরুরি। আর এখানেই ব্যর্থ ভারতের রাজনীতি। এদেশের শীর্ষ নেতাদের সুরাহায় আগ্রহ সামান্যই, তাঁরা ধামাচাপা দেওয়ায় ওস্তাদ। তার ফলে, দিন পেরিয়ে যায় স্রেফ গোলেমালে, সমস্ত সমস্যাই রয়ে যায় পূর্ববৎ। বহুকাল পরে, কোনও একদিন সমস্যাগুলি সুদ-আসল একত্রে দাবি করে বসে। তখন পিঠ বাঁচাবার পক্ষে সুবিধাজনক কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন নেতারা। বিরোধীদের তরফে আশ্বাসের গুরুত্ব সবসময়ই কম। কিন্তু এই ধরনের প্রতিশ্রুতি প্রদানে শাসকরাও কম যায় না। কেন্দ্রীয় শাসক হিসেবে কংগ্রেস এবং বিজেপি বারবার এটা করেছে। কেন্দ্রীয় শাসক যখন এই কাজটি করে তখন পরিষ্কার হয় যে, গেম বের করার মতো তাস কিছু তার কম পড়েছে নিশ্চয়। 
১৯৭১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে তৈরি হয়েছে উল্লেখযোগ্য দশটি রাজ্য। ১৯৭২ সালে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তৈরি হয় মণিপুর ও মেঘালয়। সে-বছরই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের তকমা পাওয়া অরুণাচল প্রদেশ পৃথক রাজ্যের স্বীকৃতি পায় ১৯৮৭-তে। তৈরি হয় মিজোরাম রাজ্যও। এরপর ২০০০ সালে একসঙ্গে তৈরি হয় ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড এবং উত্তরাখণ্ড। সর্বশেষ সংযোজন তেলেঙ্গানা। ২৯তম রাজ্যটির সৃষ্টি ছিল ২০১৪ লোকসভা ভোটের বিরাট ইস্যু।  
ভাঙাভাঙির এই খেলা যে শেষ হওয়ার নয়, তা ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝিয়ে দেয় একাধিক রাজনৈতিক দল। তবে সবচেয়ে বেড়ে খেলে যে দলটি তার নাম বিজেপি। অনেকের মনে থাকবে, কর্ণাটক রাজ্য সরকারের মন্ত্রী উমেশ কাত্তির একটি কথা। গত জুনে তিনি আচমকা মন্তব্য করে বসেন, অদূর ভবিষ্যতে ভারতে অন্তত ৫০টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হবে! বিজেপির মতো রেজিমেন্টেড পার্টির নেতা মহোদয় নেহাত মুখ ফসকে ‘বাজে কথা’ বলে ফেলেছেন বলে উড়িয়ে এটি দেওয়া যাবে না। এই অনুমান অসংগত নয় যে, নিশ্চয় পার্টির উপরতলায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। তাতে তিনি ছিলেন কিংবা গোপন কথাটি তাঁর কানে এসেছে। এমনও হতে পারে, কথাটি ভাসিয়ে দেওয়ার নির্দেশও পেয়েছেন তিনি!
কারণ ফাইনাল ম্যাচের দূরত্ব দ্রুত কমে আসছে। অথচ বিজেপির ভিতরের হাল সুবিধের নয় এবং মোদি-শাহের জমিদারি চালের সামনে এনডিএ ক্রমশ সোনার পাথরবাটি হয়ে উঠছে। ২০২৪-এর আগেও আছে দেশজুড়ে অনেকগুলি বিধানসভার ভোট। ফটিক জলে মাছ ধরায় বিজেপির বিশ্বাস কোনওকালে ছিল না। নতুন করে হওয়াটাও কঠিন। ঐতিহাসিকভাবেই তারা ঘোলাজলের কারবারি। ‘রাম রাম’ করে কয়েক দশক কেটে গিয়েছে। তৈরিও হয়ে গিয়েছে রামমন্দির। স্বভাবতই ধার ভার দুটিই গিয়েছে ইস্যুটির। দেশে বিদেশে মন্দিরে মন্দিরে ছুটেও মোদি বুঝে গিয়েছেন, এই ইস্যু দীর্ঘ মেয়াদে লাভজনক নয়। মোদিদের বোঝা বইতে নিতান্তই অপারগ বোধহয় এবার ভগবান স্বয়ং। পাকিস্তান ও চীনকে জব্দ করার খেলার জৌলুসটাও অন্তর্হিত। অবিজেপি রাজ্যগুলিতে সিবিআই-ইডির তৎপরতার কারণও ক্রমে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে আসছে। অতএব বিজেপির জন্য জরুরি একটু ‘অন্য’ খেলা। নতুন কায়দায় জনগণনা (এনপিআর) এবং ঘুরিয়ে সিএএ কার্যকর করার ধুয়োতে যে ডিভিডেন্ড মিলতে পারে তাও ভীষণ সীমিত। অতএব নানাদিকে এনডিএ-বহির্ভূত কিছু আঞ্চলিক শক্তিকে পাশে পাওয়ার নয়া পথ রেডি রাখতে সূক্ষ্ম ধামাকা চায় গেরুয়া শিবির। কিছু ছোট রাজ্য গড়ে দেওয়ার হিড়িক হতে পারে সেটাই। কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরবঙ্গের মানচিত্রের উপর যেন লক লক করছে গেরুয়া ছুরি-কাঁচি! 
