বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

বাঘ ও বাঘের মাসির
ফারাক দেখল বাংলা
তন্ময় মল্লিক

বিরোধী দলের রাজনৈতিক জমি শক্ত করার একটাই রাস্তা, আন্দোলন। আন্দোলনে পায়ের তলার মাটি জমাট বেঁধে হয় পাথর। তাতে কামড়াতে বা আঁচড়াতে গেলে ভাঙে দাঁত, নখ। বিজেপি সেই আন্দোলনই করতে গিয়েছিল। হাওয়ার জোরে বঙ্গে দ্বিতীয় হওয়া বিজেপি ভুগছে অবনমনের আশঙ্কায়। পঞ্চায়েতের অগ্নিপরীক্ষার আগে জমি শক্ত করতে দিয়েছিল নবান্ন অভিযানের ডাক। কিন্তু তাতে জমি তো শক্ত হলই না, উল্টে সামনে চলে এল গেরুয়া শিবিরের সংগঠনের কঙ্কালসার চেহারাটা। ঘুরে দাঁড়ানোর বদলে পড়ল মুখ থুবড়ে। বিশৃঙ্খলা পাকিয়ে সাংগঠনিক দুর্বলতা আড়াল করা যায় না। তাণ্ডব চালিয়ে অন্যের রক্ত ঝরানো যায়, কিন্তু তাতে রক্তাল্পতা থেকে মুক্তি মেলে না। বিজেপির নবান্ন অভিযান ফের একবার প্রমাণ করল, সিবিআই, ইডি দিয়ে বিরোধীদের বিব্রত করা যায়, কিন্তু তাতে রাজনীতির মাটি শক্ত হয় না।
এর আগেও রাজ্যের বিরোধীরা শাসক দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। কিন্তু কোনও আন্দোলনই মানুষের মনে দাগ কাটেনি। কারণ যে সমস্ত ইস্যুকে সামনে রেখে বিরোধীরা আন্দোলন করেছিল তা মানুষের কাছে নতুন কিছু নয়। সিপিএম নেতারা এখন গণতন্ত্রের বুলি আওড়ান। টিভির সামনে শান্তির ধ্বজা ওড়ান। অথচ তাঁদের আমলেই মেমারির করন্দায়, বীরভূমের সূচপুরে, গড়বেতার ছোট আঙারিয়ায়, লালগড়ের নেতাইয়ে ও নন্দীগ্রামে সংগঠিত হয়েছে একের পর এক গণহত্যা। কাউকে খুন করে পুঁতে দিয়েছে, কাউকে দিয়েছে পুড়িয়ে। কাউকে আবার খুঁজেই পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ লাশ গায়েব। তা সত্ত্বেও মৃতের বিধবা স্ত্রী ও সন্তানহারা জননী বুক চাপড়ে কাঁদতেও পারেননি। কারণ কাঁদলেই পরিবারের বাকিদের প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা। বাম আমলে বিরোধীদের জরিমানার টাকায় বহু কমরেডের মাটির ঘর হয়েছে পাকা।
আর নির্বাচন এলেই বিরোধীদের ‘নিষ্ক্রিয়’ করে রাখার জন্য বামেদের ঝুলি থেকে বেরত নিত্যনতুন দাওয়াই। খেতমজুর বয়কট, গলায় জ্যান্ত কইমাছ ঢুকিয়ে মেরে দেওয়া, হাত চিহ্নে ভোট দেওয়ার ‘অপরাধে’ হাতের কব্জি কেটে নেওয়া, অকাল বৈধব্যের হুমকি দিয়ে বিরোধী কর্মীর বাড়িতে সাদা থান পাঠিয়ে দেওয়ার স্মৃতি হয়তো হয়েছে কিছুটা ফ্যাকাসে। কিন্তু, তা একেবারে মুছে যায়নি। বামেদের আবিষ্কৃত সন্ত্রাস সৃষ্টির সেইসব কৌশল আজও হতে পারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষণার উপাদান।
