কর্তৃত্বের সঙ্কট? নাকি অস্তিত্বের? ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র ১২ দিন পরও এই প্রশ্নটার উত্তর কিছুতেই মিলছে না। রাহুল গান্ধী হাঁটছেন। আমরাও দেখছি, শুনছি এবং বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীরকে হাঁটাপথে জুড়বেন তিনি। রাস্তার আশপাশ থেকে ছুটে আসবেন কোনও বৃদ্ধা... জড়িয়ে ধরবেন তাঁকে। কখনও তিনি কোলে তুলে নেবেন একরত্তি শিশুকে। কখনও আবার ছোট্ট কোনও মেয়ের জুতোর ফিতে বেঁধে দেবেন। নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিভাজনের রাজনীতি এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে অহিংস যাত্রার সূচনা করেছেন তিনি। কোনও এক ডান্ডি অভিযান রাহুল গান্ধী এবং অবশ্যই তাঁর পরামর্শদাতাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাই তিনি হাঁটছেন। সঙ্গে তাঁর দলের পছন্দসই নেতারা। উৎসাহী এবং কৌতূহলী লোকজন এগিয়ে এসে কিছুক্ষণের জন্য মিশে যাচ্ছে মিছিলে... জমাট বাঁধছে ভিড়। আবার তারা সরে যাচ্ছে ভিড় হাল্কা করে। ফিরে যাচ্ছে নিজের নিজের কাজে। তাঁরাও কি মোদি সরকারের কাজেকর্মে বিরক্ত? তাঁরা কি আগামী লোকসভা ভোটে কংগ্রেসকে... নিদেনপক্ষে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেবেন? আশা করি রাহুল গান্ধী এই প্রশ্নটা করছেন! এই প্রশ্নটা প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের। জুড়তে হবে প্রতিটি সুতোকে... একে অপরের সঙ্গে। মোহনদাস করমচন্দ গান্ধী নামে এক ব্যক্তি পেরেছিলেন। কেন জানেন? কারণ, তাঁর অস্তিত্ব সঙ্কটের ভাবনা ছিল না। তিনি জানতেন, মানুষ পাশে থাকলে কর্তৃত্বও থাকবে। কর্তৃত্ব আদায়ের জন্য প্রতি পদে হাঁকপাক করতে হবে না। রাহুলজি, আপনিও তো মহাত্মা গান্ধী হতে চাইছেন, তাই না! অর্ডিন্যান্সের কাগজ ছিঁড়ে, মায়ের আঁচলতলে সভাপতি হয়ে, কিংবা দলিত পরিবারের সঙ্গে লাঞ্চ করেও তার ধারকাছে পৌঁছতে পারেননি আপনি। এবার ‘অহিংস’ পদযাত্রায় যদি কিছু হয়!
জোর লড়াই শুরু হয়েছে... গান্ধীজির রাজনৈতিক উত্তরসূরি হয়ে ওঠার। রাহুল গান্ধী হোক বা নরেন্দ্র মোদি, দু’জনেই আজ মহাত্মা হতে চান। একজন হাঁটছেন, আর একজন ‘সেবায় মন দিয়েছেন’। ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত এক পক্ষকাল সময় বেছে নিয়েছেন দ্বিতীয়জন। রক্তদান, আংটিদান, মৎস্যদান... সব চলবে জোরকদমে। মোদিজির টার্গেট দু’টো—১) আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়। সে জন্য অযোধ্যা-বারাণসী, ১০ লক্ষ সরকারি চাকরি, পুতিনকে যুদ্ধ নিয়ে ‘জ্ঞান’ দেওয়ার মতো বহু কাজ করছেন তিনি। ২) নিজের ইমেজটা এমন জায়গায় মোদিজি নিয়ে যেতে চান যে, ভারতের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হলেই লোকে গান্ধীজির পরপরই তাঁর নাম উল্লেখ করে। আট বছর শাসন করেছেন তিনি। তাঁর আগে অটলবিহারী বাজপেয়িও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু বিজেপি কিছুতেই ভারতের রাজনীতিতে কুলীন হয়ে উঠতে পারছে না। আর মোদিজি সেটাই চাইছেন... কৌলীন্য। একটা যুগের সূচনা... তাতে থাকবে সুপ্রশাসন, ধর্ম, সেবা এবং পরিষেবা। বাস্তবে না হোক, জবরদস্ত একটা মোড়ক তো দেওয়া যেতেই পারে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের অধিপতি হওয়ায় সেটা তাঁর বাঁয়ে হাত কা খেল। কিন্তু প্রতিপক্ষ?
এটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। প্রতিপক্ষটা কে? সাধারণ পাটিগণিতের হিসেবে কংগ্রেসই তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে রাহুল গান্ধীর নামটাই প্রথম মনে আসবে। সত্যিই কি তাই? গান্ধী পরিবারের চাদর গায়ে চড়ালেই যে নেতৃত্বগুণ জন্মায় না, সেটা আজ বারবার বোঝাচ্ছেন বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসিরা। অর্থাৎ, শশী থারুর, মণীশ তেওয়ারি, করণ সিংরা। কপিল সিবাল এবং গুলাম নবি আজাদরা কংগ্রেসের মায়া কাটিয়েছেন। ইন্দিরা বা রাজীব গান্ধীর প্রতি যে দায়বদ্ধতা তাঁদের ছিল, সেটাই এতদিন রাহুল-কংগ্রেসের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল তাঁদের। নিছক পার্টি নয়, পরিবার... আবেগ। কংগ্রেস নামক সেই তানপুরাটা আছে বটে, কিন্তু তার ছিঁড়েছে। আর কংগ্রেস বলতে যে নেতাদের বোঝানো হতো, তাঁরাও বিদায় নিচ্ছেন। রাহুল গান্ধী কি তাঁদের কাছে গিয়ে একবারও বলছেন যে, আপনারা কোথায় চললেন? আপনাদের অভিজ্ঞতা এবং বিচক্ষণতা কংগ্রেসের সম্পদ। নাঃ, সেসব তিনি বলছেন না। বরং তাঁর পিছনে খোলকরতাল বাজানেওয়ালারা উল্টে তাঁদেরই অকথা-কুকথা শোনাচ্ছে। বলছে, রাহুলবাবার নেতৃত্ব, তাঁর সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিচ্ছে। তাহলে এই কয়েকজনের সমস্যাটা কোথায়?
একজন রাজার পরিষদরা যতটা ভালো, ততই ভালো তাঁর শাসন। আশপাশের তাঁবেদাররা ভুল বোঝালে রাজার নির্বোধ হয়ে যেতে বেশি সময় লাগে না। কংগ্রেসের এটাই এখন সারসত্য। কংগ্রেসের এবং অবশ্যই রাহুল গান্ধীর। এ এক বিষম খেলা চলছে কংগ্রেসের অন্দরে। রাহুল পদ চান না বলে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন না। কিন্তু কর্তৃত্ব তাঁর পুরোমাত্রায় চাই। আবার নিজেও বুঝছেন, সেটা অতটা সহজ নয়। দলের একটা বড় অংশই তাঁকে নেতা হিসেবে মানতে চাইছে না। তার জন্য অবশ্য রাহুলের রাজনৈতিক পারফরম্যান্স দায়ী। ভারত জোড়ো পদযাত্রা তাঁর শেষ সুযোগ। অন্তত তাঁর ঘনিষ্ঠরা তেমনই মনে করছে। কিন্তু রাজনীতির বিশ্লেষকরা? তাঁরা কিন্তু কিছুতেই রাহুল গান্ধীকে দুঁদে পলিটিশিয়ান হিসেবে নম্বর দিতে চাইছেন না। সে হতেই পারে... রাজনীতি করেও সবাই রাজনীতিক হন না। বাংলাতে যেমন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সৎ মানুষ, চেষ্টার ত্রুটি ছিল না তাঁর। কিন্তু পলিটিশিয়ান তিনি কখনওই হয়ে উঠতে পারেননি। পদে পদে রাজনীতির চৌকাঠে ঠোক্কর খেয়েছেন তিনি। তাঁর বহু ভালো ভাবনা এবং উদ্যোগ সুপরামর্শের অভাব ও রাজনীতির কলকাঠিতে ধসে পড়েছে। রাহুল গান্ধী আবার সেই পর্যায়েও এখনও পৌঁছতে পারেননি। একদিকে তিনি ভারত জুড়তে বেরিয়েছেন, অন্যদিকে তাঁর নিজের ঘরই ভাঙছে। তথাকথিত গৃহকর্তা হয়েও তাঁর হুঁশ নেই, অথচ অন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির ঘুম নেই। কারণ তারা জানে, বিজেপির পলিটিক্যাল সিস্টেম ভাঙতে হলে সবাইকে এক হতেই হবে। আর সেটা রাহুল গান্ধীকে দিয়ে হবে না।
