বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

থাপ্পড় খাচ্ছে বারবার, তবুও লজ্জা নেই
তন্ময় মল্লিক

এক কান কাটারা যায় রাস্তার ধার দিয়ে, দু’কান কাটারা মাঝখান দিয়ে। কারণ দু’কান কাটাদের অভিধানে লজ্জা শব্দটিই নেই। বিজেপির দিল্লির নেতৃত্বের কার্যকলাপ প্রমাণ করছে, তারা রাস্তার মাঝখান দিয়েই যেতে বেশি পছন্দ করে। সেই জন্য মানুষের ভোটে পরাজিত হয়েও ‘ঘোড়া’ কিনে সরকার গড়ে। অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে হটানোর গেমপ্ল্যান ফ্লপ হওয়ায় ঝাড়খণ্ড দখলে মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু সেখানেও ধাক্কা। বঙ্গ বিজেপির ঘোষিত তালিকা অনুসারে এবার বাংলার পালা। তারজন্য সিবিআই, ইডিকে লাগানো হয়েছে জমি তৈরির কাজে। বিজেপি পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা হাতাতে গিয়ে বারবার খাচ্ছে থাপ্পড়। তাতেও লজ্জা নেই। ২০২৪ যত এগিয়ে আসছে, বিজেপির ক্ষমতায় ফেরার অনিশ্চয়তা ততই বাড়ছে। সেই উৎকণ্ঠা থেকেই কি গেরুয়া শিবিরের আগ্রাসন সীমা ছাড়াচ্ছে?
দিল্লির বাসভবন থেকে সিবিআই অফিসার জিতেন্দ্র কুমারের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছে। অফিসারের আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা অন্য মাত্রা পেয়েছে দিল্লির উপ মুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিশোদিয়ার অভিযোগে। তিনি এর জন্য সরাসরি বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের দিকে আঙুল তুলেছেন। সিশোদিয়ারের দাবি, তাঁকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর জন্য সিবিআই অফিসারদের উপর অমানবিক চাপ দেওয়া হয়েছিল। সেই চাপ নিতে না পেরেই আত্মঘাতী হয়েছেন ওই অফিসার। যদিও অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ এবং ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন সিবিআইয়ের অন্য অফিসাররা। তবে, সিশোদিয়ারের এই অভিযোগের যদি বিন্দুমাত্র সারবত্তা থাকে তাহলে বলতেই হচ্ছে, পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং বিপজ্জনক।
সম্প্রতি বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের দু’জন শীর্ষ নেতাকে কেন্দ্রীয় এজেন্সি দীর্ঘক্ষণ জেরা করেছেন। তাঁদের একজন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্যজন রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক। তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক প্রায় সাত ঘণ্টা কেন্দ্রীয় এজেন্সির অফিসারদের ঘেরাটোপের মধ্যে ছিলেন। লম্বা জেরায় তাঁকে নিশ্চয়ই অনেক অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তারপরেও তিনি অফিসারদের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি, উল্টে প্রশংসাই করেছেন। প্রায় একই কথা শোনা গিয়েছে আইনমন্ত্রীর গলায়। তবে, দু’জনেই সোচ্চার হয়েছেন বিজেপির প্রতিহিংসার রাজনীতির বিরুদ্ধে।
