বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

কর্তব্যপথে দেশের মানুষের
সমস্যা মিটবে না
হিমাংশু সিংহ

 

রাজধর্ম মুছে গিয়েছিল কুড়ি বছর আগে। গুজরাতের ভয়াবহ দাঙ্গায়। নাগপুরের লেটার মার্কস পাওয়া তথাকথিত শ্রেষ্ঠ গেরুয়া নেতা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি তার নির্মম সাক্ষী। তিনি অনেক চেষ্টা করেও শিষ্যের আগুন নিয়ে খেলা ঠেকাতে পারেননি। শুধু উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত থেকেছেন। সেদিন রাজধর্ম মাথা কুটে মরেছে হানাহানির আঁস্তাকুড়ে। গুলবার্গ সোসাইটি থেকে বেস্ট বেকারির নিরীহ মানুষের আর্তনাদে। একের পর এক ঘটনায় রক্তাক্ত হয়েছে গুজরাতের রাজপথ। লঙ্ঘিত হয়েছে মানবাধিকার। বিভাজন আর সাম্প্রদায়িক উস্কানির বিষ এক নিমেষে উপড়ে দিয়েছে মনুষ্যত্বের শিকড়। এবার ঘটা করে দিল্লির ‘রাজপথ’ও মুছে গেল নেতাজিকে ঢাল করে। আগামী জানুয়ারির কুচকাওয়াজ হবে সেখানে। যদিও অনুষ্ঠানমঞ্চে ব্রাত্যই রইল বীর সুভাষের বাংলা। চলল শুধু একতরফা আত্মপ্রচার। এক আন্ডার সেক্রেটারিকে দিয়ে এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে দায়সারা আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে অপমানই করা হল বাঙালি অস্মিতাকে। বোঝা গেল সবটাই লোকদেখানো আত্মপ্রচার আর সস্তা ভড়ং ছাড়া কিছু নয়। কথা আর কাজের এই নিরন্তর টানাপোড়েনে পথ হারায় অসহায় ‘কর্তব্য’।
স্বাধীনতার আগে এই ঐতিহাসিক পথকে ব্রিটিশরা গালভরা ‘কিংসওয়ে’ নামে ডাকত। মোদিজি নতুন কিছু সৃষ্টি না করলেও ইতিহাসকে মুছে ফেলার ‘কর্তব্যে’ শুরু থেকেই অক্লান্ত। সেই মেজাজেই গত বৃহস্পতিবার বারবার তিনি নেতাজির কৃতিত্বের সঙ্গে তাঁর সাফল্যকে জুড়ে দিচ্ছিলেন অবলীলায়। নেহরু থেকে পুরনো সংসদ ভবন, সব মুছে নতুন করে পথ চলাতেই তাঁর আনন্দ। এডওয়ার্ড লুটিয়েন্সের শতাব্দী প্রাচীন কীর্তিকে ছুড়ে ফেলতেই হাজার হাজার কোটির সেন্ট্রাল ভিস্তার বর্ণাঢ্য আয়োজন। রাষ্ট্রের এই অমৃতকালে নতুন করে দেশের ইতিহাস রচনাতেই তিনি মশগুল। আগের নেতা-নেত্রী, কৃতিত্ব, সাফল্য সবকিছু তাঁর পাশে বড় ফাঁপা, ফালতু। এই ঝোঁক থেকেই কোটি কোটি টাকার শ্রাদ্ধ। নিছক ব্রিটিশের গোলামি শেষ করার নেশায় ৫০০ কোটি টাকা খরচ করে রাজপথের নিশান মুছে জন্ম হয়েছে কর্তব্যপথের। এরপর নেহরু, ইন্দিরা সহ তামাম নেতা-নেত্রীর বীর গাথা ভুলিয়ে দিতে আসছে নয়া সংসদভবন। চব্বিশের লড়াইয়ের অনেক আগেই। ভয় হয়, ধীরে ধীরে দেশের সংবিধানটাই না তাঁর এই ‘কর্তব্য’ নামক রাজনৈতিক এজেন্ডার নীচে চাপা পড়ে যায়!
কিন্তু রাস্তার নামে, কিছু ঐতিহাসিক শহর আর সৌধের নাম পরিবর্তনে সত্যিই কি আজ দেশের মানুষের কিছু যায় আসে? একদিকে মহামারীর আঘাত কাটলেও চাকরি, কাজ আজ বাড়ন্ত। অন্যদিকে নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির জন্য চাহিদা কমছে জিনিসের। ডিজেল, পেট্রল রান্নার গ্যাস কিনতেই পকেট ফাঁকা। এই সমস্যা মোকাবিলার তল খুঁজে পাচ্ছে না রিজার্ভ ব্যাঙ্কও। রেপো রেটের বদল ছাড়া আর কোনও চিচিং ফাঁক মন্ত্র জানা নেই সরকারের। তাতেও কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। অর্থমন্ত্রী বুক ফুলিয়ে বলছেন, দেশে মূল্যবৃদ্ধি নেই। আপাতত ওই বাণী বিতরণই তাঁর পবিত্র ‘কর্তব্য’। আর ঘুরে ঘুরে দেখা হম্বিতম্বি করা রেশন দোকানে মোদিজির ছবি সাঁটা হয়েছে কি না! 
