‘হিন্দুত্ব অনেকটা গঙ্গার মতো। উৎপত্তির জায়গায় পবিত্র ও বিশুদ্ধ। কিন্তু সেই স্রোত যতই সাগরমুখী হয়েছে, সঙ্গী হয়েছে তার দূষণ, কলঙ্ক।’
প্রায় ১০০ বছর আগের লেখা দু’টি লাইন। হিন্দুত্বের সহজ-সরল ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। বুঝিয়েছিলেন, হিন্দুধর্মের উৎস বা পবিত্রতা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু সময়ের চাকা যত গড়িয়েছে, সমাজ এবং মানুষ নিজের মতো করে কলুষিত করেছে তাকে। ব্যবহার করেছে স্বার্থে। সামাজিক প্রতিপত্তির কুর্সি দখলে রাখতে। সাধারণ মানুষ ধর্ম জানে না, জন্ম থেকে তারা যা শিখে এসেছে, তার পুরোটাই ধর্মীয় রীতি। আম এবং আমড়ার যা ফারাক, ধর্ম এবং ধর্মীয় রীতিও ঠিক তেমন। আমাদের শেখানো হয়েছে, ঘুম থেকে উঠে সূর্য নমস্কার মানে ধর্ম, পুজোয় ফুল নিবেদন করা ধর্ম, পণ্ডিত মহাশয়দের মেনে চলা ধর্ম। আবার আমরা জেনেছি, মন্দিরে জুতো পরে ঢুকলে তা অধর্ম, গো হত্যা অধর্ম। কিন্তু কেন? সেই ব্যাখ্যা আমরা শিখিনি। আমরা বুঝিনি, এটা ধর্ম নয়, ধর্মীয় রীতি। সমাজে প্রভাব বজায় রাখতে ধর্মের কাণ্ডারীরা তার আবিষ্কার করেছে, প্রয়োজনে বদলও এনেছে। প্রাচীন যুগে এই প্রতিপত্তি ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টাই হয়তো ছিল ধর্মীয় আচার-রীতিকে মনমতো গুছিয়ে নেওয়ার একমাত্র কারণ। না হলে সমাজে সেই মহান ব্যক্তিদের গুরুত্ব থাকত না। তবে এখন আর নয়। আজকের নয়া ভারতে হিন্দুত্ব মানে বিভেদের হাতিয়ার, ভক্তকুলের সৌজন্যে পাওয়া একবুক আতঙ্ক। এবং রাজনীতি। যেমন? গোরক্ষার নামে গেরুয়া নীতি পুলিসের খুনে রূপ, অযোধ্যা বা মথুরা, আর এখন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি।
ভোট এলেই একটি করে ‘সংস্কারমূলক’ এজেন্ডা সামনে নিয়ে আসে বিজেপি। নয়ের দশক থেকে রামমন্দির ছিল তালিকার প্রথমে। টানা ২৫ বছর সেই রাজনীতির রং গায়ে মেখে ক্ষমতার বেসাতি করে এসেছে তারা। কিন্তু আর তো সেই উপায় নেই! অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জয় হয়েছে। এবার তো নতুন কিছু চাই! ঝুলি থেকে তাই বেরিয়ে এসেছে গেরুয়া শিবিরের আদি-অকৃত্রিম রাজনৈতিক এজেন্ডা—ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। কী আছে এই বিধিতে? সাদামাটাভাবে দেখলে আমাদের দেশের আইনকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়—দেওয়ানি এবং ফৌজদারি। অপরাধমূলক কাজ কারবারের ক্ষেত্রে কার্যকর হয় ফৌজদারি বিধি। কিন্তু যদি পারিবারিক বা জমিজমা সংক্রান্ত কোনও বিষয় নিয়ে গণ্ডগোল বাঁধে, সেক্ষেত্রে রয়েছে দেওয়ানি বিধি। বৈচিত্র্যের দেশ ভারতবর্ষ। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, পার্সি... বহু ধর্ম এবং তাদের নানাবিধ ধর্মীয় আচরণ। একের সঙ্গে অন্যের মিল কিছুতেই নেই। বিয়ে, বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার—প্রত্যেকের নিয়ম নীতি আলাদা। সেই মতো তৈরি হয়েছে পৃথক আইন। ১৮৩৫ সালে, ব্রিটিশ ভারতে এর সূত্রপাত। সেই সময় একটি রিপোর্ট জমা পড়েছিল। তাতে বলা হয়, অপরাধ, তথ্য-প্রমাণ এবং চুক্তি সংক্রান্ত