বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি প্রীতি
পি চিদম্বরম

বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে কংগ্রেস দল গত রবিবার ‘হল্লা বোল’ র‌্যালি করেছিল। বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতির আঘাত প্রত্যেকেরই লেগেছে বলে মনে করা হয়। এটাই বিশ্বাস করা হয় যে বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি কমাবার ব্যাপারে প্রত্যেকেই বদ্ধপরিকর।
এই সর্বজনবিদিত (ভুল) বিশ্বাসটি ভাঙতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত। দেশবাসীর মধ্যে কিছু শ্রেণি আছে এবং সরকারেরও কেউ কেউ বেকারত্ব ও বেড়ে চলা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে র‌্যাগিংয়ের সুখ অনুভব করে। বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির পতাকা বেশ উঁচুতে উড়িয়ে রাখার জন্য তারা গোপনে যথাসম্ভব করবে। 
‘বেকারত্ব কে ভালোবাসে?’—এটা দিয়েই শুরু করা যাক।
ব্যবসা এবং সরকার
ব্যবসা বেকারত্ব পছন্দ করে। অল্প সংখ্যক চাকরির পিছনে অসংখ্য মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে বলে নিয়োগকর্তাদের দর কষাকষির ক্ষমতাটা বেশি 
থাকে। তার ফলে মজুরির অঙ্কটা কম হয়। মজুরি যা বাড়াতে অকিঞ্চিৎকর। উদাহরণস্বরূপ জানানো যায় যে, মুদ্রাস্ফীতির উচ্চ হার সত্ত্বেও ২০২১-২২ সালে কৃষি মজুরি বেড়েছে ৩ শতাংশেরও কম। ২০১৯ সালে ভারতে একটি কৃষি পরিবারের গড়পড়তা মাসিক 
আয় ছিল ১০,২১৩ টাকা (সূত্র: আর্থিক সমীক্ষা, ২০২১-২২)। অঙ্কটা চার-পাঁচজন সদস্যের একটি পরিবারের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বিনোদনের জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়। যেহেতু একজন চাকরিজীবী অথবা স্বনিযুক্ত ব্যক্তির পারিশ্রমিক 
নিয়ে দর কষাকষির ক্ষমতা কম, তাই একটি পরিবারের গড় আয় বৃদ্ধির পরিমাণটাও নগণ্য। যে-সময় বৃদ্ধির হার নিম্ন কিংবা মন্দা চলে, তখন গড়পড়তা পরিবারগুলিকে আরও খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। 
বেকারত্ব পছন্দ করে সরকারি নিয়োগ সংস্থা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলি (পিএসই)। কয়েকশো লোয়ার-গ্রেডের শূন্যপদের জন্য যখন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীসহ হাজার হাজার আবেদনকারী অপেক্ষা করে থাকেন, তখন নিয়োগ কর্তৃপক্ষ ব্যাপক বিচার-বিবেচনার ক্ষমতা ভোগ করেন। দালালদের রমরমা হয়, টাকার হাত বদল ঘটতে থাকে, ঘটে যায় নিয়োগ কেলেঙ্কারি। পদের চেয়ে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায়—বেসরকারি ও  রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এবং সরকারি ক্ষেত্রে স্থায়ী চাকরির সুযোগ ক্রমে সঙ্কুচিত হচ্ছে। গুরুত্ব হারাচ্ছে শ্রমিক কল্যাণ আইন। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে।
বেকারত্ব পছন্দ করে ক্রাইম সিন্ডিকেট। মাদক চোরাচালান, স্মাগলিং, অবৈধ মদের কারবার, বেটিং ও গ্যাম্বলিংয়ের অবৈধ চক্র, মানব পাচার এবং এই ধরনের অন্যান্য অপকম্মে খাটাবার জন্য বেকারদের নিয়োগের একটা বিশাল সুযোগ উন্মুক্ত থাকে। 
আসুন, এবার আলোচনা করা যাক ‘মুদ্রাস্ফীতি ভালোবাসে কে?’