এর আগে কংগ্রেস আমলেও বিরোধীদের শায়েস্তা করার কাজে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোকে লাগানোর অভিযোগ উঠেছে বারবার। বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, অপরাধ প্রমাণ অপেক্ষা অভিযুক্তকে হেনস্তা করে ‘অপরাধী’ সাজানোই কেন্দ্রীয় এজেন্সির উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। সেই কারণেই অধিকাংশ মামলায় অভিযুক্তরা পেয়ে যায় ‘ক্লিনচিট’। এখন কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে নির্লজ্জভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। তাই কংগ্রেস আমলে যা ছিল ‘খাঁচায় বন্দি তোতাপাখি’, মোদি-শাহের জমানায় তা হয়েছে ‘কুকুর’। অন্তত বিজেপির সর্বভারতীয় সহ সভাপতি দিলীপ ঘোষের ভাষায় তেমনটাই। বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যে দিয়েই ঠিক হয়, কোন দলের হাতে যাবে রাজ্য শাসনের অধিকার। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল পাঁচ বছরের জন্য রাজ্য চালানোর দায়িত্ব পায়। কিন্তু বিজেপির নিয়ন্ত্রণ ‘গুজরাত লবি’ নেওয়ার পর আর সেই পরিস্থিতি নেই। বিরোধী দলগুলির পাঁচ বছরের সরকার চালানোর যেমন নিশ্চয়তা নেই, তেমনই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রিত্বের পদটিও। নির্বাচন এলেই বদলে ফেলা হচ্ছে বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে। কেন্দ্রের ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে নিজের দলের মুখ্যমন্ত্রীর ঘাড়ে। আর এই সব ঘটনা বেশি করে ঘটছে নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর। 
কেন এমনটা হচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী নিজের ‘মন কি বাত’ শোনাতে এতটাই ব্যস্ত যে মানুষের মনের কথা জানার সময় পান না। ফলে জনগণের সমস্যা, চাহিদা তাঁর কাছ পর্যন্ত পৌঁছয় না। সেই জন্যই পানীয় জলের সমস্যা না মিটিয়ে, বেকারদের রোজগারের ব্যবস্থা না করে ভিস্তা প্রজেক্টের পিছনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করতে পারেন অনায়াসেই।
জনগণের মন জয় করার মতো কোনও কাজই মোদি সরকার করেনি। অথচ পাহাড়প্রমাণ জনসমর্থন নিয়ে দু-দু’বার ক্ষমতায় বসেছেন নরেন্দ্র মোদি। মনমোহন সিংয়ের মতো জোট শরিকদের চোখরাঙানি তাঁকে সহ্য করতে হয়নি। শুধু সরকারের মধ্যেই নয়, দলেও তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কেউ যাতে বাধা হতে না পারে তারজন্য আগেই পরিষ্কার করেছেন রাস্তা। লালকৃষ্ণ আদবানির মতো বিজেপির লৌহমানবকেও ‘কাঠের পুতুল’ বানিয়ে দিয়েছেন। ফলে সরকারে এবং দলে মোদিজি একেবারে নিষ্কণ্টক।  
সরকার চালানোর জন্য এমন অনুকূল পরিস্থিতি অটলবিহারী বাজপেয়িও পাননি। তা সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদি জনস্বার্থে এমন কিছু করেননি, যার জোরে বিজেপির ক্ষমতায় ফেরা নিশ্চিত হতে পারে। উল্টে এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যার জন্য মানুষ বিজেপির উপর বীতশ্রদ্ধ। সেটা বুঝেই কাউকে ভয় দেখিয়ে, কাউকে টোপ দিয়ে বিরোধীদের দুর্বল করতে চাইছেন। মোদিজির উদ্দেশ্য, ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়া। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে লাভ-ক্ষতির অঙ্কটাও গুলিয়ে ফেলছেন। দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি করে নরেন্দ্র মোদি শুধু নজির সৃষ্টিই করেননি, দিয়েছিলেন চমকও। পিছিয়ে পড়া আদিবাসী সমাজের একজন প্রতিনিধিকে দেশের রাষ্ট্রপতি করার ভাবনা অবশ্যই কুর্নিশযোগ্য। তবে অনেকেই মনে করেন, আদিবাসী ভোটকে কাছে টানাই তাঁর লক্ষ্য। তবে উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি হওয়ায় আদিবাসীদের মধ্যে আলোড়ন পড়েছিল। তৈরি হয়েছিল আবেগ। কিন্তু তা জোর ধাক্কা খেল একজন আদিবাসী মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রয়াসে।
