বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

চিতা নিয়ে নৌটঙ্কি বনাম আত্মহত্যার পাঁচালি
সন্দীপন বিশ্বাস

এরাজ্যে শুরু থেকেই বিজেপির অস্তিত্ব অনেকটা নেতিয়ে যাওয়া বাসি কচুরির মতো। মোদি-শাহরা মাঝেমাঝে এসে কিছুটা গরম করে দিয়ে যান বটে, কিন্তু আবার তাঁরা দিল্লি ফিরে গেলেই এখানকার নেতৃত্ব নেতিয়ে পড়ে। ইদানীং গেরুয়া বাহিনীর নেতাদের মনে হয়েছে, দলকে চাঙ্গা করার জন্য একটা আন্দোলনের দরকার। অনেক বড় আন্দোলন, যা নাড়িয়ে দেবে রাজ্যকে। এটা অবশ্য একটা থিওরি। যে কোনও দলের উত্থানের জন্যই দরকার জনগণকে সামনে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন। বিজেপিও সেই আন্দোলনের পথেই গিয়েছিল। আন্দোলনের নামে কেন্দ্রীয় বিজেপির  ঢালাও ফান্ড থেকে রাজ্য নেতারা ১১ কোটি টাকা আদায় করে এনেছিলেন বলে কানাঘুষো ছড়িয়েছে। রাজ্য নেতারা কথা দিয়েছিলেন, এই টাকাটা খরচ করে রাজ্য বিজেপি খুব নাম করবে, রাজ্যে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। পাপা কহতে হ্যায় বড়া নাম করেগা, বেটা হামারা অ্যায়সা কাম করেগা। কিন্তু বেটা এমন কোনও কাম করতে পারল না, যাতে তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়। উল্টে মুখ পোড়াল পরিকল্পনার অভাবে। আসলে টাকা ঢেলে ভিন রাজ্য থেকে হাড্ডাগোড্ডা গেরুয়া হার্মাদদের এনে যে আন্দোলন সফল করা যায় না, তার প্রমাণ বিজেপির সাম্প্রতিক আন্দোলন। ভাড়াটে সেনা দিয়ে গুণ্ডামি করা যায়, অগ্নিসংযোগ করা যায়, প্রকৃত আন্দোলন করা যায় না বা সেই আন্দোলন মানুষের মনে রেখাপাত করে না।
এই যে সব তত্ত্ব, তা কি বিজেপি নেতারা জানেন না? সব জানেন। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, এত জ্ঞানগম্যি থাকা সত্ত্বেও সেদিন বিজেপির ভাড়াটে সেনারা অমন তাণ্ডব করল কেন? উত্তর সহজ। সেই তাণ্ডবের লক্ষ্যেই ছক কষে তাদের নামানো হয়েছিল। প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল, তাণ্ডবকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, যেখানে পুলিস গুলি চালাতে বাধ্য হয়। তাই পুলিসের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে, পদস্থ পুলিস কর্তাকে নির্মমভাবে ঠেঙিয়ে, প্রচুর ইষ্টক ক্ষেপণ করে পুলিসকে গুলি চালানোয় বাধ্য করতে চেয়েছিল তারা। তার কারণ আন্দোলনের পিছনে বিজেপির লক্ষ্য  ছিল, লাশ। লাশ চাই, লাশ। যে লাশকে উত্থানের সিঁড়ি করে অনেক উপরে ওঠা যায় এক তুড়িতে, যে লাশকে সামনে রেখে রাজ্যের মানুষের সহানুভূতি আদায় করা যায় সহজেই, যে লাশকে সামনে রেখে রাজ্য সরকারের উপর চাপ বাড়ানো যায়। রাজ্য পুলিস বিজেপির এই মোক্ষম ছকটা ধরে ফেলে। তাই তারা বিজেপির পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। আর সেখানেই বিজেপির অসহায়তা এবং অবসাদ। পুলিসের এই ছকটা দ্রুত বুঝে ফেলার পরই বহু বিজেপি নেতা গ্রেপ্তার বরণ করে লালবাজারের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে চলে যান। অনেকে আন্দোলনের ঝাঁপ গুটিয়ে ফেলেন। তাঁরা বুঝে যান, সারাদিন অকারণ আন্দোলন আন্দোলন খেলা করে আর লাভ নেই। 