ভারতের আইনের বিধি তৈরির প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি অবশ্য রিপোর্টে আরও জানানো হয়, হিন্দু ও মুসলিমদের পার্সোনাল ল’ যেন এর বাইরে থাকে। ব্রিটিশরা এদেশে ২০০ বছর শাসন করেছে। কিন্তু প্রথম দিন থেকে তারা ভারতের ধর্মীয় আবেগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। বারেবারে এই আবেগ কাজে লাগিয়ে তারা স্বার্থসিদ্ধি করেছে। আর তা বজায় ছিল শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত। ছোট ছোট রাজ্যগুলিকে নিজেদের মধ্যে লড়িয়ে দেওয়া, সিপাহি বিদ্রোহ, ছেচল্লিশের দাঙ্গা, ভারতকে দু’টুকরো করে দেওয়া... ডিভাইড অ্যান্ড রুলের নানা কার্যকারিতার সাক্ষী থেকেছি আমরা। অথচ, তারাই পরামর্শ দিয়েছিল, অভিন্ন বিধি আনলেও ধর্মীয় স্বাধীনতায় যেন আঘাত না লাগে। সেটা হবে ভারতের জন্য ভয়াবহ। ঠিক একইরকম দূরদর্শিতা দেখিয়েছিলেন বি আর আম্বেদকর। তাই সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত ২৫ নম্বর ধারায় তিনি রেখেছেন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের অধিকারের প্রসঙ্গ। অঙ্কটা খুব স্পষ্ট, ধর্ম যদি দেশবাসীর মৌলিক অধিকার হয়, তাহলে আইন করে সেই স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া যাবে না। সেটা হবে সংবিধান বিরুদ্ধ। সেক্ষেত্রে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি? তার উল্লেখও রয়েছে সংবিধানে। কিন্তু মৌলিক অধিকারে নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশ-নীতি বা ডিরেক্টিভ প্রিন্সিপালস অব স্টেট পলিসিতে। আম্বেদকর বলেছিলেন, অভিন্ন বিধির প্রয়োজন আছে, তবে তা সম্প্রদায়ের স্বার্থে বা অধিকারে আঘাত দিয়ে নয়। এর প্রয়োগ হবে সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, ‘সরকারের ক্ষমতা থাকলেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর করে দেওয়াটা মোটেও উচিত কাজ হবে না। মুসলিম, খ্রিস্টান বা অন্য কোনও সম্প্রদায়ের কাছে তা গ্রহণযোগ্য নাই হতে পারে।’
আমাদের নতুন ভারতের ‘প্রবর্তক ও প্রাণপুরুষ’ নরেন্দ্র মোদি। ডঃ বি আর আম্বেদকরকে তিনি আদর্শ মেনে চলেন। কথায় কথায় এই কৃতী দলিত সন্তানের প্রসঙ্গ টেনে রাজনীতির ময়দান গরম করেন। সঙ্ঘের আদি-অকৃত্রিম এজেন্ডা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে তো আম্বেদকর সর্তক করেছিলেন। তাহলে মোদিজি তাতে কান দিচ্ছেন না কেন? উত্তর সেই চিরন্তন—ক্ষমতার রাজনীতি। বিজেপি বুঝে গিয়েছে, মেরুকরণই ক্ষমতার উৎস। এবং এই অস্ত্র প্রয়োগে তারা বিলক্ষণ সফল। শতাধিকবার সংশোধনী এসেছে দেশের ফৌজদারি আইনে। আমরা জানি, অপরাধের শাস্তি সবার ক্ষেত্রেই সমান। খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ... দোষী যেই হোক না কেন, আইনের চাবুক থেকে তার রক্ষা নেই। প্রভাবশালী তত্ত্ব আছে, থাকবে... সেটা অবশ্য ব্যতিক্রম। রাজনীতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বা তাঁদের সহযোগীদের ক্ষেত্রে তা খাটে। বাকিদের জন্য নয়। আমাদের দেশ তার উপর ভর করেই একটা ভারসাম্যের জায়গায় এসে পৌঁছেছে। তাহলে