বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

কোহিনুর ফেরত চাওয়া কি অন্যায়?
মৃণালকান্তি দাস

দিল্লি শহরকে কচুকাটা করে পারস্যে ফিরে গিয়েছিলেন নাদির শাহ! ১৭৩৯ সালের প্রখর গ্রীষ্মে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন মুঘল সাম্রাজের যাবতীয় ধনরত্ন। ৭০০ হাতি, ৪ হাজার উট ও ১২ হাজার ঘোড়ার পিঠে বোঝাই করে। সোনাদানা, মণিমুক্তো ছাড়াও লুট করা ওই ধনরত্নের মধ্যে থেকে ছিল শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসনও। সেখানেই গাঁথা কোহিনুর হীরে ও লালরঙা তৈমুর রুবি।
গ্রীষ্মশেষে নামে প্রবল বর্ষা। সোনাদানার বস্তা-বোঝাই কিছু ঘোড়া, খচ্চর ঝিলম নদীর স্রোতে হারিয়ে যায়। হিন্দুকুশ পর্বত পেরনোর সময় আরও কিছু প্রাণী পা পিছলে খাদে। কিন্তু লুঠতরাজের বেশিরভাগ ধনরত্নই যে সেদিন ভারত ছেড়ে চিরতরে চলে গিয়েছিল, নির্দ্বিধায় তা বলা যায়। কোহিনুরও তাই। নাদির শাহের সেই চূড়ান্ত আঘাতই মুঘল সাম্রাজ্যকে ফোঁপরা, দেউলিয়া করে দেয়।
পার্সি ভাষায় কোহিনুর শব্দের অর্থ ‘আলোর পাহাড়’। ইতিহাস বলে, বারবার ঠিকানা বদলেছে এই পাহাড়। অন্ধ্রের কোল্লুর খনি থেকে আবিষ্কারের পর কোহিনুর ছিল কাকোতীয় সাম্রাজ্যের শাসকদের হাতে। ১৩১০ সালে কাকোতীয় বংশের সঙ্গে বরঙ্গলের যুদ্ধে এই হীরে দখল করেন দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি। এরপর খিলজিদের থেকে হাত বদল হয়ে মুঘলদের কাছে। ‘বাবরনামা’-য় উল্লেখ রয়েছে, ১৫২৬-র পানিপথের যুদ্ধেই তা বাবরের দখলে আসে। একসময় শাহজাহানের ময়ূর-সিংহাসনে শিরতাজে শোভা পেত এই অমূল্য রত্ন। এরপর নাদির শাহের হাত ধরে কোহিনুর চলে যায় ইরানে। নাদির শাহের সাম্রাজ্যের পতনের পর কোহিনুর যায় আফগানিস্তানের আমিরদের হাতে। আহমদ শাহ দুররানি কোহিনুর হস্তগত করেন। কিন্তু কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে, নাদির শাহের নাতি নিজেই দুররানিকে এই হীরেটি উপহার দিয়েছিলেন। ১৮১৩ সালে দুররানি পাঞ্জাবের সিংহাসন হারালে তা ‘শের-ই-পাঞ্জাব’ মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের হাতে আসে। তিনি নাকি এই বহুমূল্য হীরে তাঁর পাগড়িতে আটকে রাখতেন। কোহিনুরের হাত বদলের ইতিহাস এখানেই থেমে থাকেনি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাঞ্জাবে তাদের ঘাঁটি গড়লে শুরু হয় কোহিনুরের পরবর্তী অধ্যায়। ১৮৪৯ সালে পাঞ্জাব দখলের পর ১১ বছরের পাঞ্জাব কেশরী রণজিৎ সিংয়ের ছেলে দলীপ সিংয়ের সঙ্গে লাহোর চুক্তি করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। একপাক্ষিক এই চুক্তিতে দলীপ সিংয়ের কাছ থেকে প্রায় জোর করেই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এই হীরে, এমনটাই মত অধিকাংশ ঐতিহাসিকের। শেষপর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতযশে কোহিনুরের জায়গা হয় ইংলন্ডেশ্বরীর মুকুটে। সেই কারণেই গত কয়েক দশকে ভারতের পাশাপাশি কখনও আফগানিস্তানের তালিবান শাসকরা, কখনও পাকিস্তানের জুলফিকার আলি ভুট্টোও কোহিনুরের দাবি জানিয়েছেন।