অবশ্য এখন এসব নিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মাথা ঘামানোর সময় কোথায়! চুলোয় যাক ওসব আন্দোলন! তার থেকেও বড় ‘কারিয়াক্রম’ নিয়ে ব্যস্ত দলের ‘কারিয়াকর্তারা’। তাঁরা এখন মোদিজির জন্মদিন পালন নিয়ে ব্যস্ত। ১৫ দিনের মোদিপক্ষ পালন করে তাঁর দুর্নাম কিছুটা খণ্ডন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি সব সাবজেক্টেই ফেল। বেরোজগারি দূরীকরণ, অর্থনীতি, ব্যাঙ্কিং সেক্টর, মূল্যবৃদ্ধি রোধ কর্মসূচি, গণবণ্টন ব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতা। পাশ শুধু সাম্প্রদায়িক বিভেদে। এরকম অজস্র ফেলের রূপকার নব ফেলুদার ভাবমূর্তি ফেরাতে অনেক গবেষণা করে অবশেষে আনা হল চিতা। চিতা এলেই নাকি ভারতের মানুষের ভাগ্য ফিরে যাবে। নোট বাতিল দেশের ভাগ্য ফেরাতে পারেনি, জিএসটি পারেনি, বল্লভভাই প্যাটেলের সুবিশাল মূর্তি পারেনি, রামমন্দিরের ঢক্কানিনাদ পারেনি। সিএএ-এর চেষ্টা পারেনি, কৃষক বিল আনার চেষ্টা পারেনি, এবার তাই তাঁর চিতাতেই ভরসা। এভাবে কি সত্যিই লুটিয়ে যাওয়া ভাবমূর্তি ফেরানো সম্ভব? এভাবে কি নিজেকে বিকল্প মহাত্মা হিসেবে তুলে ধরা সম্ভব? কিন্তু বিজেপির কিছু করার নেই। তৃতীয়বারের জন্য বিজেপিকে ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্রে তাঁর নামেই ফাটকা খেলতে হবে। তাঁর নামেই যে বিজেপির বক্স অফিস। তাই ২০২৪ সালের আগে তাঁর ভাবমূর্তিকে চুনকাম করতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মোদি-কীর্তনের ঢালাও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। 
আসলে এই যে চিতা ছেড়ে দেশজুড়ে একটা প্রচারের তোলপাড় তুলে তাঁর ভাবমূর্তি বাড়ানোর খেলা চলছে, সে তো এসেছে একটা আতঙ্ক থেকেই। সেটা ক্ষমতা হারানোর আতঙ্ক। সেই সঙ্গে ব্যর্থতাকে ঢাকা দেওয়ার তুমুল চেষ্টা শুরু হয়েছে নানা প্রক্রিয়ায়। কিন্তু তাঁর পিছনে ফেলে আসা ব্যর্থতার আবর্জনাগুলি কোনওভাবেই স্বচ্ছ ভারত অভিযানের মধ্য দিয়ে সাফাই করা যাবে না। 
মোদিভক্তরা বলেন, তিনি নাকি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু ইদানীং তাঁর কাজে আত্মবিশ্বাসের ছায়া ক্রমেই অপসৃয়মান হয়ে উঠছে। যেন শেষ বিকেলের নিভু আলোর মতো। তাঁর মুখে আমরা বারবার শুনেছি আত্মনির্ভর ভারত গড়ার কথা। দীর্ঘদিন ধরে একই কথা রেকর্ডের মতো আওড়ালেও সেই আত্মনির্ভরতার কোনও লক্ষণই আমাদের দেশের কোথাও ফুটে ওঠেনি। তা শুধুই মুখের কথা হয়ে থেকে গিয়েছে। আমরা দেখেছি মোদির আত্মনির্ভর ভারত স্লোগান ক্রমেই রূপান্তরিত হচ্ছে আত্মহত্যার ভারতে। এত মৃত্যু, এত অবসাদ, এত হাহাকার, এত ঘৃণা!  