মধ্যপ্রদেশের পর মহারাষ্ট্রে ‘অপারেশন লোটাস’ সফল হতেই দিল্লি ও ঝাড়খণ্ডকে টার্গেট করেছিল বিজেপি। দিল্লির উপ মুখ্যমন্ত্রীর পিছনে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে লাগিয়ে আপের অন্য বিধায়কদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। পাশাপাশি দেওয়া হয়েছিল আর্থিক টোপ। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। ঝাড়খণ্ড দখল বিজেপির কোনও গোপন এজেন্ডা নয়। শিবসেনাকে ভাঙিয়ে মহারাষ্ট্র কব্জা করার পরই ঝাড়খণ্ড দখলের কথা ঘোষণা করেছিল বঙ্গ বিজেপি। গুয়াহাটি ফেরত ঝাড়খণ্ডের তিন কংগ্রেস বিধায়ক টাকাসহ ধরা পড়ায় বিজেপির গেমপ্ল্যানে কিছু অদলবদল হয়। কিন্তু হেমন্ত সোরেনকে সরানোর চেষ্টায় ছেদ পড়েনি। দিল্লির বিজেপি নেতৃত্ব ভেবেছিল, হেমন্ত সোরেনের বিধায়ক পদ খারিজ হয়ে যাচ্ছে, এই আতঙ্ক ছড়িয়ে দিলেই ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার বিধায়করা বিজেপির পিছনে লাইন দেবেন। সেই সুযোগে বিজেপি মহারাষ্ট্রের স্টাইলে কব্জা করে নেবে ঝাড়খণ্ডও। কিন্তু শিবু সোরেনের ছেলে বিজেপিকে সেই সুযোগটা দেননি। বরং তাঁর পাল্টা চালে হয়েছে কিস্তিমাত। আস্থা ভোট ডেকে হেমন্ত সোরেন প্রমাণ করে দিয়েছেন, তাঁর শক্তি অটুট।
গেরুয়া শিবির যাতে ঘোড়া কেনার বিন্দুমাত্র সুযোগ না পায় তার জন্য ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী জোটের বিধায়কদের রেখেছিলেন ছত্তিশগড়ের রিসর্টে। এক্কেবারে বিজেপির স্টাইল। বাসের সিটের উপরে লেখা থাকে, ‘মাল নিজ দায়িত্বে রাখিবেন’। মোদি-শাহের আমলে ‘অপারেশন লোটাস’ দেখতে দেখতে বিরোধীরাও বুঝেছেন, শুধু মাল নয়, বিধায়কদেরও রাখতে হবে ‘নিজ দায়িত্বে’। একটু অন্যমনস্ক হলেই ছোঁ মারবে বিজেপি। তাতে যদি কেড়ে নিতে নাও পারে, দাগি করে দেবে। বাংলায় বিজেপি আপাতত সেই ‘দাগি’ করার চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে শাসক দলের নেতা, মন্ত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা, এমনকী জেলে পাঠানোর পরেও তৃণমূলে ‘দমবন্ধ’ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে না। আক্রমণের মুখে পড়েও ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে না। গেরুয়া শিবিরের সামনে পড়ছে না নেতাদের লাইন। হচ্ছে না ‘যোগদান মেলা’।  
‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে’র সামনে মাথা নত করাটাই প্রথা। কিন্তু তার উল্টোটা ঘটলেই ঘা লাগে শাসকের আঁতে। বাংলায় হচ্ছে সেটাই। সিবিআই, ইডি যত আক্রমণ শানাচ্ছে ততই তীব্র হচ্ছে বিজেপি বিরোধী জেহাদ। আত্মসমর্পণের বদলে শাসকের চোখে চোখ রেখে হচ্ছে কথা। আর সেটাই গেরুয়া শিবিরের শিরঃপীড়ার সবচেয়ে বড় কারণ।

10th     September,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