পঞ্চায়েত ভোটে বামেদের বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার রেকর্ড আজও রয়েছে অটুট। অনুব্রত মণ্ডলের নির্দলদের বাড়িতে বোমা মারার নিদানেও তা ভাঙেনি। হাজার চেষ্টা করলেও তৃণমূল এসব ব্যাপারে বামেদের ধারেকাছেও যেতে পারবে না। তাই এই সমস্ত ইস্যু এরাজ্যের মানুষের মনে ছাপ ফেলতে পারেনি। কিন্তু এবার আন্দোলন দানা বাঁধার মতো বিরোধীদের হাতে ছিল পর্যাপ্ত রসদ। নিয়োগ দুর্নীতি এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের ঘটনায় রাজ্যবাসী স্তম্ভিত। এই ইস্যু যদি বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পেতেন, তাহলে তিনি শাসক দলকে চরকি নাচন নাচিয়ে ছাড়তেন। কিন্তু বিরোধীরা কিছুই করতে পারল না। উল্টে ভাঙচুর করে, পুলিস পিটিয়ে, গাড়ি জ্বালিয়ে আন্দোলনের অভিমুখটাই দিল ঘুরিয়ে। দুর্নীতি নয়, চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়াল বিজেপির গুণ্ডামি।
বঙ্গে সিপিএম ‘শূন্য’। তাই তাদের ভাঙচুরের পিছনে তবুও একটা যুক্তি আছে, প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাওয়া। হাজার চেষ্টা করেও সিপিএম ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। উল্টে আরও কাত হয়ে গিয়েছে। তাই আগে সোজা হওয়া, তারপর ঘুরে দাঁড়ানো। সেই সোজা হওয়ার আশায় এক পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে ট্রাম পোড়ানো বামেরা নিয়েছে ভাঙচুরের রাস্তা। কিন্তু সিবিআই, ইডির বলে বলীয়ান বিজেপি কেন এমন করল? বিধানসভা ভোটের পর থেকেই শুরু হয়েছিল বিজেপির রক্তক্ষরণ। তা বন্ধ হয়েছে প্রমাণে নবান্ন অভিযানই ছিল সুবর্ণ সুযোগ। তার জন্য দরকার ছিল বিপুল জমায়েত। কিন্তু বিজেপি নেতারা ভোকাল টনিকের বন্যা বইয়ে দেওয়া সত্ত্বেও লোক হল না। তবে, এমনটাই হওয়ার কথা ছিল।
মিছিল মিটিং ভরানোর দায়িত্ব নেয় কারা? খেটে খাওয়া, দেহাতি মানুষেরা। রাজনৈতিক সুস্থিতি, পালা বদলের সঙ্গে যাঁদের প্রতিদিনের রুটিরুজির সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, তাঁরাই মিছিলে মেলান পা, স্লোগানে মেলান গলা। তাঁদের বেশিরভাগই আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কারণ আর কিছুই নয়। বিগত এক দশকের অভিজ্ঞতায় তাঁরা সরকারি পরিষেবার আসল অর্থ উপলব্ধি করেছেন। জন্ম থেকে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, বিয়ে, এমনকী মৃত্যু পর্যন্ত গরিব খেটে খাওয়া মানুষের পাশে রয়েছে মমতার সরকার। তাই বিজেপির ‘নবান্ন অভিযানে’র ডাকে সাড়া দিতে তাঁদের বয়েই গিয়েছে। 
বিধানসভা ভোটে ২০০ আসন দখলের হুঙ্কার 
দিয়ে বাংলা কাঁপিয়েছিল দিল্লি বিজেপি। কিন্তু সাতাত্তরেই থেমে গিয়েছিল দৌড়। তারপর থেকে যতগুলি নির্বাচন হয়েছে প্রতিটিতেই বিজেপির রক্তক্ষরণ বেড়েছে। সেই সুযোগে বামেরা বিজেপির ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলা শুরু করেছে। রাজ্যে বিরোধী দলের মর্যাদা খোয়ানোর আশঙ্কা গেরুয়া শিবিরে জাঁকিয়ে বসছে। তাই নবান্ন অভিযানে 
লোক জড়ো করতে না পেরে ভাঙচুর করে নজর ঘোরানোর চেষ্টা করেছে। 
