বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

গরিবরা সুখী, কিন্তু তাদের সকলে নয়
পি চিদম্বরম

আইন, রাজনীতি, সাম্যের ধারণা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ভাবনা আজ এক সংযোগস্থলে এসে উপস্থিত হয়েছে—এটাই এই নিবন্ধের বিষয়।
সমসাময়িক ভারতে সামাজিক ন্যায়বিচার কীরকম এবং তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা সুগঠিত অবস্থান আমার রয়েছে। ভারতীয় সমাজে অসাম্য কতটা এবং তাতে সাম্য আনতে আমাদের আরও কত কী করতে হবে, সে সম্পর্কেও দৃঢ় ধারণা রয়েছে আমার। সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্যের সংযোগস্থলে কখনও ক্ষতি হয়েছে সামাজিক ন্যায়বিচারের, আবার কখনও তা সাম্যের বলি হয়েছে।
আইন প্রণীত হয় আইনসভায়, যেটা রাজনীতিবিদদের একটি মস্ত সমাবেশ। আইন পরিচালিত হয় এবং তার প্রয়োগ ঘটে রাজনীতির সঙ্গে সংস্রবহীন বিচারপতিদের মাধ্যমে। শাসকদের 
অবশ্যই বিচারপতিদের ভয় করতে হবে, কিন্তু বিচারপতিরা কখনওই শাসকদের ভয় করবেন না। আইন ও রাজনীতির মিলনের ফলাফল থেকেই যথাযথভাবে বুঝে নিতে হবে, একটি দেশে আইনের শাসন চলছে কি না।
চৌরাস্তার মুখে
আইন, রাজনীতি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সাম্যের সংযোগস্থলে যে দ্বিধাগুলির সম্মুখীন হতে হয়—গত ৭ নভেম্বর ‘জনহিত অভিযান’-এ প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়টি হল তার একটি চমৎকার উদাহরণ। সংবিধানের ১০৩তম সংশোধনীর বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে যে মামলা হয় তার নিষ্পত্তিতেই এই রায় দেওয়া হয়েছে, যেটা ‘ইডব্লুএস রিজার্ভেশন কেস’ নামে সমধিক পরিচিত। ইডব্লুএস মানে ইকনোমিক্যালি উইকার সেকশন বা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণি। এই নিবন্ধে, আমি তাদের ‘দরিদ্র’ বলে উল্লেখ করতে চাই। 
রায়ের উপর আমার ব্যক্তিগত মতামত ঊহ্য রেখে, এই নিবন্ধটির মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক সমস্যাগুলি তুলে ধরেছি এবং পাঠককে একটি মতামত গ্রহণের জন্য আমি অনুরোধ করছি। 
মৌলিক বিষয়গুলি
আজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি চাকরিতে অনেক ধরনের সংরক্ষণ চালু রয়েছে। এই সংরক্ষণগুলি ‘সামাজিক এবং শিক্ষাগতভাবে অনগ্রসর শ্রেণিগুলি’—অর্থাৎ তফসিলি জাতি (এসসি), তফসিলি জনজাতি (এসটি) এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিগুলির (ওবিসি) জন্য। জনগণের এই অংশগুলি সামাজিক এবং শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে থাকার কারণটি ঐতিহাসিক এবং তর্কাতীতভাবে গ্রাহ্য। সংরক্ষণকে ‘ইতিবাচক পদক্ষেপ’-এর একটি হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। এসসি, এসটি ও ওবিসির জন্য সংরক্ষণ বৈধতা এবং অনুমোদনও পেয়েছে।
এসসি, এসটি বা ওবিসির মতো কোনও সংরক্ষণের সুবিধা যাঁরা পান না, অনুমান করা যায় যে, নাগরিকদের সেই অংশের মধ্যে এই সংরক্ষণ নিয়ে ‘ক্ষোভের’ সৃষ্টি হয়েছে। এই নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা দরিদ্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন তাঁরা শিক্ষা এবং চাকরি ক্ষেত্রে একই ধরনের অসুবিধা ভোগ করেন। তাই একটি মত বেরিয়ে আসে যে, এই ধরনের গরিবদের জন্যও কি একটি নয়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে? ধারণাগতভাবে ভাবনাটি ন্যায্য হলেও কিছু বাধা ছিল:
 সংরক্ষণ প্রদানের জন্য ভারতের সংবিধান ‘সামাজিক এবং শিক্ষাগতভাবে পশ্চাৎপদ’ হওয়াটাকেই একমাত্র ক্যাটিগরি বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, দরিদ্রদের কি ওই বন্ধনীতে বিবেচনা করা যেতে পারে? 
 অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে দরিদ্রদের জন্য সংরক্ষণ কি সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামো’ লঙ্ঘন করবে?
