বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

কংগ্রেসের ভোটরঙ্গ ও চিতার অট্টহাসি!
হিমাংশু সিংহ

পরিবারই আশীর্বাদ, আবার পরিবারই অভিশাপ! তাকে বাদ দিয়ে কংগ্রেসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আর বৃদ্ধ বয়সে আলেকজান্ডারের দাঁতের মাজন বেচা, প্রায় সমার্থক। নেহরু-গান্ধী পরিবার বাদে শতাব্দী প্রাচীন এই রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মটা অনেকটাই সোনার পাথরবাটির মতো! ১৯৯৭ সালে নির্বাচনের মাধ্যমেই কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন দলঅন্তপ্রাণ একনিষ্ঠ সৈনিক সীতারাম কেশরী। আজীবন পরিবারের সেবায় নিয়োজিত। খুব একটা বলিয়ে কইয়ে ধোপদুরস্ত ঝকঝকে কাঁধ ঝাঁকানো নেতা তিনি ছিলেন না। তবুও তাঁর কাছে সেদিন পরাজিত হন হেভিওয়েট শারদ পাওয়ার ও রাজেশ পাইলট। সবাই ভেবেছিল, পরিবারকে বিদায় দিয়ে শতাব্দী প্রাচীন দলটায় বুঝি নতুন হাওয়া বইতে শুরু করল। কিন্তু তা হয়নি। ঠিক কী পরিণতি হয়েছিল একনিষ্ঠ সেবক কেশরীর, তা সবারই জানা। মাত্র একবছর যেতে না যেতেই নাটকীয়ভাবে নির্বাচিত দলীয় প্রধানকে ছুড়ে ফেলে সোনিয়া গান্ধী সভাপতির আসন দখল করেন। এবং তিনি ইচ্ছাপ্রকাশ করতেই তাঁর সমর্থনে প্রায় প্রতিটি প্রদেশ কংগ্রেসের থেকে প্রস্তাব পাশ করে সীতারাম কেশরীকে গলাধাক্কা দেওয়ার পথ প্রশস্ত করা হয়। সেই ১৯৯৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দলীয় সভাপতির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন ইতালির মাইনো পরিবারের কন্যাই। কঠিন অসুখ নিয়ে টানা এতগুলি বছর। দেশের প্রাচীনতম জাতীয় রাজনৈতিক দলের দীর্ঘতম সময়ের সভানেত্রী একজন বিদেশিনী! আজ নেহরু কিংবা গান্ধীজি বেঁচে থাকলে কী বলতেন জানি না। তবে লাঠি হাতে জাতির জনক চরকা কাটা ঋজু মানুষটার কপালের ভাঁজ যে আরও গভীর হতো, তা হলফ করে বলতে পারি। 
সোনিয়া যখন দায়িত্ব নেন তখন কেন্দ্রে বাজপেয়ি জমানা। একটার পর একটা ইস্যুতে হিন্দুত্ববাদীরা টগবগ করে ফুটছে। সঙ্গে উন্নয়নের দু’শো ফিরিস্তি, যার মার্কেটিং করা হয়েছিল ‘ফিলগুড’ নামে। তবুও শেষরক্ষা হয়নি আদবানিদের। নাটকীয়ভাবে ৬ বছরের মধ্যে জাতীয় রাজনীতি অদ্ভুত এক পালাবদলের সাক্ষী হয়। পতন হয় বিজেপি সরকারের। এবং সোনিয়ার সমর্থন ও সৌজন্যে সবাইকে চমকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন কূটকচালির রাজনীতিতে ব্রাত্য, অর্থনীতির পণ্ডিত মনমোহন সিং। টানা দশ বছর দল কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকলেও এই মুহূর্তে অবস্থান একেবারে খাদের কিনারায়। মোদি ও অমিত শাহের যুগলবন্দির দৌরাত্ম্যে চরম অস্তিত্ব সঙ্কটে রুগ্ন। মনমোহন জমানার ছিটেফোঁটা কৃতিত্বও আজ আর মানুষের মনে বেঁচে নেই। জাতীয় দলের মর্যাদাও ক্রমে বিপন্ন! সোনিয়ার এই টানা ২৪ বছর দলের সভানেত্রী থাকার মাঝে অবশ্য ২০১৭ থেকে ২০১৯, দু’বছর পুত্র রাহুল গান্ধী দায়িত্ব সামলেছেন। যথাসময়েই পরবর্তী প্রজন্মের হাতে দলের ব্যাটন তুলে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি। গান্ধী পরিবারের গ্রহণযোগ্যতা ও নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতার উচ্চকিত প্রচারে তা খুব একটা কষ্টকল্পিত ছিল না। বরং