যে হীরে নিয়ে এত টানাটানি, ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারের পুরুষরা কিন্তু সেই কোহিনুরকে দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবেই দেখেন। তাই কোনও রাজা নন, রানির মুকুটেই শোভা পেয়েছে ১০৫.৬ ক্যারাটের হীরে। যদিও ১১ বছরের বালক দলীপ সিংহের কাছ থেকে এই হীরে কেড়ে নেওয়া নিয়ে নাকি বিবেকের দংশনে ভুগতেন রানি ভিক্টোরিয়াও। ইংল্যান্ডে এই হীরে পৌঁছনোর পর সে দেশে তুমুল উত্তেজনা হলেও তা তখনও ইংল্যান্ডের রাজমুকুটে জায়গা পায়নি। শোনা যায়, ইংল্যান্ডের রাজপ্রাসাদ বাকিংহাম প্যালেসে দলীপ সিংয়ের কাছ থেকে ব্যক্তিগত অনুরোধের মাধ্যমে এই কোহিনুর হীরে ফের উপহার হিসেবে নিয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া। যদিও তা যে একদমই সাজানো ঘটনা ছিল, সেকথা বিভিন্ন সময় স্বীকার করে নিয়েছেন ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরাও। এই সাজানো ঘটনার পরই নিজের রাজমুকুটে কোহিনুর বসিয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া।
সেই ইতিহাসের পথ ধরেই কোহিনূর বসানো মুকুটের মালকিন ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ১৯৩৭ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জের অভিষেকের সময় তৈরি করা হয়েছিল সেই মুকুট। পরেছিলেন দ্বিতীয় এলিজাবেথের মা প্রথম এলিজাবেথও। আজও টাওয়ার অব লন্ডনে রাখা থাকে সেই মুকুট। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের অন্যান্য অলঙ্কারের সঙ্গে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই বিরল হীরে দেখতে ভিড় করেন। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রয়াণে ব্রিটেনের তখত এখন চার্লসের। ফলে সেই মুকুট এবার উঠবে চার্লসের স্ত্রী, ডাচেস অব কর্নওয়াল ক্যামিলার মাথায়। তিনিই ভবিষ্যতের রানি।
শতকের পর শতক পার হতে হতে কোহিনুর সাক্ষী থেকেছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনার। বহু ঐতিহাসিক যুদ্ধকে চাক্ষুষ করেছে এই মূল্যবান হিরে। দেখেছে দরবারের জটিল কূটনীতি, সিংহাসন বদলও। এই কোহিনুরকে ঘিরে রয়েছে বহু বিতর্ক, চলেছে মামলাও। অনিতা আনন্দ ও উইলিয়ম ডালরিম্পলের লেখা ‘কোহিনুর: স্টোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ইনফেমাস ডায়মন্ড’ বই সেই উপনিবেশবাদের ইতিহাসই তুলে ধরেছে। এ দেশ জানে, সম্পদক্ষুধা রহস্য হয়ে দানা বাঁধে উপনিবেশ থেকে উপনিবেশে। তারপরে একদিন হঠাৎ কুয়াশার চাদর সরে যায়। উন্মুক্ত কঙ্কালের মতো পড়ে থাকে ধ্বংসের মানচিত্র। উপনিবেশবাদ তো তাই-ই...।
কোহিনুর! একদিন আবার সেই ‘হকের ধন’ ফিরিয়ে আনা হবে— আম ভারতীয়ের অনেকের মনে আজও গেঁথে রয়েছে এই আবেগ। ২০১৬-র এপ্রিলেই সেই আবেগে জল ঢেলে দিয়েছিল মোদি সরকার। একটি জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সলিসিটর জেনারেল রঞ্জিত কুমার সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রের সংস্কৃতিমন্ত্রক মনে করে, কোহিনুর ফেরত আনার চেষ্টা করা ঠিক নয়। কারণ, কেউ তা জোর করে ছিনিয়েও নেয়নি। ব্রিটিশদের এ’টি উপহার দেওয়া হয়েছিল। সংস্কৃতি মন্ত্রকের যুক্তি, পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিং আফগান শাসকের থেকে কোহিনুর হীরে পেয়েছিলেন। তিনি তা উইল করে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরকে দিয়ে যান। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরি দলীপ সিং ১৮৫০-এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে এ’টি তুলে দেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুর সলিসিটর জেনারেল রঞ্জিত কুমারকে সতর্ক করে দিয়ে জানতে চান, ‘যা বলছেন, তার অর্থ বুঝতে পারছেন তো! ভবিষ্যতে কোহিনুর হীরে নিয়ে আইনি পথে দাবি জানাতে কিন্তু সমস্যা হবে এতে! ওরাই (ব্রিটেন) বলবে, আপনাদের দেশের আদালতই তো কোহিনুর ফেরানোর আর্জি খারিজ করে দিয়েছে।’
