বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

বিজেপির খেলাটা মুখ আর মুখোশের
তন্ময় মল্লিক

অটলবিহারী বাজপেয়ি আর লালকৃষ্ণ আদবানি জুটি তখন রাজনীতির মধ্যগগনে। রামমন্দিরকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে ভোট মেরুকরণের চেষ্টা। বিজেপির ‘মুখ’ আর ‘মুখোশে’র খেলাটা তখন থেকেই শুরু। উগ্র হিন্দুত্বের প্রবক্তা আদবানিজি ছিলেন ‘বিজেপির মুখ’। তাঁর কথায় রাজনীতির ময়দানে উঠত বিতর্কের ঝড়। তবে বিপদে পড়লেই সামনে আনা হতো উদারমনা অটলজিকে। তিনি বুঝিয়ে দিতেন ভারতবর্ষ সবার। আর কাণ্ডারী তিনিই। মুখোশের আড়ালে ঢাকা পড়ত ‘বিজেপির মুখ’। সেই খেলাটা বঙ্গে শুরু করেছেন জন বার্লা, রাজু বিস্তারা। বাংলা ভাঙার চক্রান্তের গোড়ায় দিচ্ছেন হাওয়া। আর রাজ্য গেরুয়া শিবির নিয়েছে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতি। পৃথক রাজ্যের দাবিকে সমর্থন মানে দক্ষিণবঙ্গে ধূলিসাতের পথে আরও একধাপ। আবার ছাড়তে পারছে না উত্তরবঙ্গে আসন পাওয়ার লোভ। তাই পৃথক রাজ্যের মদতদাতা দলীয় নেতাদের সমঝে না দিয়ে দিচ্ছে মদত। একই সঙ্গে সাপের ও ব্যাঙের মুখে চুমু খাওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
দ্য গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা অনন্ত রায় প্রকাশ্যে বলেছেন, কেন্দ্রীয় 
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গ্রেটার কোচবিহারকে কেন্দ্রশাসিত রাজ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি মেনে নিয়েছেন। এমনকী তাঁর হাতেই ক্ষমতা তুলে দেওয়া হবে বলেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা দিয়েছেন। তাঁর অপেক্ষা সেই সময়টুকুর।
অনন্তবাবু যে দাবি করছেন, তা মেনে নিলে উত্তরবঙ্গের মানুষ ধেইধেই করে নাচবেন, এমনটা নয়। কারণ তিনি রাজবংশীদের প্রতিনিধি। তাঁরা উত্তরবঙ্গের জনসংখ্যার একটা অংশমাত্র। সেখানে রাজবংশী ছাড়া আরও অনেক জনগোষ্ঠীর মানুষ আছেন। তাঁরা সকলে অনন্ত মহারাজের নেতৃত্ব মেনে নেবেন, এমন ভাবাটা শুধু বোকামি নয়, মহা মূর্খামি। গোর্খারা কিছুতেই গ্রেটার কোচবিহারের দাবি সমর্থন করবেন না। আবার মাঝেমধ্যেই জীবন সিং কামতাপুরী রাজ্য গঠনের দাবি জানিয়ে হাওয়া গরমের চেষ্টা করেন। ফলে সব মিলিয়ে এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। তা সত্ত্বেও কেন অসম থেকে পৃথক রাজ্যের দাবিদারদের লাগাতার ‘হাওয়া’ দেওয়া হচ্ছে? বাংলা দখলে ব্যর্থ বিজেপি কি লুটেপুটে খাওয়ার জন্য সবকিছু ‘এলো মেলো’ করে দেওয়ার প্ল্যান করছে?