আসলে সমস্যা যতই গভীর হোক, সরকার মজে সড়ক আর শহরের নাম বদলের মৌতাতে। নাম পরিবর্তনেই কি সব মত আর পথের সহাবস্থান, সংবিধানের অন্তরাত্মার অবাধ বিচরণ, দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ অটুট থাকবে? শক্তিশালী ‘ইরেজার’ সবসময় আমাদের প্রধানমন্ত্রীর হাতে মজুত। সঙ্গে তৈরি উচ্চকিত ভুবন ভোলানো ভাষণ, যা শুনতে অনেকটা নিরোর বেহালার মতোই। দু’দশক আগের গুজরাতের সেই ‘রাজধর্ম পালন করা’ মুখ্যমন্ত্রীই এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রনেতা। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম পালনের আড়াল থেকে আজও কি সুবিচার মিলছে? নাকি সবটাই শুধু ফোলানো ফাঁপানো কথার জাল। কসমেটিক চেঞ্জ। কিন্তু ভিতরে একটু খতিয়ে দেখলেই কথায় আর কাজে বহু যোজনের ফারাক। ‘কর্তব্য’ পালনের নামে এই নাটক বড্ড পীড়া দেয়। আহত করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মর্মন্তুদ ইতিবৃত্ত। শুধু গরিব মানুষ নয়, এই অমৃতকালেও ধমকে চমকে এদেশে গোরু ছাগলের মতো জনপ্রতিনিধি কেনাবেচা হয়। হাট না বসলেও পাঁচতারা হোটেল, মার্বেলে ঘেরা অট্টালিকায় নগদ টাকার বেমালুম হাতবদল হয় জনপ্রতিনিধিকে জালে পুরতে। স্বাধীনতার এতদিন পরও সেই ঘোড়া বিক্রিতে মদত দেয় ইডি, সিবিআই ও আয়কর দপ্তরের মাথারা। বাকি কাজ নগণ্য। অথচ কে ভুলতে পারে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরের সেই ভাষণ, যেখানে নোট বাতিলের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কালো টাকা খতম করার অঙ্গীকার করেছিলেন এক নিঃশ্বাসে। সেসব প্রতিশ্রুতি কেউ রাখেনি। বছরে দু’কোটি চাকরি, ব্যাঙ্কে ১৫ লক্ষ টাকা, সব ফক্কা!
গত ১৫ আগস্ট ঐতিহাসিক লালকেল্লা থেকে আগামী ২৫ বছরের রূপরেখা ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেই অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রথমেই ছিল মহিলাদের সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া নিয়ে সরকারের আপসহীন মনোভাবের হাজার ওয়াট আলোর বিচ্ছুরণ। প্রধানমন্ত্রীর সেই কথা আর কাজে কোনও মিল খুঁজে পায়নি দেশ। ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই নেমে এসেছে অসহায়তার অন্ধকার। ওই দিনেই গুজরাত সরকার বিলকিস বানোর যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ধর্ষকদের মুক্তি দেওয়ায় নারীর সম্মান ও নিরাপত্তা বিপন্ন হয়েছে। এক-দু’জন নয়, মোট ১১ জনকে মালা পরিয়ে বীরের সংবর্ধনা দিয়ে ফেরানো হয়েছে জেল থেকে। এই ঘটনা গোটা দেশকে শুধু নাড়াই দেয়নি, ‘সুবিচার’ চাওয়াটাকেও অর্থহীন ক্লিশে শব্দবন্ধে পরিণত করেছে। যে শাসনে বিচার ব্যবস্থাই আক্রান্ত, সেখানে কর্তব্যই বা কী, আর সুসজ্জিত পথেরই বা কী মানে! এই বিচারে দণ্ডিত আর দণ্ডদাতা সমান আঘাতে কাঁদতে পারে কখনও?
