বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

নেতা ও সভাপতি
পি চিদম্বরম

কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন ঘিরে এক ধরনের অস্বাভাবিক এবং প্রায় গায়ে-পড়া গোছের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। দু’বছর আগে জে পি নাড্ডা যখন বিজেপির সভাপতি ‘নির্বাচিত’ হন তখন বিষয়টিকে সাধারণ বিজেপি কর্মীসহ ভারতের কেউই এবং অবশ্যই কংগ্রেস দলের কোনও সদস্য একটুও গুরুত্ব দেননি। ‘ভোটার তালিকা’ নিয়ে প্রশ্ন করার প্রয়োজন বোধ করেননি কেউ। কেউ জানেন না—রিটার্নিং অফিসার কে ছিলেন কিংবা জে পি নাড্ডা আদৌ ‘মনোনয়নপত্র’ দাখিল করেছিলেন কি না। বিজেপি হল শাসক দল। তারা এই অহঙ্কারও করে যে বিশ্বের সমস্ত রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিজেপির সদস্য সংখ্যাই ‘সর্বাধিক’। জে পি নাড্ডার নির্বাচন একটি মামুলি ব্যাপার। 
কংগ্রেস দলের নির্বাচন নিয়ে বিজেপি এবং মিডিয়া অস্বাভাবিক আগ্রহ দেখাচ্ছে। এ থেকে দুটি বিষয়ের প্রমাণ মেলে: (এক), ‘কংগ্রেস-মুক্ত’ ভারত হল একটি মিথ এবং ভ্রান্ত ধারণা বা মায়া-মরীচিকা; এটা কোনওদিনই ঘটবে না। (দুই), ভারত জোড়ো যাত্রা বিজেপির আত্মতুষ্টি গুঁড়িয়ে দিয়েছে এবং ভাবতে বাধ্য করেছে মিডিয়াকেও। না-হলে কংগ্রেসকে রীতিমতো হুঁশিয়ার হয়ে যেতে হতো।  
পার্টি এবং গান্ধীরা
আগামী মাসে (অক্টোবর) কংগ্রেস তাদের পরবর্তী সভাপতি নির্বাচন করবে। কে হবেন, বলতে পারছি না। সাধারণ কর্মীরা ভীষণভাবে চান যে রাহুল গান্ধীই ফের দায়িত্ব গ্রহণ করুন, ২০১৯-এর জুলাইতে যে-পদটি তিনি ছেড়ে এসেছিলেন। এটা তাঁদের অধিকার। তবে, রাহুল গান্ধী স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে পুনরায় কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার কোনও বাসনা তাঁর নেই। 
রাহুল গান্ধীর মত বদলের ব্যাপারে দলের নেতারা আপ্রাণ ও শেষ চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু, তারপরেও যদি তিনি তাঁর পূর্ব সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন, তবে অবশ্যই রাহুল গান্ধীর ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে, অন্তর্বর্তী সভাপতির জায়গায়, নির্বাচকরা অবশ্যই অন্য একজনকে সভাপতি পদে নির্বাচন করবেন। গান্ধীদের বাইরে অন্য একজনকে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত করার অর্থ, আমার মতে, এই নয় যে পার্টি গান্ধীদের ত্যাগ করেছে কিংবা তার উল্টো কিছু ঘটেছে। 
ইতিহাসের পাঠ
কংগ্রেস দলের ইতিহাসে রয়েছে কিছু মূল্যবান অধ্যায় বা শিক্ষা। ভারতের রাজনীতিতে পদার্পণের পর, মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেস দলের নেতার স্বীকৃতি পান। অনেক উচ্চ নেতার মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ। ১৯২১-৪৮ সময়কালে, ১৪ জন ভিন্ন ব্যক্তি কংগ্রেস সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, সরোজিনী নাইডু, এস শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার, এম এ আনসারি, মতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, সুভাষচন্দ্র বসু, আবুল কালাম আজাদ এবং আচার্য কৃপালনির মতো বাঘা নেতারা। দলের সাধারণ সদস্যরা, এমনকী সদস্য নন এমন ব্যক্তিরাও সূক্ষ্ম অথচ গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটি উপলব্ধি করেন যে, মহাত্মা গান্ধী ছিলেন ‘কংগ্রেসের নেতা’ এবং অন্য ব্যক্তিরা ছিলেন ‘কংগ্রেসের সভাপতি’। একটি পদ বা ব্যক্তি অন্যটির উপর খবরদারি করার চেষ্টা করেননি।
১৯৪৮ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যেও অনুরূপ ব্যবস্থা ছিল: সাতজন বিভিন্ন ব্যক্তি কংগ্রেসের সভাপতির কুর্সিতে আসীন হলেও কংগ্রেসের স্বীকৃত নেতাটি ছিলেন জওহরলাল নেহরু। ১৯৬৫-৮৪ পর্বেও অন্যরকম কিছু হয়নি: ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন কংগ্রেসের নেত্রী আর কংগ্রেস সভাপতির পদ সামলেছেন বিভিন্ন আটজন ব্যক্তি।