কেন উঠছে এমন কথা? কারণ অনন্ত মহারাজের এই দাবির পরেও বিজেপির কোনও নেতা, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক, এমনকী দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী এনিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। উল্টে রাষ্ট্রমন্ত্রী অনন্ত মহারাজের সঙ্গে মিটিং করে হাসিমুখে ক্যামেরার সামনে ‘পোজ’ দিয়েছেন। বিজেপির প্রত্যেকে অনন্ত রায়ের দাবির প্রসঙ্গটি কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন। কারণ তাঁকে ‘মিথ্যেবাদী’ বললেই হাতছাড়া হবে রাজবংশী ভোট। আর সমর্থন করলে দু’একটি জেলা বাদে গোটা রাজ্যে বিজেপি ‘সাইনবোর্ড’ হয়ে যাবে। তাই দিলীপ ঘোষ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ‘পরে দেখা যাবে’ আর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক ‘নেক্সট’ বলে প্রসঙ্গ এড়াচ্ছেন। বিজেপি মুখে কিছু না বললেও অনন্ত মহারাজকে নিয়ে তাঁদের এখন ‘সাপের ছুঁচো গেলা’ অবস্থা।
নির্বাচন এলেই গোর্খাল্যান্ড, গ্রেটার কোচবিহার, উত্তরবঙ্গে পৃথক রাজ্য, সিএএ, জঙ্গলমহল প্রভৃতি বিষয় মাথাচাড়া দেয়। মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে খুঁচিয়ে তোলা হয় পুরনো ইস্যু। তাতে চাপা পড়ে যায় সরকারের পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতাও। লোকসভা নির্বাচন মানে কেন্দ্রীয় সরকারের জবাবদিহির পালা। কিন্তু ধাপ্পাবাজি ছাড়া এই কেন্দ্রীয় সরকার মানুষকে নতুন কিছুই দেয়নি।
সেসব কথা মাথায় রেখেই কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী জন বার্লা উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্য গড়ার দাবি জানিয়েছিলেন। অশান্তির সলতেটা তখনই পাকানো হয়েছিল। এখন চলছে তাতে বারুদ মাখানোর কাজ। এরপরেও রাজবংশী ভোট নিশ্চিত না হলে সলতে আর আগুনের দূরত্বটাও মুছে দেবে বিজেপি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনন্ত মহারাজকে পাশে বসিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলার বিভাজন তিনি মানবেন না। একই অবস্থান নিয়েছিলেন দার্জিলিংয়ের ক্ষেত্রেও। পৃথক রাজ্যের দাবিতে বিমল গুরুং হিংসার আশ্রয় নিতেই তাঁকে কৌশলে পাহাড়ছাড়া করেছিলেন মমতা। তারপর তাঁকে পাহাড়ে ফেরতও পাঠিয়েছেন। কিন্তু বিষদাঁতটা উপড়ে নিয়েছেন। বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইলে পরিণতি কী হয়, সেটা বিমল গুরুং এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
শুধু তৃণমূল নয়, রাজ্যভাগের বিষয়টি কোনও দিন সমর্থন করেনি কংগ্রেস ও সিপিএম। কিন্তু বিজেপি এই ইস্যুতে দু’মুখো নীতি নিয়ে চলছে। উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ বিজেপি সাংসদ এবং বিধায়ক জোর 
গলায় পৃথক রাজ্যের দাবি জানাচ্ছেন। তা নিয়ে হইচই হলে রাজ্য নেতৃত্ব তাকে ‘ব্যক্তিগত মতামত’ বলে এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনও কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছে না। উল্টে দিচ্ছে প্রশ্রয়।
এই অবস্থায় স্বাভাবিক প্রশ্নটি হল, বাংলা ভাগ নিয়ে বিজেপির স্ট্যান্ড কী? কেন তারা অবস্থান স্পষ্ট করছে না? পৃথক রাজ্য ইস্যুতে দলের নেতাদের কেন ভিন্ন মত? এর মধ্যে বিজেপির দ্বন্দ্ব দেখতে যাওয়াটা ভুল হবে। কারণ এখানেও রয়েছে সেই ‘মুখ’ আর ‘মুখোশে’র খেলা। তাই কিছুতেই রাজ্য বিজেপির পদাধিকারীরা ঝেড়ে কাশছেন না।
