বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

জ্ঞানবাপী মামলা, উত্তেজনার চোরাস্রোত
মৃণালকান্তি দাস

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভাপতি অলোক কুমার নাকি উত্তেজনার চোরাস্রোতে ভাসছেন! ইতিউতি যা মন্তব্য করছেন তাতেই টের পাওয়া যাচ্ছে সেই উত্তেজনা। সম্প্রতি ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুরে আরএসএসের সম্মেলনে যেমন বলেছিলেন, ‘বিচারকের রায় বুঝিয়ে দিয়েছে জ্ঞানবাপী মামলা ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের আনা উপাসনাস্থল আইনের আওতায় পড়ে না। এর অর্থ, প্রথম বাধা কাটল। জয় আমাদের হবেই। কারণ, সত্য আমাদের সঙ্গে।’ সেদিন হিন্দুদের পক্ষে অন্যতম মামলাকারী সোহনলাল আর্য বলেছিলেন, ‘এই রায় জ্ঞানবাপী মন্দিরের নতুন ভিত্তিপ্রস্তর।’ আর উত্তরপ্রদেশের উপ মুখ্যমন্ত্রী ব্রজেশ পাঠকের প্রতিক্রিয়া, ‘দেশে খুশির ঢেউ উঠেছে।’
জ্ঞানবাপী মামলা নিয়ে কেন এত উত্তেজনা?
বাবরি মসজিদে পাকানো সলতের আগুন যে বাকি ভারতেও ছড়াতে পারে, তা আঁচ পেয়েই ১৯৯১ সালে নরসীমা রাও সরকার ‘প্লেসেস অব ওয়রশিপ অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন প্রণয়ন করে। এই আইন অনুযায়ী, স্বাধীনতার সময় দেশের যে কোনও ধর্মস্থানের যে চরিত্র ছিল, তা পরিবর্তন করা বেআইনি। অর্থাৎ, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট যে ধর্মস্থানগুলি মন্দির হিসেবে গণ্য হতো, সেগুলিকে মসজিদ বা গির্জায় পরিবর্তন করা যায় না। যেখানে মসজিদ ছিল, তাকেও কোনওভাবে মন্দিরে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। আইনের ৪(২) ধারা অনুযায়ী, এই আইন কার্যকর হওয়ার তারিখে যদি কোনও মন্দির বা মসজিদের চরিত্র নিয়ে কোনও মামলার শুনানি চালু থাকে, সেই মামলা বাতিল হয়ে যাবে। ৪(৩) ধারা বলছে, এই আইন কার্যকর হওয়ার আগে যদি কোনও মামলার ফয়সালা হয়ে গিয়ে থাকে, তবে সেই রায় চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য হবে। অর্থাৎ, ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ থেকে ১১ জুলাই ১৯৯১— এই সময়কালে যদি কোনও আদালত কোনও মসজিদকে মন্দিরে বা মন্দিরকে মসজিদে পরিবর্তন করার পক্ষে রায় দেন, তবে সেই আদেশ বহাল থাকবে। অর্থাৎ বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিবাদ এই আইনের আওতার বাইরে থাকবে। 
এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল— ঐতিহাসিক ন্যায়-অন্যায়ের বিতর্কে না জড়িয়ে সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং বিদ্বেষ থেকে দেশকে রক্ষা করা। আজকের ভারতে এই আইনটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ ইতিহাসের কথা তুলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের চেহারা পাল্টে দিতে মরিয়া হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ যেদিন অযোধ্যা মামলার চূড়ান্ত রায় দিয়েছিলেন, সেদিন তাঁরাও ওই ১৯৯১ সালের আইনের প্রাসঙ্গিকতার উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন, ওই আইন দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র অটুট রাখার সহায়ক। যা দেশের সংবিধানের মূল কাঠামো। ধর্মনিরপেক্ষ ভারত যেন ধর্মীয় সংঘাতের বধ্যভূমি না হয়ে ওঠে। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতি একযোগে একথাও বলেছিলেন, ঐতিহাসিক ভুলত্রুটির সংশোধন আদালতের আঙিনায় হওয়া ঠিক নয়। সুপ্রিম কোর্টের এমন মন্তব্যে এ দেশের মানুষ যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন!