সেটা আজও সমানভাবে স্বাভাবিক ও বাস্তব। কিন্তু সামনে থেকেও বারবার কোথায় যেন নিজেকে লুকিয়ে ফেলছেন রাহুল। ঠিক আন্দোলনের সামনে এসে বুক ঠুকে ‘আমিই নেতা’ বলে রুখে দাঁড়ানোর কঠিন মানসিকতার বদলে যুদ্ধের ক্লাইম্যাক্সে তিনি বারবার নিখোঁজ হয়ে যান। উৎসাহ, উদ্যোগ, সামনে থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাটা অর্জন করতে হয়। সঙ্গে চাই দিনরাত পরিশ্রম করার অসম্ভব খিদে। এই সহজাত গুণগুলি উত্তরাধিকার সূত্রে মেলে না। তাই ২০১৯ সালে অনেক সম্ভাবনা জাগিয়েও সাধারণ নির্বাচনে ভরাডুবির পর রণেভঙ্গ দেন রাজীব পুত্র। অগত্যা অসুস্থ সোনিয়াকেই অস্থায়ী সভানেত্রীর দায়িত্ব দেয় এআইসিসির ‘সাজানো’ নেতারা। সেই ‘স্টপগ্যাপ অ্যারেঞ্জমেন্ট’ এখনও চলছে। ২৩ জন তথাকথিত শিক্ষিত নেতার বিদ্রোহ নিয়ে বাইরে যতটা ঝড় উঠেছে, ভিতরে ততটা কাঁপন কিন্তু ধরেনি। আর ধরেনি বলেই আজও নিমরাজি রাহুলকে বোঝাতে একটার পর একটা প্রদেশ নেতৃত্ব প্রস্তাব নিচ্ছে। সমর্থন জানাচ্ছে। কিন্তু কতদিন এভাবে অপেশাদার সুলভ শখের রাজনীতি চলতে পারে? বিশেষত গেরুয়া আগ্রাসনে দলের ভিত্তি ও ভোটব্যাঙ্ক দুই-ই যখন প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে। টাকা, ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক কৌশলের খেলায় প্রতিপক্ষ কিন্তু অনেক বেশি সংগঠিত ও পরিশ্রমী!
কংগ্রেসের সঙ্কট বাড়ছে ঠিক আরও একটি কারণে। রাহুল সভাপতি না থাকলেও কি দলের একটাও সিদ্ধান্ত তাঁকে বাদ দিয়ে আজ নেওয়া সম্ভব? একেবারেই  নয়। আগামী ১৭ অক্টোবর শেষপর্যন্ত যদি ভোট হয় এবং গান্ধী পরিবারের বাইরে কেউ নেতৃত্বে বসেন, তাহলেও অবস্থার লেশমাত্র পরিবর্তন হবে বলে হয় না। এটা আশীর্বাদ না অভিশাপ, তা ইতিহাস বলবে। তবে পরিবারের বাইরের কেউ দলের নেতৃত্বে এলেও তিনি যে দশ জনপথ কিংবা রাহুল-প্রিয়াঙ্কাকে অস্বীকার করে একচুল এগতে পারবেন না, তার সত্যতা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। 
তবু সব জেনেবুঝেও আবার একটা প্রহসনের দিকে এগচ্ছে দলটা। কেন? নরেন্দ্র মোদি বারবার পরিবারতন্ত্র তুলে গাল দিচ্ছেন বলে? নাকি সামনে আরও বড় ভরাডুবি অপেক্ষা করছে, তাই রাহুল কিংবা প্রিয়াঙ্কা আপাতত আর কলঙ্কের ভাগী হতে আগ্রহী নন। ঘটনা যাই ঘটুক, আসন্ন আলোর পার্বণে যে নতুন ‘গণতান্ত্রিক’ কংগ্রেসের জন্ম হবে, তার সামনে এটাই কোটি টাকার প্রশ্ন। সবাই নিশ্চিত জানে রাহুল ও সোনিয়ার অঙ্গুলিহেলন ছাড়া কোনও নীতিগত সিদ্ধান্ত বা নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করার ক্ষমতা নয়া সভাপতির থাকবে না। তাহলে এই লোক হাসানো ‘নৌটঙ্কি’র প্রয়োজন কেন? অশোক গেহলট যদি সভাপতি হন, তাহলে তিনি কি রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী পদে নিজের পছন্দের লোককে বসাতে পারবেন? দেখে শুনে মনে হচ্ছে, শচীন পাইলটকে পাকা কথা দেওয়া হয়ে গিয়েছে গান্ধী পরিবারের। কৌশলে রাজস্থান থেকে গেহলটকে সরানোই তাই কৌশল। এইসব হাজারো সংশয় আর প্রশ্নেই আবর্তিত হচ্ছে কংগ্রেস রাজনীতি। আর এই আবর্তেই অক্সিজেনের অভাবে মৃতপ্রায় হবে বিরোধী পরিসর। কে না জানে, উজ্জীবিত কংগ্রেস ছাড়া এই মুহূর্তে মোদিকে গদিচ্যুত করা প্রায় অসম্ভব কাজ। আবার এও সত্যি, সেই সুযোগ সামনে এলে নির্বাচিত সভাপতিকে তুড়ি মেরে সরিয়ে অধিকার বুঝে নিতে এক মুহূর্তও দেরি করবেন না রাহুল- প্রিয়াঙ্কা।
সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা এইখানেই। এই দফায় দলীয় গণতন্ত্রের টানাপোড়েনে বলি হবেন কংগ্রেসের 
কোন একনিষ্ঠ সেবক? অশোক গেহলট কি কংগ্রেসের পরবর্তী সীতারাম কেশরী হতে চলেছেন। যদি রাহুল না হয়ে গেহলট, থারুর কিংবা কমলনাথের মতো কেউ সভাপতির আসনে বসেন, তাহলে কি দলের ভিতরকার আকচাআকচি থামবে? গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ কংগ্রেস নেতৃত্বের দিশাহারা চেহারাটাই যদি প্রকট হয়, তাহলে বিরোধীদের সঙ্কট বাড়বে বই কমবে না। সেক্ষেত্রে আরও দুটো আঞ্চলিক দল মাথা তুলবে। ভারতীয় রাজনীতি আজ গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে দাঁড়িয়ে। সামনের দু’বছরও যদি এভাবে ‘তু তু ম্যায় ম্যায়’ চলতে থাকে, তাহলে শুধু শতাব্দী প্রাচীন দলটাই লাটে উঠবে না, বিরোধী মুছে দেশটা নরেন্দ্র মোদি ও সঙ্ঘ পরিবারের গোলামে পরিণত হবে। এক ঐতিহাসিক সঙ্কটের মুখোমুখি হবে দেশের ভূগোল-ইতিহাস। আমূল বদলে যাবে জনভিত্তির মানচিত্র।
হিউমের হাতে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ১৮৮৫’র ২৮ ডিসেম্বর। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই কোনও এক রহস্যজনক কারণে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী গোটা দলটাকে জওহরলাল নেহরুর হাতে বেঁধে দিয়েছিলেন। এমন নয় যে আর কোনও যোগ্য নেতা তখন ছিল না। কিন্তু মহাত্মার স্নেহ ও সমর্থন পেয়ে নেহরুর হাতেই দলের রাশ চলে যায়। সেই থেকে স্বাধীনতা উত্তর ৭৫ বছরের ইতিহাসে কংগ্রেস নেহরু-গান্ধী পরিবারের  সম্পত্তিতে পরিণত। এই ৭৫ বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় কংগ্রেস দেশটাকে শাসন করেছে। কিন্তু গত আটবছরে গেরুয়া শক্তি অনেকটা সঙ্ঘবদ্ধ। রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসের শূন্যস্থান পূরণের খেলায় মেতেছে আঞ্চলিক দলগুলি। নরেন্দ্র মোদির আক্রমণের মুখে পড়ে এবং দলের জনভিত্তি কমতে থাকায় আজ মেকি গণতন্ত্রের নাটক করলেও কংগ্রেস দলটার জিন কিন্তু একই থাকবে। অশোক গেহলট, শশী থারুর, কমলনাথদের মধ্যে যে-ই ভোটের মাধ্যমে সভাপতি হোন না কেন, তাদের মেয়াদ গান্ধী পরিবারের খেয়ালের উপর নির্ভরশীল। যেদিনই রাহুল গান্ধীর মন হবে, দেশের সবক’টি প্রদেশ কংগ্রেস একযোগে প্রস্তাব পাশ করে অশোক গেহলটদের গলাধাক্কা দেবে। এখন দেখার ১৯৯৮ সালে রিলিজ করা ‘সীতারাম কেশরী’ নামক ট্র্যাজিক নাটকের রিমেক ছবিটা কবে রিলিজ করে! কারণ সেটাও ছবির পরিচালক ও প্রযোজক সংস্থা গান্ধী পরিবারের উপরই ষোলোআনা নির্ভরশীল। প্রায় ১৩৭ বছরের দলটার এটাই শক্তি ও একইসঙ্গে সীমাবদ্ধতাও! এই সীমাবদ্ধতা যত চওড়া হবে, ততই মোদি, অমিত শাহের খামখেয়ালিপনাও বাড়বে। দাউদ আসবে না, পরিবর্তে আসবে নামিবিয়ার চিতা। মধ্যপ্রদেশের জাতীয় উদ্যানে ছাড়া চিতাও ছত্রভঙ্গ বিরোধীদের দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে। দুয়ো দেবে। বিপন্ন হবে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান।

25th     September,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