বিজেপি নবান্ন অভিযানের দিন যে হাঙ্গামা করবে, তা গোয়েন্দারা আগেই জানিয়েছিলেন। সতর্ক করেছিলেন পুলিস প্রশাসনকে। অনেকে বলছেন, বিজেপি নেতৃত্ব গোয়েন্দাদের সেই আশঙ্কাকে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণের দায়িত্ব নিয়েই ১৩ সেপ্টেম্বর নেমেছিল রাস্তায়। পুলিসের কিয়স্ক ভাঙচুর, মেরে পুলিসের হাত ভেঙে দেওয়া, পুলিসকে লক্ষ্য করে পাথর ও ইট বৃষ্টি, এমনকী লাগানো হয়েছে পুলিসের গাড়িতে আগুনও। বঙ্গ বিজেপি বুঝিয়ে দিল, রাজ্যে দ্বিতীয় হওয়ার লড়াইয়ে সিপিএমকে তারা এক ইঞ্চি মাটিও ছাড়তে নারাজ। তাদের বিশ্বাস, জঙ্গি আন্দোলন করলেই ফিরবে নেতৃত্বের প্রতি কর্মীদের আস্থা। তাই সিপিএম ও বিজেপির মধ্যে শুরু হয়েছে গুণ্ডামির প্রতিযোগিতা। পঞ্চায়েত নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে দুই দলের মধ্যে ‘সুপার লিগে’ টিকে থাকার লড়াই ততই হবে তীব্র।
দুর্নীতি ইস্যু যে বিরোধীদের খুব একটা ডিভিডেন্ট দেবে না, সেটা বিজেপি নেতারা খুব ভালো করে বুঝে গিয়েছেন। তাই তাঁরা চাইছেন যে কোনও মূল্যে একটা ‘একুশে জুলাই’ অথবা ‘নন্দীগ্রাম’ ঘটাতে। সেই লক্ষ্য নিয়েই নবান্ন অভিযানের দিন সরাসরি পুলিসকে আক্রমণ শানানো হয়েছে। মাটিতে ফেলে পিটিয়েছে। মেরে হাত ভেঙে দিয়েছে। অফিসারদের আক্রান্ত হতে দেখে যদি কেউ গুলি চালিয়ে দেয়, তাহলেই কেল্লা ফতে। হাতে আসবে লড়াইয়ের উপাদান। কিন্তু পুলিসকে গুলি চালাতে হয়নি। জলকামানেই মিইয়ে গিয়েছে গেরুয়া শিবিরের যাবতীয় আস্ফালন।
আন্দোলনকে ‘আমিষ’ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন বিজেপি কর্মীরা। নেতৃত্বের নির্দেশমতো লাঠির বদলে ঝান্ডা বেঁধেছিল মোটা বাঁশে। পুলিস পিটিয়ে সেই বাঁশের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে। বোতলে জলের বদলে এনেছিল পেট্রল। তা ঢেলে পুলিসের গাড়িতে আগুন দিয়েছে। ব্যাগে টিফিনের বদলে ছিল বোমা। তারও ব্যবহার হয়েছে যথাযথ। কিন্তু বিজেপির কর্মীরা বুঝতে পারেননি, নেতারা তাঁদের এভাবে গাছে তুলে মই কেড়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে যাবেন। নবান্ন অভিযানে বিজেপি নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার বন্যা বয়ে যাচ্ছে। তবে, সবচেয়ে বেশি ‘খিল্লি’ হচ্ছেন বঙ্গ বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার।
তাঁর হেলমেট পরা ছবিটা ভাইরাল হয়েছে। বঙ্গ বিজেপির সেনাপতির এহেন ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ মানসিকতা দলের কর্মী সমর্থকরা কিছুতেই হজম করতে পারছেন না। তাঁকে কটাক্ষ করার জন্য কেউ কেউ তৃণমূল নেত্রীর লড়াইয়ের উদাহরণও টেনেছেন। তাঁরা বলছেন, আন্দোলনের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন একেবারে সামনে। লড়াই করতেন বুক চিতিয়ে। তারজন্য মার খেয়েছেন, রক্তাক্ত হয়েছেন। কিন্তু নিজের জীবনের পরোয়া না করেই চালিয়ে গিয়েছেন লড়াই। তাই তিনি ‘বাংলার বাঘিনী’। আর বঙ্গ বিজেপির সেনাপতি? মার খাওয়ার আগেই পরে নিলেন হেলমেট। বুঝিয়ে দিলেন, ক্যামেরার সামনে বাঘের মতো গর্জন করলেও লড়াইয়ের ময়দানে তিনি ‘বাঘের মাসি’।

17th     September,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