সুপ্রিম কোর্টের যে পাঁচ বিচারপতি সর্বসম্মতিক্রমে অযোধ্যা মামলার রায় দিয়েছিলেন, বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ছিলেন সেই বেঞ্চের অন্যতম। আর বিচারপতি পি এস নরসিংহ তখন ছিলেন মামলার অন্যতম আবেদনকারী রাজেন্দ্র সিংহের আইনজীবীর ভূমিকায়। রাজেন্দ্রর বাবা গোপাল সিংহ বিশারদ ১৯৫০ সালে ‘রামের জন্মভূমিতে’ পুজোর অনুমতি চেয়ে আদালতে গিয়েছিলেন। ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হন সেই পি এস নরসিংহ। সুপ্রিম কোর্টের এই দুই বিচারপতির হাতেই গিয়েছিল জ্ঞানবাপী মসজিদ সংক্রান্ত মামলা। মজার বিষয়, চলতি বছরের ২০ মে সেই দুই বিচারপতিই জ্ঞানবাপী মামলা শুনানির জন্য পাঠিয়েছিলেন বারাণসী জেলা আদালতে। ২০২১-এর আগস্টে পাঁচ হিন্দু মহিলা জ্ঞানবাপীর ‘মা শৃঙ্গার গৌরী’ (ওজুখানা ও তহখানা নামে পরিচিত) এবং মসজিদের অন্দরের পশ্চিমের দেওয়ালে দেবদেবীর মূর্তির অস্তিত্বের দাবি করে তা পূজার্চনার অনুমতি চেয়েছিলেন বারাণসী দায়রা আদালতে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেই মামলারই এবার শুনানি হবে বারাণসী জেলা আদালতে। এই রায়ের পর মনে হওয়া স্বাভাবিক, অযোধ্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টে নিজেদের মন্তব্যকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়। তিনিই তো ১৯৯১ সালের আইনের প্রাসঙ্গিকতার কথা শুনিয়েছিলেন গোটা দেশবাসীকে। বলেছিলেন, ১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল আইনে বলা হয়েছিল, কোনও ধর্মস্থানের চরিত্র বদল করা যাবে না। তাহলে জ্ঞানবাপীর ক্ষেত্রে সেই আইন বলবৎ হবে না কেন?
১৯৯১ সালের আইন, ১৯৪২ সালের এলাহাবাদ হাইকোর্টে রায় অথবা রাম জন্মভূমি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান— যেকোনও যুক্তি প্রয়োগেই জ্ঞানবাপীর মামলা খারিজ হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ, সুপ্রিম কোর্টেই তা হয়নি। আসলে দেশের সরকারের চরিত্র বদলের পাশাপাশি আইনের সেই ‘স্পিরিট’ উবে যাচ্ছে। দ্রুত। দেশের সর্বত্র হিন্দুত্ববাদ দৃঢ় প্রোথিত করার রাজনৈতিক তাগিদ যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততই উৎসাহিত হচ্ছে এই ধরনের প্রবণতা। তাতে যা হওয়ার তাই-ই হচ্ছে। জ্ঞানবাপী মসজিদে পূজার্চনার অনুমতি চেয়ে দায়ের করা আবেদনের শুনানিতে সম্মতি দিয়েছেন বারাণসী জেলা আদালতের বিচারক অজয়কুমার বিশ্বেস। কোন যুক্তিতে? আইনে ধর্মস্থানের চরিত্র বদল করা যাবে না বলা হলেও, ধর্মীয় চরিত্র নির্ধারণ করা যাবে না— তা বলা হয়নি। বারাণসীর জেলা আদালতের বিচারক সেই চরিত্র নির্ধারণের রায়ই শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, স্মরণাতীতকাল ধরে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির চত্বরে দেবদেবীর মূর্তি পূজা হয়ে আসছে। একবার কোনও সম্পত্তি দেবোত্তর ঘোষিত হলে তা ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। আরাধ্য দেবতার সম্পত্তি ধ্বংস হয়ে গেলেও সেই সম্পত্তির চরিত্রের বদল ঘটে না। কাজেই জ্ঞানবাপী মসজিদের অভিন্ন দেওয়ালে থাকা হিন্দু দেবদেবীর নিরবচ্ছিন্ন পূজা–অর্চনার দাবিসংক্রান্ত মামলা ২২ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি শুনবেন।