কর আদায়কারী ও বিক্রেতা
রাজস্ব বিভাগ এবং কর আদায়কারীরা মুদ্রাস্ফীতি পছন্দ করেন। মাসের পর মাস, কর সংগ্রাহকরা কর সংগ্রহের একটা করে ‘নতুন উচ্চতায়’ পৌঁছনোর রিপোর্ট দেন। যেমন জিএসটি আদায়। ‘ইনফ্লেশন অ্যাডজাস্টেড নাম্বার’ ভিত্তিক রিপোর্ট তাঁরা কখনওই দেন না। গত আগস্টে জিএসটি সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ১,৪৩,৬১২ কোটি টাকা (অঙ্কটা ২০২১-এর আগস্টে ছিল ১,১২,০২০ কোটি টাকা)। কিন্তু গত ১২ মাসের গড় মুদ্রাস্ফীতি অ্যাডজাস্ট করার পর জিএসটি আদায়ের প্রকৃত অর্থাঙ্ক কমে দাঁড়ায় মাত্র ১,৩৩,৫৫৯ কোটি টাকা। সমমূল্য কর বা অ্যাড ভ্যালোরেম ট্যাক্সের ক্ষেত্রে, এমনকী করহার 
স্থির থাকাকালেও, কর সংগ্রহকারী বড়সড় সাফল্য পেতে পারেন।
বাজেট প্রস্তুতকারীরাও মুদ্রাস্ফীতি পছন্দ করেন। বাজেট নথিতে যে সংখ্যার উল্লেখ থাকে তা বর্তমান মূল্যেই। যে টাকা বরাদ্দ করা হয় তাও বর্তমান মূল্যে। সুতরাং, যিনি বাজেট প্রস্তুত করেছেন তিনি দাবি করতে পারেন যে, চলতি বছরে পূবর্বর্তী বছরের থেকে বেশি অর্থই বরাদ্দ করেছেন। বাজেট বরাদ্দের এই অঙ্ক কোনও নাগরিকই মুদ্রাস্ফীতিজনিত অ্যাডজাস্টমেন্ট আর করে দেখবেন না। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিরক্ষা, সার, খাদ্য, কৃষি, শক্তি, স্বাস্থ্য, গ্রামোন্নয়ন এবং নগরোন্নয়নের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের বাজেট বরাদ্দটি বিচার করা যায়। ইনফ্লেশন অ্যাডজাস্ট করার পর দেখা যাচ্ছে যে প্রকৃত বরাদ্দের 
পরিমাণ ২০২১-২২ অর্থবর্ষের রিভাইজড এস্টিমেটের চেয়েও কম।
সরকারি ঋণ পরিচালকরা মুদ্রাস্ফীতি পছন্দ করেন। কারণ ঋণ বর্তমান মূল্যে নেওয়া এবং পরিশোধ করা হয়। অন্যদিকে, মুদ্রাস্ফীতির হার ঋণের মূল্যমান হ্রাস করে। তার ফলে হচ্ছে কী, ঋণগ্রহীতা প্রকৃতপক্ষে গৃহীত ঋণের চেয়ে কমই পরিশোধ করেন।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে মুদ্রাস্ফীতি তাঁর কাছে বিশেষ অগ্রাধিকারের (রেড-লেটারড প্রায়োরিটি) বিষয় নয়!