অনন্ত রায়ের দাবি প্রসঙ্গে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের উত্তর, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে তাঁর দলকে বাংলা ভাগ নিয়ে কোনও সূচনা এখনও দেওয়া হয়নি।’ কিন্তু কেন সুকান্তবাবু বলছেন না, বিজেপি বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে। তিনি সেটা বলতে পারবেন না। কারণ একথা বললে ২০২৪ সালের ভোটে দার্জিলিং বাদে উত্তরবঙ্গের একটি আসনেও তারা লড়াইয়ের জায়গায় থাকবে না। তাই বাংলা ভাগের ইস্যুটাকে জিইয়ে রাখছে।
গত লোকসভা নির্বাচনে গোর্খা ভোট পাওয়ার আশায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও একই কৌশল নিয়েছিলেন। শিলিগুড়িতে নির্বাচনী জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘গোর্খাদের স্বপ্নপূরণ হবে।’ আর তাতেই গোর্খারা ধরে নিয়েছিলেন, মোদিজি ক্ষমতায় ফিরলেই গোর্খাল্যান্ড হয়ে যাবে! সেই আশায় গোর্খারা বিজেপিকে উজাড় করে ভোট দিয়েছিলেন।
এবার পদ্মশিবির আরও বড় গেম খেলতে নেমেছে। দলীয় জনপ্রতিনিধিরা পৃথক উত্তরবঙ্গ রাজ্যের দাবি জানাচ্ছেন। অনন্ত রায়ের গ্রেটার কোচবিহারের দাবিকে সমর্থন করে রাজবংশী ভোটের সৌজন্যে লোকসভা ভোটে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাইছে। কিন্তু জাতির ভিত্তিতে পৃথক রাজ্যের দাবি কতটা ভয়ঙ্কর হয়, তা বাংলা জানে। গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে সুবাস ঘিসিংয়ের আন্দোলনের স্মৃতি সুখকর নয়। সব জেনেবুঝেও ফের একটা অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। লোভ উত্তরবঙ্গ থেকে জিতে মন্ত্রী হওয়ার। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হওয়ার আশা কম। সেইজন্যই এক কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ও অসমের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছেন।
বুলডোজার চালিয়ে বা এনকাউন্টারে ক্ষমতা জাহির হয়, কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। শান্তি স্থাপনের প্রাথমিক শর্তই হল উন্নতি ও অগ্রগতি। আবার এলাকার উন্নতি ও মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হলেই ফেরে শান্তি। সেই ফর্মুলা মেনেই অশান্ত জঙ্গলমহলকে শান্ত করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পিঁপড়ের ডিম খাওয়া মানুষের জন্য করেছেন ভাতের ব্যবস্থা। তাই হাজার প্ররোচনা ও উস্কানি সত্ত্বেও শান্ত রয়েছে জঙ্গলমহল। তবে এখনই বলে দেওয়া যায়, মিশন-উত্তরবঙ্গ ব্যর্থ হলে পরবর্তী এজেন্ডা জঙ্গলমহল।
ন’বছর টানা বিজেপি ক্ষমতায় থাকলেও মানুষকে বলার মতো কিছুই করে দেখাতে পারেনি। উল্টে যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে বেশি। ফলে ভোটে লড়ার জন্য বিজেপির ভরসা সেই ‘হাওয়া’। তাই পৃথক রাজ্য, সিএএ-র মতো ইস্যুগুলো ফের সামনে আনছে। রাজনীতিতে ঘোলাজলে মাছ ধরার চল আছে। কিন্তু বিজেপি মাছ ধরার লোভে স্বচ্ছ জল ঘোলা করছে।
একুশের ভোটে মুখ থুবড়ে পড়ার পর থেকেই বাংলায় বিজেপির দিশেহারা অবস্থা। তবুও জগদীপ ধনকড় রাজ্যপাল থাকার সময় অক্সিজেন পেত গেরুয়া শিবির। কিন্তু তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি হয়ে যাওয়ায় সেটাও হয়েছে হাতছাড়া। তবে, এতে বিজেপি নেতারা পেয়েছেন বার্তা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিব্রত করতে পারলেই মিলবে প্রমোশন। উত্তরবঙ্গে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা কি সেই উদ্দেশ্যেই?

12th     November,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