শেষ পর্যন্ত মোদি শাসনের ব্যর্থতা দেশের ঘরে ঘরে মানুষের জীবনকে অসহায় করে তুলছে। অনন্যোপায় মানুষ বেঁচে থাকার কোনও পথ খুঁজে না পেয়ে নিজেই নিজের জীবনে দাঁড়ি টেনে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর প্রকাশিত রেকর্ড বলছে, এ যাবৎ ভারতে সব থেকে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ২০২১ সালে। মোদি জমানায় গত পাঁচ বছরে হু হু করে বাড়ছে আত্মহত্যার ঘটনা। ২০১৭ সালে দেশে মোট আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ১ লক্ষ ২৯ হাজার ৮৮৭। ২০১৮ সালে সেটা হয় ১ লক্ষ ৩৪ হাজার ৫১৬, ২০১৯ সালে মোট আত্মহত্যা করেন ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ১২৩ জন। ২০২০ সালে ১ লক্ষ ৫৩ হাজার ৫২ জন আত্মহত্যা করেন। ২০২১ সালে সেটাই দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ৬৪ হাজার ৩৩ জনে। অর্থাৎ এখন দেশের প্রতি এক লক্ষ মানুষের মধ্যে ১২ জন আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।
২০২১ সালে কোন কোন কারণে মানুষ আত্মহত্যা করেছেন? একটু রিপোর্টে নজর দেওয়া যাক। রিপোর্ট বলছে, ২৫.৬ শতাংশ দিনমজুর আত্মহত্যা করেছেন। করোনার সময় দেশের দরিদ্র মানুষদের হাতে টাকা পৌঁছে দিতে পারেনি মোদিজির সরকার। বহু পরিযায়ী শ্রমিক চাকরি খুইয়ে শত শত কিলোমিটার পথ হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন। করোনার সময় তাঁরা স্ত্রী, সন্তানদের মুখে খাদ্যের জোগান দিতে পারেননি। তাই সেই যন্ত্রণা তাঁদের ঠেলে দিয়েছে আত্মহননের পথে। ৮.৪ শতাংশ বেকার যুবক, চাকরি হারানো মানুষ এই সময়ের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন। ৯.৭ শতাংশ চাকরিজীবী মানুষ আত্মহত্যা করেছেন, ৬.৬ শতাংশ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, ১২.৩  শতাংশ স্বনির্ভর তথা ব্যবসায়ী, হাতের কাজ জানা মানুষ তাঁদের পণ্য বিক্রি করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। এসব রিপোর্ট পড়লে কি লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে না?
এর পিছনে কেউ যদি কারণ হিসেবে মোদি শাসনের অপদার্থতাকে চিহ্নিত করেন, তিনি কি ভুল করবেন? মানুষের মুখে ভাত তুলে দিতে তিনি ব্যর্থ। মানুষের রোজগার কমেছে তাঁর সময়ে। তাঁদের  চাকরির পথ খুলে দিতে পারেননি। উল্টে কেড়ে নেওয়া হয়েছে চাকরি। তার বদলে তিনি চিতা নিয়ে খেলায় মেতেছেন। নিজের জন্মদিন উপলক্ষে দেশজুড়ে উৎসবের আবহ তৈরি করছেন। মানুষের ঘরে ঘরে আঁধার, আর সরকারি টাকা জলে ঢেলে জন্মদিনের উৎসবের রোশনাই জ্বলছে! একথা আজ জানতে পারলে নিরোও হাসবেন। আমাদের কিন্তু আজ আর হাসি পায় না। মানুষের যিনি হিত করতে পারেন না, তিনি যখন চিতা এনে নিজেরই জন্মদিন পালনের ঘটা করেন, তখন সেই বিষয়টাকে ফ্লপ নৌটঙ্কি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।  

21st     September,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