তারা কি একটিবার জানাবে, এত এত নতুন রাজ্য করে বাস্তবে কী লাভ হয়েছে মানুষের? বিশেষ করে এসসি, এসটি এবং ওবিসির? তাদের উপর সবলের অত্যাচার কতটা কমেছে? কতটা কমেছে খিদে, অপুষ্টি, অশিক্ষার যন্ত্রণা? তাদের অধিকার কতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জমির উপর, চাকরি, ব্যবসায়? নারী-পুরুষে বৈষম্য কতটা কমেছে? এসব বাস্তবে বিশেষ কিছু হয়নি বলেই নতুন নতুন রাজ্য তৈরির পুরনো দাবিই জেগে রয়েছে। ভোটের ঢাকে কাঠি পড়লেই রাজনীতির নষ্ট শ্রেণিটা চায় তাদেরকে সামনে রেখে একটা ‘ডিফারেন্ট’ খেলা খেলতে। অথচ, অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে স্বশাসন কিংবা স্বাধীনতার ভার যে কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না, তার প্রমাণ মিলতে দেরি হয়নি। 
নতুন রাজ্যগুলি আরও প্রমাণ দিয়েছে, ক্ষুদ্র মানেই সুন্দর নয়। আমরা যেন ভুলে না যাই, একদা দেশীয় রাজ্যগুলির আংশিক স্বাধীনতা মেনে নেওয়ার শর্তে ইংরেজরা সুবিধামতো তাদের প্রোটেকশন দিয়েছে আর লুটেছে যথেচ্ছ সম্পদ। লুণ্ঠনের জন্যই, দেশীয় রাজ্যের গুরুত্ব অনুযায়ী রেসিডেন্ট অথবা পলিটিক্যাল এজেন্ট রেখে দিত তারা। আসল ক্ষমতাধর ছিল ইংরেজের প্রতিনিধিরাই। রাজা, মহারাজারা ক্রমে ক্রমে রাজসিংহাসনে শোভিত রামের পাদুকায় পরিণত হন। উচ্ছিষ্ট ভোগের বিনিময়ে তাঁদের মূল কাজ ছিল ইংরেজের সেবা করা। সিপাহি বিদ্রোহ দমন পর্বে দেশীয় রাজ্যগুলির ন্যক্কারজনক ভূমিকার কথা এই সূত্রে স্মরণ করা যায়। 
সেই অর্থে ভারতে বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন হয়েছিল সম্রাট আকবরের হাতে। তাঁর মতো দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিত্বও ভবিষ্যৎ গণনায় ভুল করেছিলেন। সুবিশাল ভারতবর্ষ জুড়ে সুশাসন দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি অনুগতদের সুবেদারি, মনসবদারি দিয়েছিলেন। কিন্তু ভাবতে পারেননি, তাঁরাই একদিন বোতল থেকে বেরিয়ে দৈত্যাকার হয়ে উঠবেন এবং তাতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে দেশের অখণ্ডতা।
ভারতের মাটিতে বিভেদকামী রাজনীতি বন্ধ করার চূড়ান্ত কথাটি সম্ভবত গান্ধীই বলে গিয়েছেন। ১৯৪৪ সালে দার্জিলিঙের কিছু নেতা মহাত্মা গান্ধী এবং মহম্মদ আলি জিন্নার কাছে এক স্মারকলিপিতে দাবি করেন, দেশের প্রশাসনিক পুনর্গঠনে দার্জিলিং জেলাকে যেন স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা দেওয়া হয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, এই প্রসঙ্গে, গোর্খা লিগের কলকাতা শাখার সম্পাদককে গান্ধী লেখেন, ‘বাঙালি ও মাড়োয়ারিরা যেন তাঁদের শিক্ষা ও ধন নিয়ে এত গর্বিত না হন এবং গোর্খাদের গুরুভার বহনকারী মাত্র না ভাবেন। আমি কি তাঁদের মধ্যে সম্পূর্ণ সমতা আশা করতে পারি না? আশা করতে পারি না যে বাঙালিরা গোর্খাদের সঙ্গে জ্ঞান ভাগ করে নেবেন আর মাড়োয়ারিরা ভাগ করে নেবেন সৎ ব্যবসার গোপন তথ্যটি?’ অন্যরা কী করেছেন, তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করছি না। কিন্তু বাঙালিরা তাদের প্রদেয় অংশ দিতে কার্পণ্য করেনি। তবুও নেভেনি পাহাড়সহ উত্তরবঙ্গে অশান্তির আগুন। এজন্য নষ্ট রাজনীতি ছাড়া আর কাকে দায়ী করবেন আপনি?

16th     November,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