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ১৮৫০-এ দলীপ সিং ছিলেন নাবালক। দ্বিতীয় ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধের পর শিখদের হারিয়ে ব্রিটিশরা শিখ সাম্রাজ্য দখল করে। তার জন্য লর্ড ডালহৌসি লাহোরের শেষ চুক্তি তৈরি করেন। সেই কুখ্যাত লাহোর চুক্তির তিন নম্বর অনুচ্ছেদে লেখা ছিল, ‘শাহ সুজা-উল-মুলুকের কাছ থেকে রণজিৎ সিং যে কোহিনুর হীরে নিয়েছিলেন, সেই হীরে ইংল্যান্ডের মহারানিকে দেবেন দলীপ সিং।’ একে কি উপহার বলা যায়? এ তো নাবালক রাজাকে চাপ দিয়ে কোহিনুর হাতিয়ে নেওয়া। ২০১৮-র ১৬ অক্টোবর, তথ্য জানার আইনে (আরটিআই) একটি প্রশ্নের জবাবে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এএসআই)-র তরফেও জানিয়ে দেওয়া হয়, কোহিনুর হীরে ইংরেজদের দিতে বাধ্য হয়েছিলেন লাহোরের মহারাজা। এবং সেই যুক্তিতেই ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার সময় এবং তারপরে ১৯৫৩ সালেও বর্তমান রানি এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের সময় কোহিনুর ফেরানোর দাবি তুলেছিল ভারত। কিন্তু চুক্তির প্রসঙ্গ তুলে তা খারিজ করে দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। ভারত সফরে এসে প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছিলেন, কোহিনুর ফেরতের প্রশ্নে যদি হ্যাঁ বলতে হয়, তা হলে একদিন দেখা যাবে, গোটা ব্রিটিশ মিউজিয়ামটাই ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু এরপরও গেরুয়া শিবিরের ব্রিটিশ প্রেমে কোন টাল খায়নি। ২০১৯-এর এপ্রিলে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, ‘ইংল্যান্ডের কাছ থেকে এই হীরে ফেরত চাওয়ার দাবির পিছনে কোনও আইনগত যুক্তি নেই।’ একইসঙ্গে জনস্বার্থ মামলা খারিজ করে দেয় দেশের শীর্ষ আদালত। স্পষ্ট হয়ে যায়, গেরুয়া শিবিরের নীতি। তাহলে কি কোহিনুর কোনওদিন তার ভিটেতে ফিরতে পারবে না?
প্রশ্ন তুলেছিলেন বিখ্যাত ক্রিকেটার তথা ধারাভাষ্যকার সুনীল গাভাস্কারও। গত ১২ এপ্রিল আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালস ও লখনউ সুপার জায়ান্টস ম্যাচের বিরতির ঘটনা। মুম্বইয়ে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের পাশেই দর্শনীয় মেরিন ড্রাইভ রাতের আলোকসজ্জায় দেখতে দারুণ লাগে। মেরিন ড্রাইভকে ‘রানির কণ্ঠহার’-এর সঙ্গে তুলনা করেন ধারাভাষ্যকার অ্যালান উইলকিনস। টিভি ক্যামেরা মেরিন ড্রাইভে ধরতে গাভাস্কারকে এর সৌন্দর্য নিয়ে কিছু বলার অনুরোধ করেন উইলকিনস। 
গাভাস্কার বলেন, ‘রানির কণ্ঠহার...আমরা অবশ্য এখনও কোহিনুরের অপেক্ষায় রয়েছি!
দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রথম যখন রানি হন, মার কাছে গিয়ে বলেছিলেন, এই সিংহাসনটার কি আমি যোগ্য মা? তাঁর মা নাকি বলেছিলেন, ছোট থেকে তোমার রাজনৈতিক চেতনা বিকশিত করা হয়েছে ঠিক পথেই। তাই তুমি চুপ করে থাকতে জানো। জানো যে, কখনও কখনও চুপ করে থাকাই রাজনীতির শ্রেষ্ঠ চাল। কোহিনুর ফেরতের প্রশ্নে ব্রিটিশরা যে সেই চালই চালবে, সেটাই স্বাভাবিক!

15th     September,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