প্রতি বছর ডালাস বিমানবন্দরে একটি প্রতিযোগিতা হয়। ৮২ টনের একটি যাত্রীবাহী বিমান হাতে টানতে হবে। তবে একা নয়, দল বেঁধে। বিমানের সামনে একটি দড়ি বেঁধে দেওয়া হবে। এক একটি দল আসবে, আর তারাই সেই দড়ি ধরে টান মেরে স্থানচ্যুত করবে বিমানকে। কয়েক চুল সরাতে পারলেই যথেষ্ট। রাহুল গান্ধীর অবস্থা এখন অনেকটা তেমনই। কংগ্রেস নামক এক ভয়াবহ ওজনদার বিমানকে রানওয়েতে টানছেন তিনি। বা বলা ভালো চেষ্টা করছেন। শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য, স্বাধীনতা সংগ্রাম, নেহরু, গান্ধী পরিবার... এই লেগাসির ওজন একা হাতে টানার ক্ষমতা কি আদৌ রাহুল গান্ধীর আছে? হয়তো পারতেন তিনি। যদি কংগ্রেসের প্রাচীন সৈনিকরা থাকতেন তাঁর পাশে। দলের আগে নয়, যদি তিনি চেষ্টা করতেন দলের সঙ্গে চলার। কংগ্রেসের সেই লেগাসিও হেলায় টেনে নিয়ে যেতে পারতেন তিনি। রাহুল গান্ধীর বোঝা উচিত, তিনি ইন্দিরা গান্ধী নন, রাজীবও নন। তাই প্রধানমন্ত্রিত্বের স্বপ্ন নয়, তাঁর লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের রাজনীতি।
ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছেন নরেন্দ্র মোদি। যতদিন প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে রাহুল গান্ধী আছেন, ততদিন তাঁর চিন্তা নেই। ক্রিকেটে ভালো বোলাররা সবসময় খারাপ ব্যাটসম্যানকে স্ট্রাইকিং এন্ডে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করেন। সে বল নষ্ট করবে, সময় গড়িয়ে যাবে... ততই অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে নন স্ট্রাইকার ব্যাটসম্যান। দুর্বল ব্যাটসম্যানের ব্যর্থতায় সে তখন চালিয়ে খেলতে গিয়ে উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসবে। এটাই স্ট্র্যাটেজি নরেন্দ্র মোদির। রাহুল গান্ধী ব্যাট করুন না... যতক্ষণ খুশি। তার মধ্যে দেশের নেতৃত্ব এবং দলের কর্তৃত্ব, দু’টোই তৃতীয়বারের জন্য নিশ্চিত করে ফেলবেন মোদিজি। আকাশছোঁয়া স্বপ্ন... শুরু হবে মোদি যুগ। নোটে ছাপা হবে ছবি, জন্মদিনে ড্রাই ডে!
আর রাহুল গান্ধী? সোনিয়া কি এখনও বুঝতে পারছেন না যে, সঙ্কট আর কর্তৃত্বের নয়... কংগ্রেসের অস্তিত্বের। এটা ঠিক, ভারতের রাজনীতি এবং ইতিহাস যতদিন থাকবে, মোদিবাহিনী শত চেষ্টাতেও কংগ্রেসের চিহ্ন মুছে ফেলতে পারবেন না। কিন্তু তারপর? নাম থাকবে, অস্তিত্ব থাকবে তো?