 সমস্ত সংরক্ষণ মিলিয়ে, আইনত, ‘সিট’ বা ‘চাকরি’-র ৫০ শতাংশের বেশি হতে পারে না, ১০ শতাংশের নতুন সংরক্ষণ সেই সর্বোচ্চ সীমা 
লঙ্ঘন করবে না কি?
‘মৌলিক কাঠামো’-র মতবাদ এবং ‘৫০ শতাংশ সিলিং’-এর নীতি সংবিধানের ব্যাখ্যামূলক রায়ের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। আইনত তৈরি হওয়া বাধাগুলোকে মাননীয় বিচারপতিরা একবার দূর 
করার সিদ্ধান্ত নিলে সামনের পথ পরিষ্কার হয়ে যায়। মাননীয় পাঁচ বিচারপতিই একমত হয়েছেন যে—অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার হল সামাজিক ন্যায়বিচারের সমান এবং অর্থনৈতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে একটি নতুন সংরক্ষণ দিলে তাতে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো লঙ্ঘিত হবে না। তাঁরা আরও একমত যে, ৫০ শতাংশের সিলিং বা সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম, এক্ষেত্রে অসাংবিধানিক নয়। অর্থনৈতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে সংরক্ষণ এবং তার পরিমাণ ১০ শতাংশ রাখার ব্যাপারটিকে তাঁরা সর্বসম্মতভাবে সমর্থন করেছেন। রায়ের এই অংশটি নিয়ে মতভেদ হয়নি। যে ইস্যুতে মতামত বিভক্ত হয়েছে, সেটা হল—সংরক্ষণ এসসি, এসটি এবং ওবিসিদের মধ্যেকার গরিবদের বাদ দিতে পারে কি না।
বিভক্ত আদালত
পুষ্টি, লালন-পালন এবং প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতির প্রধান কারণ হল দারিদ্র্য। এই ঘাটতিগুলি শিক্ষা এবং চাকরিতে প্রবেশের সুযোগকে সীমিত কিংবা নস্যাৎ করে ছাড়ে। প্রশ্ন জাগে, ‘দরিদ্র কারা’? ‘পারিবারিক আয় এবং অর্থনৈতিক অসুবিধার অন্যান্য সূচক’-এর ভিত্তিতে দরিদ্রদের চিহ্নিত করার দায়িত্ব ১০৩তম সংবিধান সংশোধনী রাজ্যগুলির উপর ন্যস্ত করেছে। সিনহো কমিশনকে (জুলাই ২০১০) উদ্ধৃত করে সংখ্যালঘুর রায় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে—৩১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে 
(বিপিএল) ছিল। এদের মধ্যে এসসি ৭ কোটি 
৭৪ লক্ষ, এসটি ৪ কোটি ২৫ লক্ষ এবং ওবিসি ১৩ কোটি ৮৬ লক্ষ, অর্থাৎ মোট ২৫ কোটি ৮৫ লক্ষ বা বিপিএল জনসংখ্যার ৮১.৫ শতাংশ। ২০১০ 
সাল থেকে ধরলে, বিপিএল জনসংখ্যার মধ্যেকার এই অনুপাতের কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন 
ঘটানো যায়নি।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, অনুচ্ছেদ ১৫(৬) এবং ১৬(৬)—যার দরুন এসসি, এসটি এবং ওবিসির ভিতরে দরিদ্ররা নতুন সংরক্ষণ থেকে বাদ যায়, তা কি সাংবিধানিকভাবে বৈধ? মাননীয় বিচারপতিরা এই ইস্যুতে ৩:২ অনুপাতে বিভক্ত ছিলেন। মাননীয় বিচারপতি রবীন্দ্র ভাট একটি জোরালো ডিসেন্ট বা ভিন্নমত লেখেন, আর তাতে সম্মত হন প্রধান বিচারপতি ললিত স্বয়ং। তাঁর কথা, ‘আমাদের সংবিধান বাদ দেওয়ার ভাষা বলে না’—সুপ্রিম কোর্টের কক্ষে কক্ষে এটা বহু বছর যাবৎ প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে। আমার দৃষ্টিতে, ভিন্নমত হল—‘আইনের ব্রুডিং স্পিরিট, ভবিষ্যতের কোনও একদিনের বুদ্ধিমত্তার প্রতি আবেদন, সেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত সম্ভবত ভুল শুধরে দিতে পারে’ (প্রধান বিচারপতি চার্লস ইভান্স হিউজের মতে)।
এই ‘সম্ভাব্য উপসংহারগুলিরও’ প্রতিফলন থাক: দরিদ্রদের জন্য একটি নতুন সংরক্ষণের ব্যবস্থা অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু সংরক্ষণ থেকে এসসি, এসটি এবং ওবিসির (যারা মোট দরিদ্রের মধ্যে প্রায় ৮১.৫ শতাংশ) মধ্যেকার দরিদ্রদের বাদ দেওয়া হলে, তাতে নস্যাৎ হবে দরিদ্রদের মধ্যে দরিদ্রতমদের প্রতি সমতা এবং ন্যায়বিচার। 
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত 

14th     November,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