বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সিলেবাস
সমৃদ্ধ দত্ত

আমাদের মনের উপর কোনটা বেশি প্রভাব ফেলতে পারে? যা শুনেছি? নাকি যা দেখেছি? স্বাভাবিক উত্তর হল, চোখের সামনে যা ঘটছে অথবা আমার স্মৃতিতে যে ঘটনাগুলি সুস্পষ্ট, সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অভিঘাত অনেক বেশি গভীর। বহু আগে কী ঘটেছিল ইতিহাসের মোড় ঘোরানো অধ্যায় না হলে, সেটির সম্পর্কে তীব্র আবেগ থাকে না। অন্যের কাছে শোনা অথবা পড়া কাহিনি অথবা ঘটনাপঞ্জি আমাদের মনকে অতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যতটা পারে আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। খুব অনুসন্ধিৎসু হলে কিংবা ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ থাকলে, অতীতে কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে আগ্রহ থাকে। কিন্তু ১৪০ কোটি মানুষের ভারতে এই আগ্রহ ও উদ্যোগ যে কম, সেটি আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি। মোবাইল এখন বিনোদন, তথ্য, নথি, মতামত, ঝগড়া, মতান্তর, ভালোবাসা, পড়াশোনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অথবা চাকরির সন্ধান, সবকিছুর একটি কমন প্ল্যাটফর্ম। নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বদাই নতুন প্রজন্ম এগিয়ে থাকে। মোবাইলের ক্ষেত্রেও তাই। মূলত তারাই যে কোনও মোবাইল নির্মাতা সংস্থা অথবা সার্ভিস প্রোভাইডারদের টার্গেট অডিয়েন্স হয়। শুধুই মোবাইল সংস্থা কেন? যে কোনও ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রেই এই ফর্মুলাই প্রযোজ্য।  অর্থাৎ গেট দ্য ইয়ং। অল্পবয়সিদের অ্যাড্রেস করো, তাদের টার্গেট করে  বোঝাও যে এই পণ্যটি কেন তাদের দরকার। এর মধ্যে নতুন ফিচার আছে। 
ঠিক এই কারণেই রাজনীতির ক্ষেত্রে নতুন ফর্মুলা নিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ঠিক ফর্মুলা বলা যাবে না। বরং বলা ভালো রাজনীতির নতুন সিলেবাস। প্রথমত, নরেন্দ্র মোদি বারংবার সভা সমাবেশে, সরকারি অনুষ্ঠানে, বক্তৃতায় একটি তথ্যকে লাগাতার প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া। সেটি হল, এখন সরকারি স্তরে যা ভালো ভালো কাজ হচ্ছে, সবই তিনি অর্থাৎ তাঁর সরকার প্রথম করেছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দেখেছি যে, তিনি বলেছেন, গরিবদের জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, গরিবের জন্য আবাসন, গরিবের জন্য বিদ্যুৎ, উপজাতিদের জন্য প্রকল্প, প্রত্যেক ভারতবাসীর জন্য পানীয় জল ইত্যাদি উদ্যোগ একমাত্র তাঁরই। তিনি যে কথাটি এসব ক্ষেত্রে বলে থাকেন, সেটি হল, স্বাধীনতার পর থেকে আর কোনও সরকার এসব নিয়ে ভাবেইনি। আমরা করে দেখালাম। অর্থাৎ সব উদ্যোগই নতুন। নতুন বৈশিষ্ট্য শুনলে মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায়। 
