বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

প্রতিশ্রুতির অন্তহীন পতাকা উড়ছে
সমৃদ্ধ দত্ত

স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষ উদযাপনের সবথেকে জনপ্রিয় স্লোগান রাষ্ট্র উপহার দিয়েছে। শুধু এই বছর নয়। গত ৭৫ বছরের মধ্যে এটাই সম্ভবত সেরা স্লোগান। হর ঘর তিরঙ্গা। অর্থাৎ সব ঘরে জাতীয় পতাকা লাগাতে হবে। স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষের ক্যাচলাইন যখন, নিশ্চয়ই বহু গবেষণা, বহু চিন্তাভাবনা, বহু স্লোগান তৈরি করে, বাতিল করে, আবার তৈরি করে, আবার খারিজ করে, অবশেষে এরকম একটি মনোরম পছন্দসই স্লোগানকেই মনোনীত করা হয়েছে? সেটাই স্বাভাবিক। এই স্লোগানের উদগাতা যিনিই হন, তিনি অত্যন্ত চমকপ্রদ একটি বার্তা দিয়েছেন এই স্লোগানের মাধ্যমে। গোটা বিশ্ব যখন এই স্লোগানটি এবং তার অর্থ শুনেছে, তখন বিস্মিত হয়েছে। ভারতের প্রতি শ্রদ্ধাও হয়েছে সকলের। কারণ এরকম একটি স্লোগানের অন্তর্নিহিত অর্থ হল, ভারতের সকলের কাছে ঘর আছে। তাহলেই তো সম্ভব হর ঘর তিরঙ্গা লাগানো! হর ঘর তিরঙ্গা যে সফল হবে, এটা রাষ্ট্র কখন ভাববে? যখন সে নিজে নিশ্চিত যে ১৪০ কোটি মানুষের প্রত্যেকের ঘর আছে। অবশ্য এই আত্মবিশ্বাস নতুন নয়। এর আগে করোনা যখন শুরু হয়, সেই ২০২০ সালে আমরা দেখেছিলাম, রাষ্ট্র আদেশ দিয়েছিল করোনাযোদ্ধাদের সম্মান জানাতে প্রত্যেককে ব্যালকনিতে থালা বাসন অথবা ঘণ্টা বাজাতে হবে। দিতে হবে করতালি। অর্থাৎ রাষ্ট্র নিশ্চিত ছিল, ভারতবাসীর সকলের ব্যালকনি আছে। 
পরবর্তী ইভেন্ট ছিল প্রদীপ অথবা মোমবাতি জ্বালানো। রাত্রির একটি নির্দিষ্ট সময়ে সকলকে ঘরের সমস্ত বৈদ্যুতিক আলোর সুইচ অফ করে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ গোটা ভারত একসঙ্গে এরকম করবে। সকলের ঘরে ঘরে কিছুক্ষণের জন্য শুধু প্রদীপ অথবা মোমবাতি জ্বলবে। তখনও রাষ্ট্রের কাছে রিপোর্ট ছিল নিশ্চয়ই যে, ভারতের সকলের ঘরেই বিদ্যুতের আলো আছে। সকলের ঘরেই বিদ্যুতের সুইচ নেভানোর মতো একটি করে স্বপ্ন আছে। এখানেই কি শেষ ছিল? না। আমরা জানতে পেরেছিলাম, যদি করোনার ভ্যাকসিন নিতে হয়, তাহলে সকলের মোবাইলে কোউইন অ্যাপ ডাউনলোড করতে হবে। এই নতুন ভারতের পরিচালকরা এমনিতে ভাত ও রুটির বদলে অ্যাপ এবং ডাউনলোড জাতীয় শব্দ বেশি ব্যবহার করে। কর্মসংস্থানের থেকে বেশি জোরে শোনা যায় ডিজিটাল নামক শব্দটি। সুতরাং, সেই সময়ও দিল্লির কেন্দ্রস্থলে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া রাষ্ট্রের ধারণা ছিল, প্রত্যেক ভারতবাসীর কাছেই নিশ্চিত স্মার্ট ফোন আছে। আর তাই যে কোনও স্তরের দেশবাসীই সক্ষম কোউইন অ্যাপ ডাউনলোড করতে। সর্বোপরি মেসেজ আসবে মোবাইলে। অর্থাৎ মোবাইলও থাকতেই হবে। তাহলে অলিখিত শর্ত কী ছিল? মোবাইল থাকতে হবে, অ্যাপও থাকতে হবে। অথচ আসল সত্য হল, সকলের ঘরে বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল নেই, ঘর নেই। 
কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালকরা ক্লান্ত হন না সেই কারণেই নবতম স্লোগান, হর ঘর তিরঙ্গা। কিন্তু ঘর কোথায়? ২০১৫ সালে একটি উচ্চগ্রামের সরকারি ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রকল্পের নাম প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা। ২০২২ সালে ভারতে সকলের জন্য ঘর হবে। ২০২২ কেন? কারণ, ২০২২ স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষ। তা‌ই এই উপহার ও গৌরব। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। কী জানি হতেও পারে। আনন্দে শিহরিত হয়েছিলাম। ভারতবর্ষে সকলের একটি করে ঘর থাকবে? আশ্চর্য আনন্দদায়ক স্বপ্নপূরণ! এখন ২০২২ সালে কী জানতে পারছি? ওই প্রকল্প ও লক্ষ্যের সময়সীমা পিছিয়ে করা হয়েছে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তার অর্থ কী? অর্থ হল, আজ এই ২০২২ সালে সকলের জন্য ঘর হয়নি। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী। তাহলে হর ঘর তিরঙ্গা স্লোগান সফল হবে কীভাবে? গ্লোবাল ট্র্যাকার অফ হাউজিং পভার্টির সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে এখন প্রয়োজনের তুলনায় সাড়ে ৭ কোটি বাসস্থান কম আছে। এর মধ্যে আড়াই কোটি শহরে। পাশাপাশি আরও সাড়ে ৯ কোটি ভারতবাসী বাস করে বিভিন্ন নগরের বস্তিতে। আরবান স্লাম। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা কীভাবে ঘর তৈরি করে? দুটি স্কিমে। ১) ক্রেডিট লিঙ্কড সাবসিডি স্কিম। যা দেয় সুদহীন লোন। আর একটি হল, আ‌ইএন-সিআইটিইউ স্লাম রিডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম। কেন্দ্রীয় অনুদান দেওয়া হয় যোগ্য বস্তিবাসীদের বাড়ি নির্মাণের। কিন্তু লক্ষ্য এবং স্বপ্নপূরণ ২০২২ সালেও হল না। 
কী বলা হয়েছিল ২০১৭ সালে? কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হবে ২০২২ সালে। কেন? কারণ ২০২২ সাল স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষ। তাহলে ২০২২ সালে কৃষকরা কেমন আছে? ২০০২ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কৃষকদের বার্ষিক আয়ের বৃদ্ধিহার বেড়েছিল গড়ে ২০ শতাংশ করে ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়সীমায় দেখা গিয়েছে বছরে আয়বৃদ্ধির হার কমে হয়েছে গড়ে ১২ শতাংশ। ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যান্ড সার্ভে অর্গানাইজেশনের রিপোর্টে এই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। 
