বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

‘থার্ড বয়’ হওয়ার গল্প, প্রচারের ঢক্কানিনাদ
মৃণালকান্তি দাস

ইন্ডিয়া ফার্স্ট! স্বাধীনতা দিবসে এই শব্দ যুগলেই দেশবাসীকে নতুন মন্ত্রের পাঠ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর হাত ধরেই আজকের কেন্দ্রের সরকার অন্য সকলের চেয়ে কেন আলাদা, তার গাদা গাদা উদাহরণ নিত্য রেখে যাচ্ছেন। এসবের মাশুল ভবিষ্যতে দেশকে কীভাবে দিতে হবে— সে প্রশ্নের উত্তর হাতড়ানোর চেষ্টা পরের কথা। এই মুহূর্তের সত্য হল, মোদিজির নতুন নতুন মন্ত্রে বিজেপি নিজেদের অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। নিয়ে গিয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। মোদি জমানায় শিল্পের মর্যাদা পেয়েছে প্রচারের ঢক্কানিনাদ। কোনও প্রধানমন্ত্রী এমন সার্থক ‘ইভেন্ট ম্যানেজার’ হিসেবে নিজের উত্তরণ ঘটাতে পারেননি। অনেকেই হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছেন, প্রচার ভগবানকে ভূত করে, ভূতকে ভগবান।
চলতি সপ্তাহে ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনের কথাই ধরুন। ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, গত বছর শেষ তিন মাসে ভারত ব্রিটেনকে টপকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। এই বিশ্লেষণ মার্কিন ডলারের উপর ভিত্তি করে। এক দশক আগেও ভারতের স্থান ছিল এগারো। এসব শুনতে বিলক্ষণ গালভরা। সরকারও নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায়। কিন্তু, পরিসংখ্যানের হিসেবে কি অর্থব্যবস্থার চাকা নড়ে?
তথ্য বলছে, গত জুলাইয়ে আটটি মূল পরিকাঠামো শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির হার নেমেছে ৪.৫ শতাংশে, যা ছ’মাসে ন্যূনতম। আমদানি ৩৭ শতাংশ বেড়ে ৬,১৬৮ কোটি ডলারে পৌঁছনোয় বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে হয়েছে ২,৮৬৮ কোটি ডলার। একদিকে আমদানি বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডলার বিক্রির কারণে ২৬ আগস্ট শেষ হওয়া সপ্তাহে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার সঙ্কুচিত হয়ে নেমেছে ৫৬,১০৫ কোটি ডলারে। প্রতিদিন রেকর্ড হারে পড়ছে ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম। 
মোদি জমানায় দেশে বেকারত্বের হার পৌঁছে গিয়েছে ৮.৩ শতাংশে। সরকার চায়, দেশপ্রেমের দিনমজুর। ৭৫ বছরের দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে এবং এক উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি হাতে পেয়েও ভারত তিনটি প্রাথমিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় রেখেছে— ম্যাট্রিকুলেশন স্তর পর্যন্ত সর্বজনীন স্কুলশিক্ষা, সর্বজনীন ও সুষ্ঠু স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং সকলের জন্য জীবিকার নিশ্চয়তা। আর্থিক উপদেষ্টা সংস্থা মোতিওয়াল অসওয়াল বলছে, ভারতে নাকি চিকিৎসার খরচ বেড়েছে ১৪ শতাংশ হারে। এই হার নাকি এশিয়ার মধ্যে সর্বাধিক। সাধারণ পণ্যের দামও বাড়ছে লাফিয়ে। সাধারণের জন্য প্রোটিনের অন্যতম সূত্র ডিমও আজ সাত টাকা ছুঁতে চলেছে। সরকারি পরিসংখ্যাই বলছে গোটা দেশে পিছিয়ে পড়া জেলার সংখ্যা ছিল ১১২, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৩। সরকারের ভূমিকা কী?