টানা দু’বছর জেলে কাটিয়ে গত শুক্রবার সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান অবশেষে জামিন পেয়েছেন মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে। সর্বোচ্চ আদালত হস্তক্ষেপ না করলে বোধহয় বিলকিস বানোর ধর্ষকদের বদলে বেচারা কাপ্পানকেই যাবজ্জীবন দণ্ড খাটতে হতো এ যাত্রায়! যোগীরাজ্যে পুলিস ও প্রশাসন ‘কর্তব্য’ পালনে এমনই আপসহীন। কিন্তু কী অপরাধ ছিল কেরলের ওই সাংবাদিকের? কেন জামিন দিতে গিয়ে দেশের প্রধান বিচারপতি বললেন, দেশের প্রতিটি মানুষের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে? কাপ্পানের আইনজীবী কপিল সিবাল আদালতে জানতে চাইলেন, আপত্তিকর কী পাওয়া গিয়েছে ওই সাংবাদিকের কাছ থেকে? উত্তরে বলা হল, শুধু রাষ্ট্রবিরোধী লিটারেচার। টুলকিট। তাতে লেখা ছিল ‘হাতরাসকাণ্ডে সুবিচার চাই’। ব্যস, এটুকুতেই কালা ইউএপিএ,  ২৩ মাসের অখণ্ড হাজতবাস। হাতরাসের সেই কিশোরী সুবিচার না পেলেও বিরুদ্ধ মত দেখলে ‘কর্তব্য’ পালনে যোগী সরকার বরাবরই দড়। দু’বছর আগে হাতরাসে ১৯ বছরের এক অসহায় কিশোরীর ধর্ষণের খবর সংগ্রহ করতে যাওয়ার পথে কাপ্পান গ্রেপ্তার হন। দিনটা ছিল ৫ অক্টোবর ২০২০। উত্তরপ্রদেশ সরকার জঙ্গিযোগ ও বৃহত্তর  ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ (আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট) ধারা ব্যবহার করে। ফলে দীর্ঘ সময় জামিন পাননি ওই সাংবাদিক। কাপ্পানের সঙ্গে যা করা হয়েছে, তা সীমান্ত পারের জঙ্গিদের সঙ্গে হয়। তবু ভালো যে তিনি জামিন পেয়েছেন। 
কিন্তু ওই যে বললাম, দিল্লির সরকারের অগ্রাধিকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়া মেলে না। এই মুহূর্তে দেশের মানুষ কি চাইছেন? রাস্তার পোশাকি নাম বদল না একটা সম্মানজনক চাকরি? বছরে দু’কোটি কর্মসংস্থানের খোয়াব না একটা বাস্তবসম্মত কাজ? নতুন নতুন মন্দির না উন্নত হাসপাতাল? নোটবাতিলের বেদনাদায়ক ‘ফ্লপ শো’ না কালো টাকা ধরার কার্যকর পদক্ষেপ? কঙ্কালসার রুগ্ন জিএসটি না যুক্তিগ্রাহ্য কর কাঠামো? প্রধানমন্ত্রীর বাংলো দিল্লির যে রাস্তায় তার নাম সেদিনও ছিল রেসকোর্স রোড। ওটাতে বিদেশি গন্ধ আছে, তাই নাম বদলে করা হল লোক কল্যাণ মার্গ। তাতে মানুষের কী যায় আসে। খিদে তেষ্টা মেটে? অধিকাংশ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামোও বদলে দেওয়া হয়েছে। যোজনা কমিশন তুলে দেওয়া হয়েছে। এভাবেই একটার পর একটা পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে ব্যাঙ্ক, বিমা তাবৎ সরকারি সংস্থার ঢালাও বিক্রির পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর নেই। উত্তর মিলবেও না। শুধু রাস্তার নাম বদল, পুরাতন যা কিছু, তাকে মুছে ফেলে ব্যক্তিগত কীর্তির ধ্বজাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার বিশাল আয়োজন। কিন্তু এত কাঠখড় পুড়িয়েও রাষ্ট্রসঙ্ঘের উন্নয়ন সূচকে ভারতের বিশেষ স্থান পরিবর্তন হয় না। বরং আরও দু’ধাপ নেমে ১৯১টি দেশের মধ্যে ১৩২ স্থানে চলে গিয়েছি আমরা। শ্রমিক, কৃষক, গরিব মানুষের অধিকার সুরক্ষিত নয়। সুরক্ষিত নয় সংখ্যালঘুরা। তাহলে কর্তব্যপথে দাঁড়িয়ে কোন নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখাবেন গুজরাতি সন্তান। বরং রাজপথ মুছলেও গোলামির নিশান মেটেনি। আর গত ৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় তিনি ‘কর্তব্যপথ’ উদ্বোধন করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ব্রিটেনের নবতিপর রানি প্রয়াত হয়েছেন। আজ ভারত সরকার তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে রাষ্ট্রীয় শোক পালন করতে কতকটা বাধ্য হয়েছেন। তাই মোদিজি প্রাণপণে চাইলেও সেই নিশান কিন্তু রয়েই গেল। শুধু শাসকের এক অদ্ভুত মানসিক প্রশান্তি (পড়ুন পারভারশন) ছাড়া এতে দেশের মানুষের এতটুকু উপকার হল কি? 

11th     September,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