একটি বৃহৎ দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা বিশেষ অর্থবোধক হয়ে ওঠে। একজন নেতার কাজ হল নেতৃত্বদান, জনগণকে দিশা দেখানো এবং দলের পক্ষে ভোট প্রদানে তাদের প্রাণিত করা। সভাপতির প্রধান কাজ হল সংগঠনের আগাপাশতলা ঠিক রাখা, তার ঘাটতি-খামতি দূর করা এবং তাকে নির্বাচন মোকাবিলার একটি মেশিনে পরিণত করা। এই দুটি কাজের একটি অন্যটির পরিপূরক। এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনের উপযুক্ত একজন ব্যক্তিকে খুঁজে পেলে সেই পার্টি অবশ্যই ভাগ্যবান। তবে দু’জন ব্যক্তির মধ্যে দায়িত্ব দুটি ভাগ করে দিলে বুঝতে হবে যে দলটির যথেষ্ট বাস্তবজ্ঞান রয়েছে।
অনুপ্রাণিত ও পুনর্নির্মাণ করুন
যেমনটা বলেছি, একজন নেতা অবশ্যই অনুপ্রাণিত করবেন। মহাত্মা গান্ধী সেটাই করেছিলেন তাঁর অহিংসা, অসহযোগ ও আইন অমান্যের মতো অভিনব রাজনৈতিক ভাবনা দিয়ে। এই কৌশল শেষ পর্যন্ত ভারত ছাড়ো আন্দোলনেরও হাতিয়ার হয়েছিল। জওহরলাল নেহেরু জোটনিরপেক্ষতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রের উচ্চ ধারণার প্রতি জনগণকে আগ্রান্বিত এবং প্রাণিত করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী জাতিকে স্বপ্ন বড় আকারে দেখার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং নিয়েছিলেন ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ ও সবার জন্য গৃহের মতো কিছু সাহসী পদক্ষেপ। সোনালি চতুর্ভুজের মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের মাধ্যমে জাতির কাছ থেকে গুরুত্ব আদায় করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ি। একটি প্রবাদের (‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’) বিশেষ ব্যবহার বা একটি শিহরন জাগানো স্লোগান (‘গরিবি হটাও’) কিংবা একটি উদার দৃষ্টিভঙ্গি (‘ইনসানিয়াত, জামহুরিয়াত এবং কাশ্মীরিয়াত’) একজন নেতাকে বিরাট উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে।
অন্যদিকে, একটি দলের সভাপতিকে অবশ্যই বাস্তব ভিত্তির উপর দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। তাঁকে হতে হবে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা প্রদান এবং প্রতিপালনের উপযুক্ত। কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাহস থাকা জরুরি তাঁর। কংগ্রেস পার্টি মেশিনারির ভয়ানক দৈন্যদশা চলছে এবং জরুরি ভিত্তিতে এটাকে চাঙ্গা করা দরকার। আর তার জন্য দীর্ঘসময় ধরে রাস্তায় নেমে কাজ করতে হবে এবং দলীয় কর্মীদের সঙ্গে থাকতে হবে আরও দীর্ঘক্ষণ। বুথ থেকে ব্লক থেকে জেলা থেকে রাজ্য পর্যন্ত দলের প্রতিটি ইউনিটের কর্মক্ষমতার উপর একজন সভাপতিকে অবশ্যই তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। সভাপতিকে অবশ্যই কর্মীদের প্রশ্রয় ও ভর্ৎসনা করতে হবে, পুরস্কৃত ও শাস্তি দিতে হবে নেতাদের এবং ‘পার্টি মেশিনের’ সেকেলে বা বিকল ‘পার্টস’ বাদ দিয়ে তার জায়গায় নতুন পার্টস যোগ করতে হবে। এটা সারা বছরের রোজকার (সভাপতির জন্মদিন বাদে ৩৬৪ দিন!) এবং সর্বক্ষণের (২৪×৭)  কাজ। একটি বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং চলমান সংসদের চাবিকাঠি হল কংগ্রেস। কংগ্রেসের অনুপস্থিতিতে, আমরা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে একটি একদলীয় রাষ্ট্র এবং মায়া-গণতন্ত্রে যোগ দিতে পারি।
কংগ্রেস একজন নেতা-তথা-সভাপতি কিংবা একজন নেতা ‘এবং’ একজন সভাপতি পাবে কি না, তা দিন কয়েকের মধ্যেই জানা যাবে। এটা কংগ্রেস দলের পাশাপাশি দেশের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সপ্তাহ হয়ে উঠবে। অন্যভাবে দেখলে, কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন নিয়ে যে অস্বাভাবিক এবং অযাচিত আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তার পুরোটা অযৌক্তিক নাও হতে পারে।
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত 

26th     September,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