মুদ্রাস্ফীতি পছন্দ করেন বিক্রেতারা। ইনপুট কস্টের (কাঁচামাল, মজুরি, ফ্যাক্টরি ওভারহেড প্রভৃতি সংক্রান্ত খরচ) বৃদ্ধি আহামরি না-হওয়া সত্ত্বেও জিনিসপত্রের সর্বোচ্চ খুচরো দাম (এমআরপি) 
যথেষ্ট বেড়ে গিয়েছে। ব্যাপারটা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্ষেত্রেই বেশি ঘটেছে। যেমন 
সম্প্রতি সারা ভারতেই সরকারি এবং বেসরকারি দু’ধরনেরই ডেয়ারিতে প্রস্তুত দুধের দাম অনেকটাই বাড়ানো  হয়েছে। 
রপ্তানিকারকরা মুদ্রাস্ফীতি পছন্দ করেন। রপ্তানি বাবদ অর্জিত প্রতিটি ডলারের জন্য রপ্তানিকারক বেশি পরিমাণ ভারতীয় মুদ্রা বা টাকা ঘরে তুলবেন। আমদানি-নিবিড় রপ্তানির ক্ষেত্রে অবশ্য অপ্রত্যাশিত লাভটা কমই হবে। 
মুদ্রাস্ফীতি পছন্দ করেন ঋণদাতারা। এমনকী ‘কস্ট অব মানি’ (ঋণদাতা যে গড়পড়তা সুদের হারে অর্থ সংগ্রহ করে থাকেন) সমানুপাতিক হারে না বাড়লেও, ঋণদাতাদের কাছে এটা সুদের হার বাড়ানোরই 
একটা মওকা।  
ব্যবসা, বিশেষ করে বড় কর্পোরেশন, একচেটিয়া কারবারিরা (ডুয়োপোলিস এবং অলিগোপোলিস) মুদ্রাস্ফীতি পছন্দ করেন। তাঁরা চড়া দাম নির্ধারণের ক্ষমতা ভোগ করেন, বিশেষ করে প্রাইস-ইনসেনসিটিভ (দামের হ্রাস-বৃদ্ধিতে বিক্রির পরিমাণে উল্লেখযোগ্য হেরফের হয় না) পণ্য ও পরিষেবার ক্ষেত্রে। যেমন—যদি আগামীকাল আপনাকে বিমানে দিল্লি থেকে চেন্নাই পৌঁছতেই হয়, তবে ক্লাস বিশেষে একটা টিকিটের জন্য ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করা ছাড়া আপনার সামনে বিকল্প নেই। ‘ডাইনামিক প্রাইসিং’ফেসিলিটি থেকে লাভবান হয়েছে বিমান সংস্থা, উবার ও ওলা এবং সরকারের রেল পরিবহণ সংস্থাগুলি। এ নিয়ে আপনার সন্দেহ থাকলে বেসরকারি সংস্থাগুলির ২০২১-২২ অর্থবর্ষের ‘লাভ ও ক্ষতি’-র বিবরণ এবং চলতি বছরের ত্রৈমাসিকের বিবরণগুলি দেখতে পারেন।
মুদ্রাস্ফীতি পছন্দ করেন ঠিকাদাররা। পুরনো এস্টিমেটগুলি রিভাইজ করা হবে। ‘প্রাইস ওভার-রান’ (বেড়ে যাওয়া খরচ)-কে সহজেই যুক্তিসঙ্গত দেখিয়ে দেওয়া যাবে। নতুন চুক্তির দরমূল্যও 
বাড়ানো হবে।
সব রাজনৈতিক দল
সম্পাদকীয় লেখকরা বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতি পছন্দ করেন। যদি একজন সম্পাদকীয় লেখকের পক্ষে একটি নতুন ঘোড়া বা গাধাকে চাবকানোর ক্ষেত্রে জড়তা থাকে, তবে তিনি বেকারত্ব বা মুদ্রাস্ফীতির উপর লেখা একটি পুরনো সম্পাদকীয় বের করুন। তার অনুচ্ছেদগুলি আগে-পিছে নতুন করে সাজিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে পারেন তিনি। তাঁর এই হাতের খেলা কেউ খেয়াল করবেন না, কারণ সম্পাদকীয় পড়েন না কেউ। 
এবং সবশেষে বলতে হয় যে, শাসক দল এবং বিরোধী দল উভয়ই বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি পছন্দ করে। শাসককে দুরমুশ করার জন্য বিরোধীদের হাতে মোক্ষম হাতিয়ার এগুলি। তাদের স্লোগান হবে—‘মোদি হ্যায়, তো মেহঙ্গাই হ্যায়’ এবং ‘মোদি হ্যায়, তো বেরোজগার হ্যায়!’ দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে  শাসক দল তখন বলবে, ‘আমাদের জমানায় বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতি তোমাদের আমলের থেকে কমই!’
এমন এক দিন আসতে পারে যখন একযোগে সবাই বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতিকে ভালোবাসবে।
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত

12th     September,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