বিরোধিতাও হয়। বিরোধীরা পরিসংখ্যান ও তথ্য দিয়ে বলেন, অতীতে কোন কোন সরকারের আমলেও এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এমন মোটেই নয় যে, মো঩দিই প্রথম করলেন, তিনি অতীতকে ভুলিয়ে দিতে চাইছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব হয়তো সত্য। কিন্তু এই কণ্ঠস্বর অথবা যুক্তিগুলি ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে যতজনের কাছে পৌঁছবে, তার তুলনায় অনেক বেশি মানুষের কাছে মোদির ভাষণ পৌঁছয়। কারণ নির্দিষ্ট প্রফেশনাল প্রচার টিম থাকে। মোবাইলবাহিত হয়ে সেই বার্তা চলে যায় অনেক দ্রুত। নরেন্দ্র মোদির এই কথাগুলি বলার কারণই হল, একটি বিশেষ শ্রেণির কাছে পৌঁছনো। তারা হল যুবসমাজ। তিনি টার্গেট করেছেন নতুন প্রজন্মকে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে দেখা গিয়েছিল, ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সি ভোটারের শতকরা হার ৩৪ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই এই হার বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। 
এই ফর্মুলা নেওয়ার কারণ হল, নতুন প্রজন্মের কাছে অতীতে কী ঘটেছিল সেটি অনেক সময়ই বিস্মৃত। কোন প্রধানমন্ত্রী কী কী করেছিলেন অথবা স্বাধীনতা সংগ্রামে কোন দলের কী ভূমিকা ছিল, এসব নিয়ে এই সদ্য সাবালক অথবা যুবসমাজের অনেকের আগ্রহ ও চর্চা থাকলেও, সিংহভাগ অংশই অবগত নয়। যা স্বাভাবিক। তাই তাদের লক্ষ্য করে নরেন্দ্র মোদি বারংবার বলতে থাকেন যে, যা কিছু হচ্ছে সব তিনিই প্রথম করছেন। নতুন করছেন। 
এই দাবি যে সব নতুন প্রজন্মই বিশ্বাস করছে তা নয়। কিন্তু মোদির নিশ্চিত ধারণা সিংহভাগকে অন্তত তিনি প্রভাবিত করতে পারছেন। বিশেষ করে, নতুন প্রজন্ম তো সব শ্রেণিরই। ধনী, দরিদ্র, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, নাগরিক, গ্রামীণ, নারী, পুরুষ, কোনওমতে খেটে খাওয়া সকলেই নতুন প্রজন্ম। ইতিহাস অথবা রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ যুবসমাজ কিংবা যে কোনও বয়সি মানুষও অসংখ্য। কিন্তু সকলেই তো ভোটার। তাই বারংবার একটি কথা চমকপ্রদ বাগ্মীতায় বলতে থাকলে সেটি বিশ্বাসযোগ্য হবেই। 
ধরা যাক, ২০০০ সালে যাদের জন্ম হয়েছে। তাদের রাজনীতির বোধ কিংবা নিজস্ব মতামত যখন গড়ে উঠছে তখন মোদি ক্ষমতাসীন। অর্থাৎ ১৪ বছর বয়স তাদের তখন। সুতরাং মোদির আগে পূর্বতন প্রধানমন্ত্রীরা কী করেছেন সেটা তাদের প্রত্যক্ষ জানার কথা নয়। নতুন প্রজন্মের মস্তিষ্ক যে সর্বদা অতীতের তুলনাগুলি যাচা‌ই করে দেখে, তা নয়। তাই নতুন প্রজন্মকে মোদি  বার্তা দিতে চান, আমিই নতুন এবং প্রথমবার এই কাজটি করলাম।  ‘এই প্রথমবার’—সরকারি বেসরকারি কোনও প্ল্যানের ক্ষেত্রে এটা  শুনলেই একটা আগ্রহ, কৌতূহল ও সম্ভ্রম তৈরি হয়। 
