বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির সাতকাহন
মৃণালকান্তি দাস

ধরুন কোনও শিল্পপতি দেশের কোনও এক রাজনৈতিক দলকে ইলেক্টরাল বন্ড হিসেবে ৫০ কোটি টাকা দিতে চান। সুবিধে কী? ইলেক্টরাল বন্ডে যিনি বা যে দল টাকা নিচ্ছে এবং যারা টাকা দিচ্ছে, তাদের সম্পর্কে কোনও তথ্য থাকবে না। আপনি জানতেও পারবেন না, এত টাকা একটা রাজনৈতিক দলকে কে বা কারা দিল। তা জানার কোনও পথ খোলা নেই। শুধু জানেন, ১০ হাজার, ১ লক্ষ, ১০ লক্ষ ও এক কোটি টাকায় বিক্রি হয় এই বন্ড। বন্ড বিক্রির ক্ষেত্রে ভূমিকা নেয় স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া।
আপনি কোনওদিন জানতেই পারবেন না, এই টাকা লেনদেনের পূর্বশর্ত কী। লেনদেনের পরে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনো রাজনৈতিক দল কীভাবে দাতার প্রত্যাশা পূরণ করেন। যেমন জানতে পারবেন না, এই পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে শিল্পপতি সরকারের থেকে কী সুবিধে আদায় করছে। সরকার বলছে, লেনদেনের এই গোপনীয়তা নাকি আর্থিক দুর্নীতি এড়াতে। লেনদেনে যদি স্বচ্ছতাই থাকে, তাহলে এত গোপনীয়তার দরকার আছে কি?
সরকারের যুক্তি, বন্ড কেনার ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক ড্রাফট, চেক বা ইলেক্ট্রনিক ট্রান্সফারকেই বৈধ মনে করা হয়। সেক্ষেত্রে যিনি বন্ড কিনবেন তাঁকে সাদা টাকাতেই তা কিনতে হবে। ফলে কালো টাকার কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু যে বিষয়টি আড়াল করা হয়, তা হল, যে কোনও শিল্পপতি ইলেক্টরাল বন্ড কিনে সেই বন্ড আবার অন্য কারোর কাছে বিক্রিও করতে পারেন। অর্থাৎ, যে কেউ বেনামে শিল্পপতির কেনা বন্ড পুনরায় কিনতে পারেন এবং রাজনৈতিক দলকে তা উপহার দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কতটা দুর্নীতির খেলা চলে তা আপনি জানতেও পারবেন না। কারণ, সবই থাকে গোপন! কেউ কখনও জানতেই পারবে না, আসল ক্রেতার থেকে কে এই বন্ডটা কিনেছিল।
এই গোপন খেলায় সরকারে থাকা শাসক-দলের প্রতিনিধিরা কিন্তু জেনে যাচ্ছে মোট কী পরিমাণ টাকা ঘরে ঢুকল, কারা সেই টাকা দিল, তারা বাদে আর কোন রাজনৈতিক দল কত টাকা পেল কিংবা বিরোধীদের টাকা জোগাচ্ছে কোন শিল্পপতিরা। সেটা কীভাবে? সহজ যুক্তি। ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের ৮০ শতাংশের মালিক ভারত সরকার। তাদের পক্ষে কে কাকে কত টাকা দিচ্ছে তা বোঝা আদৌ কঠিন নয়। কারণ, প্রত্যেক ইলেক্টরাল বন্ডে একটা সিরিয়াল নং থাকে। তা দেখেই সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় কে বা কারা এই টাকা দিচ্ছে। এর ফলে দেশের ছোট-বড়-মাঝারি সমস্ত শিল্পপতির ‘টিকি’ এখন গেরুয়া শিবিরের হাতের মুঠোয়। আসলে এই বন্ড কেনা নিয়ে মোদি সরকার সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে চলেছে। আজও।
সাংবিধানিক অধিকারকে পরাভূত করে, প্রাতিষ্ঠানিক বিপর্যয় সুনিশ্চিত করে, দেশের শাসক যে ঔদ্ধত্য ও ঔদাসীন্যে ভরপুর, সেখানে নাগরিকের গণতান্ত্রিক ভাবনার বিন্দুমাত্র দাম নেই। ‘আচ্ছে দিন’-এর বুলি আওড়ে, সবার সঙ্গে সবার বিকাশের মঙ্গলময় মন্ত্রপাঠ করে, শেষাবধি সবাইকে নিয়ে দুর্নীতির পাঁকে ডোবার এই রাজকাহিনি সত্যিই বিরল। ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সংসদে প্রথম ইলেক্টরাল বন্ড বাজারে আনার কথা বলেছিলেন। এর জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সম্মতির দরকার ছিল। এতে সম্মতিসূচক মতদান মানেই ভারতীয় মুদ্রার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা নষ্ট হওয়া। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কিং নীতিটাই নষ্ট হতে পারে। বাড়তে পারে অর্থ পাচারের পরিমাণ। আশঙ্কা করেছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তাদের দেওয়া বার্তাকে তৎকালীন রেভিনিউ সেক্রেটারি হাসমুখ আধিয়া কীভাবে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন তা কারও অজানা নয়। স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার কোনও কথাই সেদিন ধোপে টেকেনি।
আগে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে রাজনৈতিক খাতে বিনিয়োগের খতিয়ান দেখাতে হতো অর্থবর্ষের শেষে। কোনও রাজনৈতিক দলকে বার্ষিক মুনাফার ৭.৫ শতাংশের বেশি অনুদান দেওয়ার এক্তিয়ার ছিল না কর্পোরেট সংস্থার। এখন আর সেই দায়ও নেই। এমনকী আরটিআই করেও যাতে কারা কত টাকা দিচ্ছে তা জানা না যায় সেই ব্যবস্থাও করে দিয়েছে অর্থমন্ত্রক। আরবিআই চেয়েছিল সর্বোচ্চ কতগুলি বন্ড কেন যাবে তা বেঁধে দিতে, এই প্রস্তাবেও সাড়া দেয়নি মোদি সরকার। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার স্বপ্ন আর দুর্নীতি দমনের নিস্পৃহতা মিলিয়েই এই নিশ্চুপ প্রত্যাখ্যান। শুনলে অবাক হবেন, রাজনৈতিক দলগুলিকে কারা টাকা দিয়েছেন, তাঁদের নাম প্রকাশ করাটা ‘জনস্বার্থের বিষয় নয়’ বলে জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন। অথচ, এক সময়ে এই কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনই দেশের ছ’টি জাতীয় দলকে তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় এনেছিল। আজ গেরুয়া শিবিরের ভয়ঙ্কর চাউনির সামনে কার বলার সাহস রয়েছে, মোদি জমানায় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বাস্তব চিত্রটা তেলের ঊর্ধ্বগামী দামের চেয়েও আজ বেশি খোঁচা মারে।
আজ দেশের অর্থনীতি যত ডুবছে, তত ফুলে ফেঁপে উঠছে বিজেপির কোষাগার। নির্বাচনী বন্ডে চাঁদা তোলায় সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি। ২০১৯-২০ সালে বাকি সব দল মিলে যা আয় করেছে, একা বিজেপি-র আয় ছিল তার দ্বিগুণের বেশি। ৩,৬২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২,৫৫৫ কোটি টাকাই বিজেপি পেয়েছে ইলেক্টরাল বন্ড থেকে। শুধু তাই-ই নয়, গত লোকসভা নির্বাচনের সময়ে নির্বাচনী ট্রাস্টগুলিতে জমা হওয়া অনুদানের প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থই ঢুকেছে বিজেপির ঘরে। সদ্য প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে বিভিন্ন ট্রাস্ট থেকে নির্বাচনী অনুদান হিসেবে বিজেপি পেয়েছে মোট ২৭৬.৪৫ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে প্রুডেন্ট নির্বাচনী ট্রাস্টে ভারতী এয়ারটেল গ্রুপ এবং ডিএলএফ লিমিটেডের মতো বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার থেকে অনুদান হিসেবে জমা পড়েছিল ২৭১.৫ কোটি টাকা। তার মধ্যে বিজেপি-ই পেয়েছে ২১৭.৭৫ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায় ৮০ শতাংশ। এই টাকার অঙ্ক দেখে চমকাবেন না, এটা হিমশৈলের চূড়া মাত্র।
প্রশ্ন হল, বিজেপির কোষাগারে কোটি কোটি অর্থ ঢেলে শিল্পপতি,ব্যবসায়ীদের কী লাভ? 
অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস লিখেছিলেন, ব্যাঙ্কের যদি আপনার কাছে কয়েক হাজার টাকা পাওনা থাকে, তবে তা আপনার সমস্যা। কিন্তু ব্যাঙ্কের যদি আপনার কাছে কয়েক কোটি টাকা পাওনা থাকে, তবে তা ব্যাঙ্কের সমস্যা। আপনি যদি গাড়ি বা বাড়ির একটি ইএমআই না দিয়ে উঠতে পারেন, তবে ব্যাঙ্ক আপনার জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে। কিন্তু আপনি যদি ব্যাঙ্কের থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বেমালুম চেপে যান, তা হলে? ভিডিওকন গ্রুপের কথাই ধরুন। তাদের কাছে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের নাকি মোট বকেয়া ৬৪,৮৮৩ কোটি টাকা। ভারতের নতুন দেউলিয়া আইনের আওতায়, ভিডিওকন গ্রুপকে কিনে নিচ্ছে বেদান্ত গ্রুপের অধীন আর একটি সংস্থা, যারা ব্যাঙ্কগুলিকে মোট ২,৯৬২ কোটি টাকা দিচ্ছে। অর্থাৎ, ভিডিওকন ধার নিয়েছিল প্রায় ৬৫,০০০ কোটি টাকা, আর ব্যাঙ্কগুলি ফেরত পাচ্ছে মাত্র ২,৯৬২ কোটি। বাকি টাকা হাওয়া। সম্প্রতি ব্যাঙ্ক কর্মীদের সংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন’ ২,৪২৬টি সংস্থার তালিকা প্রকাশ করেছে। এই সংস্থাগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ১.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে শোধ করেনি। ২,৪২৬টি সংস্থার মধ্যে ৩৩টি সংস্থার বকেয়া ঋণের পরিমাণ মাথা পিছু ৫০০ কোটি টাকার বেশি। এই ৩৩টি সংস্থার কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির মোট অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ৩২,৭৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মেহুল চোকসির গীতাঞ্জলি জেমস (৪,৬৪৪ কোটি টাকা), গিলি ইন্ডিয়া (১,৪৭৭ কোটি টাকা), উইনসাম ডায়মন্ডস (২,৯১৮ কোটি টাকা), নক্ষত্র ব্র্যান্ডস (১,১০৯ কোটি টাকা) রয়েছে। অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ সবথেকে বেশি, ৪৩,৮৮৭ কোটি টাকা রয়েছে স্টেট ব্যাঙ্কের খাতায়। কেউ জানে না, এইসব সংস্থাকে গেরুয়া শিবিরের কোষাগারে কত টাকা দিতে হয়েছে। সেই জানার অধিকারের দরজায় তালা দিয়ে গিয়েছেন প্রয়াত অরুণ জেটলি। অভিযোগ, ঋণখেলাপি ধনকুবেররা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা গেরুয়া শিবিরের কোষাগারে ঢুকিয়ে দায় মুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। এটাই ইলেক্টরাল বন্ডের খেলা...।
গেরুয়া শিবির জানে, ভক্তির সামনে যুক্তি টেকে না, যুক্তি দিয়ে ভক্তি খণ্ডনও করা যায় না। অতএব, ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ দেশ যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়েও তাঁর মনের কথা শুনে বিগলিত হয়। ‘নমো নমো’ ধ্বনিতে গোপন রয়ে যায় আসল চেহারা। কেউ বলার সাহস পায় না, কংগ্রেসের দুর্নীতির সঙ্গে বিজেপির দুর্নীতির তফাৎ একটাই: কংগ্রেস দুর্নীতি করে আইন ভেঙে, আর বিজেপি দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিতে আইনটাকেই বদলে নেয়।
এটাই মোদির নয়া ভারত। যেখানে দুর্নীতির দুর্বিপাকে ঘুরে মরাই দেশবাসী নিজেদের ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছেন!

18th     August,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