দেওয়ানি বিধি বদলের কারণটা কী? তিন তালাক নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। নরেন্দ্র মোদি সরকার তার উপর আইনের বাটখারাও চাপিয়ে দিয়েছে। তাহলে এখন সব ধর্মের উপর আঘাত হেনে তাদের ধর্মীয় আচরণে শিকল পরানোর প্রয়োজন কী? এই পদক্ষেপে সমাজে টেনশন তৈরির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিরোধীরা। তীব্র বিরোধিতা চলছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির। অন্য সম্প্রদায়ের মানুষরা মনে করছে, বিজেপি গায়ের জোরে তাদের একমুখী ভাবনা চাপিয়ে দেবে সবার উপর। মোদিজি, আপনার ভাবমূর্তির জন্য এটা কি খুব ভালো বিজ্ঞাপন? কংগ্রেসের প্রতি না হয় আপনার জাত অ্যালার্জি। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীকে তো আপনি এই বৃত্তের বাইরে রাখেন (অন্তত দাবি তেমনই)! আপনার কাছে গান্ধীজি এক আদর্শ ব্যক্তিত্ব। আপনি গান্ধীজিকে উদ্ধৃত করেন, ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারি কর্মসূচির ঘোষণাও করেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, সবরমতীর ওই সন্তের কাছে ধর্মের অর্থ কী ছিল? গান্ধীজির ১৯২৪ সালের একটি লেখা উদ্ধৃত করা যায়, ‘আমাকে যদি হিন্দুত্বের সংজ্ঞা দিতে বলা হয়, তাহলে বলব: অহিংসার পথে সত্যের খোঁজ। কোনও নাস্তিকও নিজেকে হিন্দু বলতেই পারে। কারণ, সত্যের পিছনে অক্লান্তভাবে ছুটে চলাই হিন্দুত্ব।’ মোদিজি, আদর্শ ব্যক্তির মতাদর্শ মেনে চলাটাও তো কর্তব্য। তাহলে আপনার বিজেপি অহিংসার পথে সত্যের খোঁজে ছুটছে না কেন? আসলে গেরুয়া ধ্বজাধারীরা জানে, মেরুকরণ ছাড়া অন্য কোনও হাতিয়ার তাদের হাতে নেই। আমরাও হয়তো ক্লান্ত... অবসন্ন। সত্যের খোঁজে না বেরিয়ে বসে পড়েছি পথে। সহজ উপায় খুঁজছি গন্তব্যে পৌঁছনোর। কিন্তু সেই গন্তব্য কোথায়? তা কি আমরা জানি? হয়তো তালাবন্ধ কোনও এক অন্ধকার দরজার পিছনে। শাসক আমাদের বোঝাচ্ছে, ওই দরজার পিছনেই রয়েছে ‘আচ্ছে দিন’। মনে পড়ছে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের একটা গল্পের কথা। মোল্লা ঘরের বাইরের বাগানে কিছু একটা খুঁজছিলেন। পড়শি তাই দেখে প্রশ্ন করলেন, মোল্লাসাহেব, কী হারালে গো? মোল্লা বললেন, আমার চাবিটা। সে কথা শুনে লোকটাও বাগানে এসে খানিকক্ষণ চাবি খুঁজল। কিন্তু পেল না। তখন সে জিজ্ঞেস করল, ‘ঠিক কোনখানে চাবিটা হারিয়েছিলে?’ মোল্লা বললেন, ‘আমার ঘরে’। চোখ কপালে উঠল পড়শির—‘তাহলে এখানে খুঁজছ কেন?’ মোল্লার সটান জবাব, ‘ঘরটা অন্ধকার। যেখানে খোঁজার সুবিধে, সেখানেই তো খুঁজব!’
আমাদের অবস্থাটা অনেকটা ওরকম। যেখানে সুবিধা, সেখানেই হারানো চাবি খুঁজে চলছি। গেরুয়া দলবল বলছে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চাই। ওটাই চাবিকাঠি। তাহলেই আসবে ঐক্য। কিন্তু বৈচিত্র্য? ভারতবর্ষ সেটা কোন গঙ্গায় বিসর্জন দেবে? সমাজ সেই দিনটার মুখোমুখি হতে পারবে তো? আম্বেদকর এটা জানতেন। তাই তিনি দিয়েছিলেন আরও এক সাবধানবাণী, ‘শুধু ক্ষমতার বলে কোনও সরকার যদি এই বিধি কার্যকর করে, তাকে উন্মাদ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।’