এই জ্ঞানবাপীর সামনেই তো মগনলালের লোক ফেলুদাকে নিয়ে যাবে বলে অপেক্ষা করছিল। মোদিময় এই তল্লাটে জ্ঞানবাপী চক হয়ে গলিপথে মণিকর্ণিকা ঘাট পর্যন্ত জনপদ আসলে বারুদের স্তূপ। অথবা আতঙ্কের প্রহর গোনা একটি দ্বীপের মতো। এমনই এক দ্বীপ, যা মৃত্যু পরোয়ানা পেয়ে গিয়েছে, ডুবে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। বিজেপির ইস্তেহার মেনে বারাণসীর ভোল পাল্টানো শুরু ২০১৪-য়। নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘বিশ্বনাথজি ভিড়ে ঢেকে রয়েছেন।’ তাঁকে তিনি ‘মুক্ত’ করবেন! গঙ্গার ঘাট থেকে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির পর্যন্ত ৫০ ফুট চওড়া অত্যাধুনিক করিডরের জন্য প্রয়োজন ৪ হাজার বর্গফুট ফাঁকা জমি। অতঃপর বিশ্বনাথ মন্দির ট্রাস্টকে সঙ্গে নিয়ে বুট আর বুলডোজারের আওয়াজ তুলে জমি ‘ফাঁকা’ করতে নামে স্থানীয় ও রাজ্য প্রশাসন। রাতারাতি বদলে যায় মগনলালের সেই ডেরার অবয়ব।
আর তারপরই বারাণসীতে জ্ঞানবাপী মসজিদ আদতে কাশীর বিশ্বনাথের জমি বলে দাবি ওঠে। ঠিক যেমন বাবরি মসজিদের জমির মালিক রামলালা বিরাজমান বলে দাবি উঠেছিল। রামজন্মভূমি আন্দোলনের সময় ঠিক যেমন প্রথমে কিছু ছোটখাটো হিন্দুত্ববাদী সংগঠন দাবি তুলতে শুরু করেছিল, এ বারেও ঠিক তা-ই। অজ্ঞাতকুলশীল কিছু সংগঠন ঠিক ঠিক জায়গা বেছে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে প্যান্ডোরার বাক্স খোলার ব্যবস্থা করছে। নেহাতই পুরনো ছক। অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরির আগের ধাপটা মনে করা যাক। ফৈজাবাদ ছিল বড় শহর, লখনউয়ের ঢের আগে থেকে ফৈজাবাদই ছিল অওধের নবাবদের রাজধানী। ছোট্ট অযোধ্যা স্টেশনে বেশিরভাগ ট্রেন দাঁড়াত না, থাকার জন্য গোটাকয়েক ধর্মশালা। ভদ্রস্থ হোটেল, রেস্তরাঁ মানেই ফৈজাবাদ। সেই ফৈজাবাদ নামটা উড়িয়ে দিয়ে বলা হল, গোটা জায়গাটাই অযোধ্যা। বাকিটা ইতিহাস।
সঙ্ঘ পরিবার জানে, এই মামলা যতদিন জিইয়ে থাকবে ততই গেরুয়া শিবিরের লাভ। এ সবের মাঝে বেকারত্বের হার বাড়ল না কমল, কত জন রোজগারের সুযোগ না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন, কেউ এ সব প্রশ্ন তুলবে না। ভোটভিখারি হিন্দুত্বের এ সব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। পাঁচ হিন্দু মহিলা যে জ্ঞানবাপীর চত্বরে মা শৃঙ্গার গৌরীস্থলে পুজোর দাবিতে মামলা ঠুকে দিয়েছেন, তা নিয়েই হিন্দুত্ববাদীরা মাতোয়ারা। দেশবাসী জানে, গণতন্ত্রের সঙ্কটে আদালত মানুষের স্বার্থরক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেই দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাসও ভারতেই রয়েছে। মোদির ভারতে আদালত কোন পথে হাঁটবে, সেটা সময়ই বলে দেবে।
শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেই জল্পনায় না গিয়ে আপাতত স্মরণ করা যাক, তিন দশক আগে ‘বাবরি মসজিদের কবল থেকে রাম জন্মভূমিকে মুক্ত করার’ আন্দোলনের সময় কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের বজ্রনির্ঘোষ ছিল, ‘ইয়ে (অযোধ্যা) তো সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়’। হিন্দুত্ববাদীদের সেই হুঙ্কার বাস্তবায়িত হওয়ার পথে বারাণসীর জেলা আদালতের রায় প্রথম সোপান কি না, তা নির্ধারণের দায়িত্ব দেশের সুপ্রিম কোর্টের।
প্যান্ডোরার বাক্স একবার খোলা হলে আইন-আদালত দিয়ে কি আর তাকে বন্ধ করা যায়?

22nd     September,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