সেই ১৯৫৪ সালে লোকসভায় রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের নগ্ন চেহারা তুলে ধরেছিলেন বিজ্ঞানী তথা সাংসদ মেঘনাদ সাহা। তিনি বলেছিলেন, ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কর্পোরেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনসাধারণের অর্থ শিল্পপতিদের পকেটে চলে যায়। মিশ্র অর্থনীতিতে এভাবেই শিল্পপতিরা মূলধন জোগাড় করে। ১৯৬৫ সালে একচেটিয়া অনুসন্ধান কমিশনের রিপোর্ট জানিয়েছিল, ৭৫টি একচেটিয়া শিল্পগোষ্ঠীর হাতে দেশের ১৫৩৬টি শিল্প সংস্থা রয়েছে। যত বছর এগিয়েছে, তত এই কেন্দ্রীভবন ও মনোপলি বেড়েছে।
সম্প্রতি পার্লামেন্টে বাদল অধিবেশনে অর্থমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী ভাগোয়াত কারাদ স্বীকার করেছেন, গত পাঁচ বছরে কেন্দ্রের মোদি সরকার দেশের শিল্পপতিদের ঋণ মকুব করেছে ৯ লক্ষ ৯১ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। তার মধ্যে দশজন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীর নাম: ১) মেহুল চোকসির গীতাঞ্জলি জেম ৭,১১০ কোটি টাকা। ২) ইরা ইনফ্রা ইঞ্জিনিয়ারিং ৫,৮৭৯ কোটি টাকা। ৩) কনকাস্ট স্টিল অ্যান্ড পাওয়ার লিঃ ৪,১০৭ কোটি টাকা। ৪) আরইআই অ্যাগ্রো লিঃ ৩,৯৮৪ কোটি টাকা। ৫) এবিজি শিপ ইয়ার্ড ৩,৭০৮ কোটি টাকা। ৬) ফ্রস্ট ইন্টারন্যাশনাল লিঃ ৩,১০৮ কোটি টাকা। ৭) উইনসাম ডায়মন্ডস ২,৬৭১ কোটি টাকা। ৮) রাটোম্যাক গ্লোবাল প্রাঃলিঃ ২,৪৮১ কোটি টাকা। ৯) কোস্টাল প্রজেক্টস লিঃ ২,৩১১ কোটি টাকা। ১০) কুদোস চেমি ২,০৮২ কোটি টাকা। এক কলমের খোঁচায় দেশের সাধারণ মানুষের ১০ লক্ষ কোটি টাকা গায়েব করে দিয়েছে এই মোদি সরকার। তাঁর মন্ত্রী তো পার্লানেন্টে শুধু দশজনের নাম বলেছেন। কে জানে, এরকম আরও কত ‘মিঁত্র’ আছেন, যাঁরা পিএম কেয়ার্স ফান্ড, রাম মন্দিরে কত কোটি কোটি টাকা ঢালছেন। বিদেশে কয়েকজন পগার পার। সিবিআই, ইডিকে কিন্তু তাঁদের পিছনে ছুটতে দেখা যায় না। কারণ, শাহের অঙ্গুলি হেলন ছাড়া তাদের নড়াচড়া করার ক্ষমতাই নেই। ঠুঁটো!
আইনি ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ওই শিল্পপতি কিংবা ব্যবসায়ীরদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি দেশের অর্থমন্ত্রী। শিল্পপতিদের একাংশ ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাঙ্ক ঋণ শোধ করেন না। ফলে তাঁদের আয় বাড়ে একশো শতাংশের উপর। এমনকী ব্যাঙ্কের ৬৮ শতাংশ প্রফিট অনাদায়ী ঋণের জন্য প্রভিশন করে রাখা হয়। দেশের ব্যাঙ্ক ভোগে যাক, মোদি সরকারের কোনও যায় আসে না। সরকারি হিসেব বলছে, গত ৮ বছরে ৬০৯ জন রাজনীতিক, তাঁদের পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ এবং সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি তল্লাশি চালিয়েছে। এঁদের মধ্যে বিজেপির সঙ্গে যুক্ত মাত্র ৩৯ জন। অথচ, ওই ‘মিঁত্র’ শিল্পপতিদের ক’জনের বাড়িতে সিবিআই, ইডি ও আয়কর দপ্তর হানা দেয়? কোথায় দেশের আইন ব্যবস্থা? ‘স্বতন্ত্রতা কা অমৃত মহোৎসব’-এ এই প্রশ্নগুলিও কিন্তু দগদগে হয়ে থাকবে।