দ্বিতীয় ফর্মুলা হল, যা কিছু হচ্ছে, সেটা যতই সামান্য অথবা ক্ষুদ্র হোক, চিৎকার করে বলতে হবে। অর্থাৎ উচ্চগ্রামে প্রচার। সরকারের প্রতিদিনের রুটিন কাজও ঘোষণা করে যেতে হবে এমনভাবে, যেন এটা একটা বিরাট সংবাদ। বাজেট ঘোষণা করা হয় ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু বাজেটে যা যা ঘোষণা করা হয়েছে, সেটা সারা বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকার এখন বারংবার প্রচার করে চলে। একটি বিশেষ উপ-ফর্মুলা হল, সর্বদাই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বলে যেতে হবে। আজ কী হচ্ছে সেটা নয়। পাঁচ বছর পর কী হবে সেই স্বপ্ন দেখাতে হবে। এই যেমন ২০১৭ সালে বলা হতো, ২০২২ সালের মধ্যে সব ঘরে পানীয় জল, সব ঘরে বিদ্যুৎ হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি হবে ভারত। এসব কিছুই হয়নি। তাই এখন নতুন মডেল হল, ২০৪৭ সালে ভারত জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ হবে। উন্নতির সব অধরা সেই বছরে ধরা হয়ে যাবে। সবাইকে আহ্বান করা হচ্ছে ২০৪৭ সালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশ গড়তে। তার মানে কারা টার্গেট? নতুন প্রজন্ম। অর্থাৎ ২০৪৭ সালের অমৃতকাল দেখার জন্য আমাদের দলকে ভোট দিয়ে যাও ততদিন। 
মনমোহন সিং কিংবা অটলবিহারী বাজপেয়িরা স্বভাবে ও রাজনীতিতে পরস্পরের বিপরীত হলেও, প্রতিদিন একজন প্রধানমন্ত্রী কিছু না কিছু বলছেন, এরকম মনোভাব তাঁদের দুজনেরই ছিল না। খুব বড় কোনও প্রকল্প অথবা অনুষ্ঠান ছাড়া প্রধানমন্ত্রীদের অংশগ্রহণ ভাবাই যেত না। নরেন্দ্র মোদি কিন্তু একদিনের জন্যও নিজের অস্তিত্ব ও উপস্থিতি জনগণকে ভুলতে দিতে চান না। তাই নিয়ম হল, প্রতিদিনই কোনও না কোনও অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছেন,  উদ্বোধন করছেন, শিলান্যাস করছেন, এমনকী রাজ্যের ক্ষুদ্র প্রকল্পেরও সূচনা করছেন তিনি। ফলে ভারতবাসী রোজ তাঁর কথা শুনছে। উত্তরপ্রদেশের এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন অথবা মধ্যপ্রদেশের অভয়ারণ্যে আফ্রিকার চিতাকে ছেড়ে দেওয়া। সব কিছুতেই প্রধানমন্ত্রী আছেন। এই যে নিজেকে সর্বদাই ভাসিয়ে রাখা, এটাই হল তাঁর বিশেষ মডেল। অতীতের প্রধানমন্ত্রীরা ভাবতেন, কাজের মাধ্যমেই ইতিহাসে স্থান হয়। মোদি ভাবেন, কাজ করছি এই প্রচারটি এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যাতে জনমনে বিভ্রম তৈরি হয় যে, হ্যাঁ, তাহলে বোধহয় সত্যিই কাজ হচ্ছে। ওই বিভ্রমই হবে ইতিহাস। 
তৃতীয় ফর্মুলা হল, নতুন কিছু নির্মাণ না করতে না পারলে নাম বদলে দিয়ে সেটিকে নতুন রূপ দেওয়া। তাই নাম পরিবর্তন, নোট পরিবর্তন, পার্লামেন্ট পরিবর্তন, ইতিহাস পরিবর্তন হয়ে চলেছে। যাতে আগামী যুগ সর্বদাই ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছনে দেখতে পায় নতুন ভারতকে। প্রধানমন্ত্রীর একটাই প্রত্যাশা, তাঁর সরকারকে যেমন বলা হয় মোদি সরকার, তাঁর দলকে যেমন বলা হয় মোদির দল, তেমনই আগামী যুগ যেন এই পরিবর্তিত দেশ সম্পর্কে ভাবে, মোদির ভারত!

23rd     September,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