বার্ষিক আয়ের বৃদ্ধিহার কমেছে। তাহলে কী বেড়েছে? আত্মহত্যার হার। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (২০২১) বলেছে, কৃষকদের আত্মহত্যার হার ২০২০ সালে বেড়ে গিয়েছে। ১৮ শতাংশ বেড়েছে খেতমজুরদের আত্মহত্যা। কিন্তু কৃষকদের আত্মহত্যাই শুধু বেড়েছে? আর কিছু বাড়েনি? অবশ্যই বেড়েছে। চাষের কাজে সবথেকে বেশি প্রয়োজন যে সারের, সেই ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেটের দাম বেড়েছে নজিরবিহীন। ৫৮ শতাংশ। সারের দাম বৃদ্ধি পেলে কার লাভ হয়? সার উৎপাদন করা কর্পোরেট শিল্পসংস্থাগুলির। কাদের ক্ষতি হয়? কারা চাষ ছেড়ে দেয়? কৃষকরা। মূলত কোন কৃষকরা? প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকরা। আর কী বেড়েছে? কৃষি উপকরণের উপর জিএসটি। কত? প্রায় প্রতিটি কৃষি উপকরণ কিনতে গেলে জিএসটি দিতে হয় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ। 
২০১৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ১ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকার বুলেট ট্রেন প্রকল্প ঘোষণা করে বলা হয়েছিল ২০২২ সালে ভারতের প্রথম বুলেট ট্রেন চলবে। সেই বুলেট ট্রেনের স্ট্যাটাস কী এখন? আমেদাবাদ থেকে মুম্বই তো দূর অস্ত। ২০২৬ সালে প্রথম ট্রায়াল রান হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। তাও আবার সুরাত থেকে বিলমোড়া। কতটা দূরত্ব? মাত্র ৬১ কিলোমিটার। আমেদাবাদ থেকে মুম্বই মোট কত দূরত্বে চলার কথা ছিল? ৫৬৮ কিলোমিটার। কবে চালু হওয়ার কথা ছিল? ২০২২ সালে।  ২০২৫ সালের মধ্যেই ভারতের অর্থনীতি হবে ৫ লক্ষ কোটি ডলার। এরকমই ছিল ঘোষণা। এখন সেই ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি কোথায় দাঁড়িয়ে? প্রাক্তন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গভর্ণর ডি সুব্বারাও সোমবার বলেছেন, কোনও সম্ভাবনা নেই। ২০২৯ সালে হতেও পারে। তবে যদি প্রতি বছর আর্থিক বৃদ্ধিহার ৯ শতাংশ করে হয়। যা অসম্ভব আপাতত। 
এই যে আমাদের এরকম সব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় এবং আমরা হাততালি দিই, এর অর্থ কী? এর অর্থ হল, আমাদের যা খুশি বলা যায় এই আত্মবিশ্বাস রাষ্ট্র অর্জন করেছে। আমরা যে আসলে পুতুল হয়ে গিয়েছি সেটা জানে তারা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিভিন্ন পাড়ার জলসা কিংবা সমাজসেবামূলক অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যেই ঘোষক কিংবা আয়োজকরা গানবাজনা শুনতে কিংবা অনুষ্ঠান দেখতে আসা সাধারণ দর্শকদের বলে থাকে, আরও একবার জোরদার হাততালি হয়ে যাক অমুকদার জন্য। কিংবা এবার হাততালি দিয়ে আমরা বরণ করে নেব তমুককুমারকে। একবার দুবার ঠিক আছে। কিন্তু মাঝেমধ্যেই দেখা যায়,  কিছুক্ষণ পরপর হাততালি দেওয়ার নির্দেশিকা দেন ঘোষক ঘোষিকা। আমরা তৎক্ষণাৎ হাততা঩লি  ঩দিয়ে উঠি। কাকে দিচ্ছি, কেন দিচ্ছি অনেক সময় না বুঝেই। নতুন ভারতে যেন একটি অন্তহীন জলসা চলছে। বিভিন্ন ইভেন্ট হয়। মাঝেমধ্যেই বক্তৃতা হয়। আর দর্শকাসনে বসে থাকা আমাদের বলা হয় হাততালি দিতে। আমরা আগুপিছু না ভেবে ঠিক সেটাই করে চলেছি। বছরের পর বছর।  প্রতিশ্রুতিরা ক্লান্ত হয় না। আমরাও হই না! 

19th     August,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