মোদি জমানায় একের পর এক নিত্যনতুন প্রকল্প গালভরা নাম নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। মুছে ফেলা হচ্ছে আগের নাম, পুরনো প্রকল্পের স্মৃতি! ব্যর্থতার খতিয়ান। প্রতিষ্ঠানগুলিকে দিন দিন দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে। ‘স্বচ্ছ ভারত’ নিয়ে আজকাল তো কেউ কথাই বলে না। ‘আয়ুষ্মান ভারত’ বিস্মৃতপ্রায়। এখন মাঠ দাপাচ্ছে নতুন প্রকল্প বুদ্ধিমান ভারত। ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ কত কিশোরীর জীবন বদলেছে পরের কথা, বিজ্ঞাপন বাবদ সরকার খরচ করেছে ৪০১ কোটি, যা মোট বাজেট বরাদ্দের ৫৮ শতাংশ! ‘মুদ্রা যোজনা’ আটকে আছে স্রেফ ঋণ-বণ্টনের অঙ্কে। সাফল্য এলে ক্ষুদ্র অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ত। বেকারত্ব ঘুচত। রোজগার বাড়ত। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া’-এর মতো গালভরা বাক্যবন্ধে অর্থনীতি বন্দি থাকত না। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, মূল্যবৃদ্ধি এমন আহামরি কিছু নয়, ক্রমেই কমবে, অতএব সেটাই ধ্রুব সত্য। বেকারত্বের হার প্রায় অর্ধশতাব্দীর রেকর্ড ভেঙে দিলেও তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনও কারণ আছে বলেও তিনি মনে করেন না। কোভিড-পরবর্তী যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এটাই দস্তুর। সুতরাং তর্কই বৃথা।
দেশ চলছে ‘গিগ’ অর্থনীতিতে। এই অর্থনীতির ধারা অনুযায়ী, ডেলিভারি বয় থেকে শুরু করে নানারকম নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, কর্মসংস্থান হচ্ছে, উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু তাঁদের না আছে নির্দিষ্ট মজুরি, না কাজের স্থায়িত্ব। পরিষেবা ক্ষেত্রে নিযুক্ত বিশাল সংখ্যক শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকার, মর্যাদা কিছুই নেই। তাঁদের কাজ আছে, কিন্তু চাকরি নেই। অক্সফ্যাম ইন্টারন্যাশনালের হিসাব অনুযায়ী এ দেশের একজন অসংগঠিত শিল্পশ্রমিক যা মাইনে পায় তাতে তার ৯৪১ বছর লাগবে বস্ত্রশিল্পের একটা বড় কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ এক্সিকিউটিভের এক বছরের সমান মাইনে পেতে। ভারত আজ সস্তা শ্রমের বাজারের জন্য আন্তর্জাতিক পুঁজির লোভনীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। আবার মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলে ভারতের শিল্পগোষ্ঠীগুলির পুঁজিও অবাধে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে।
মোদি সরকার দাবি করেছে, ভারতের অর্থনীতি পোক্ত, দেশবাসীর রোজগার বাড়ছে এবং মাথা তুলছে কর্মসংস্থানের হার। কিন্তু সেই দাবিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে উপদেষ্টা সংস্থা সিএমআইই জানিয়েছে, বেকারত্ব আগস্টে বেড়ে ৮.৩ শতাংশ ছুঁয়েছে। শহরে ৯ শতাংশ, গ্রামে ৭.৭ শতাংশ। দু’টোই জুলাইয়ের থেকে বেশি। সিএমআইই বলেছে, যে যুবসম্প্রদায় আর্থিক বৃদ্ধির বৃহত্তম সূত্র, তাদেরই কাজের সুযোগ কমেছে। গত অর্থবর্ষে তাদের কর্মসংস্থানের হার ১০.৪ শতাংশে নেমে পাঁচ বছরে সর্বনিম্ন হয়েছে। অথচ, ২০১৬-১৭ সালে ছিল ২০.৯ শতাংশ। কেন্দ্রের সমালোচনায় মুখ খুলেছিলেন খোদ বিজেপি সাংসদ বরুণ গান্ধী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, সরকারি দপ্তরগুলিকে ১০ লক্ষ খালি পদ পূরণ করতে। কিন্তু তারা কেউ যথাযথ পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেনি। টুইটে তাঁর প্রশ্ন, লড়াই করে এগিয়ে চলা ওই তরুণ-তরুণীরা আর কত দিন অপেক্ষা করবেন? উত্তর নেই নির্মলা, অনুরাগদের কাছে।
২০২৯ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির ‘থার্ড বয়’ হয়ে ওঠার গল্পে উদ্বাহু হলেই বিপদ। গেরুয়া শিবিরের আশার ছলনে আমরা যেন একথা ভুলে না যাই।

8th     September,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