বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

শঠতার কারাগার থেকে রাজনীতির মুক্তি
হারাধন চৌধুরী

স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ করল ভারত। শতবর্ষ পূর্তি ২০৪৭-এ। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বপ্ন তার ভিতরে পূরণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতিকে পাঁচটি অঙ্গীকার সামনে রেখে এগনোর আহ্বান জানিয়েছেন। প্রথম, উন্নত ভারত নির্মাণ। দ্বিতীয়, ঔপনিবেশিক মানসিকতার সমস্ত লক্ষণ বিমোচন। তৃতীয়, আমাদের অতীত ঐতিহ্যের প্রতি গর্ববোধ। চতুর্থ, ঐক্য। পঞ্চম, নাগরিকদের মধ্যে কর্তব্যবোধ। গতকাল ৭৬তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লালকেল্লায় প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এগুলিকে অমৃতকালের পঞ্চ প্রাণ নামে অভিহিত করেছেন। দুর্নীতিমুক্ত ভারত নির্মাণেরও ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর এই স্বপ্ন, আহ্বান ও ঘোষণা অর্থহীন। ভারত খাতাকলমেই বৃহত্তম গণতন্ত্র। বাস্তবে স্বৈরতন্ত্রের মধ্যেও অতি নিকৃষ্ট, যেখানে স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা ভীষণ ক্লান্ত হাতে নতুন সংজ্ঞা হাতড়াচ্ছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের মডেল গ্রহণ করেছে ভারত। তার ভিত্তিভূমি হল বহুদলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ নির্বাচন। নির্বাচন ব্যবস্থার মধ্যে সযত্নে রক্ষিত ত্রুটিবিচ্যুতিই এই স্বপ্নভঙ্গের জন্য দায়ী। তাই সবচেয়ে জরুরি হল নির্বাচন সংস্কার, যা প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা ও বদলে জনগণের মতামতের পূর্ণ প্রতিফলনের গ্যারান্টি দেবে, যোগ্য প্রতিটি ব্যক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ভোটদানের অধিকার যেখানে অবাধ। প্রতিদ্বন্দ্বীরা দলীয় সদস্য অথবা দলনিরপেক্ষ যে কেউ হতে পারেন। নির্বাচনে কারচুপি বা অপশক্তির প্রয়োগের দায় বর্তাবে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির উপর। নির্বাচন ব্যবস্থা বানচাল, এমনকী কলুষিত করার ঘটনায় দোষী রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। প্রয়োজনে, দোষীদের নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে বহু যোজন দূরে নিক্ষেপের মতোই কঠোর হতে হবে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রতিনিধিদের (বিধায়ক/সাংসদ) সমর্থনে গঠিত সরকারকেই পূর্ণ মেয়াদে প্রশাসন পরিচালনার সুযোগ দেওয়া চাই। প্রত্যাখ্যাত বা পরাজিত কোনও শক্তির তস্করসুলভ কৌশলে ক্ষমতার অলিন্দে অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়া জরুরি। তার জন্য জনপ্রতিনিধিদের দলবদলের অধিকার পুরোপুরি কেড়ে নেওয়াই কর্তব্য। অনেক নীতিকথা, ধর্মকথা গণতন্ত্রের মন্দিরগুলি থেকে উচ্চারিত হয়েছে। ৭৫ বছরের অভিজ্ঞতা বলে, তার সবটাই নিষ্ফলা। কারণ এই ভারত নিজেদের ভালো বোঝার মতো সাবালক মোটেই নয়।
যত গলদ গোড়ায়। এটাই আগে সাফ করা দরকার। ফাঁকফোকরহীন আইনের মাধ্যমে অবিবেচক রাজনীতির কারবারিদের বাধ্য করা ছাড়া উপায় কী! প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগে এই শর্ত দেওয়া প্রয়োজন যে, জয়ের পর কোনওভাবেই একজন বিধায়ক/সাংসদ দল বদল করতে পারবেন না। কোন দলে থেকে ‘জনসেবা’ করার বা ‘উন্নয়নের সাথী’ হওয়ার সুযোগ সর্বাধিক সেটা মনোনয়নপত্র পেশের আগেই ঠিক করতে হবে। জেতার পর ‘দমবন্ধ করা পরিবেশ’ আবিষ্কার করে লাভ নেই। প্রয়োজনে রাজনৈতিক সন্ন্যাসও নিন, তবে দলবদলের আবদার নৈব নৈব চ। আর হ্যাঁ, মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে রাজনৈতিক সন্ন্যাস নিলে ন্যায্য অর্থমূল্যও চুকিয়ে যেতে হবে। ব্যাপারটা কীরকম? অবশ্যম্ভাবী উপনির্বাচনের দরুন অর্থদণ্ড সরকারি কোষাগারের উপর বর্তাবে না। যাঁর অবাঞ্ছিত ইচ্ছায় এই কাণ্ডটি ঘটবে তাঁকেই এই ব্যয়ভারের পুরোটা বহন করতে হবে। প্রয়োজনে তাঁর সহায়-সম্পদ ক্রোক করার সংস্থান রাখতে হবে নির্বাচন আইনে।
একটি নির্বাচনে একজন ব্যক্তির একাধিক কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ থাকা অনুচিত। একজন একাধিক কেন্দ্রে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে প্রথমেই আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি প্রকট করে দেন না কি? তিনি দুটি কেন্দ্রে বিজয়ী হলে সমস্যা আরও বেশি। ভারতীয় সংবিধান ও আইনের চোখে সবার অধিকার সমান। অনেকেই যদি এই ব্যাধিতে সংক্রামিত হতে থাকেন, তার ঠেলা সামলানো আরও কঠিন হবে না কি? কোনও কোনও নেতা সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে দলের হয়ে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করেন। তাঁর দল বা জোট নির্বাচনে গরিষ্ঠতা অর্জনের পর তিনি গিয়ে বসে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে। পরে তাঁরই কোনও অনুগামী জনপ্রিয় বিধায়ক বা সাংসদের ‘আত্মত্যাগের’ সুযোগে উপনির্বাচনে প্রার্থী হন সেই সর্বোচ্চ নেতাটি। কোনও জনপ্রতিনিধির আকস্মিক মৃত্যুর কারণে উপনির্বাচনের ব্যয়ভার এই গরিব দেশের জনগণের উপর চেপে গেলে একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এর কোনও ব্যাখ্যা সত্যিই থাকে না। একটি দল বা একজন নেতার ব্যক্তিগত অভিলাষ পূরণের দায় করদাতারা নেবেন কেন?
এ গেল আর্থিক দিক। ভোটারদের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ নস্যাৎ করার অধিকার কোনও প্রার্থী কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির নেই। ধরা যাক, আমি ‘ক’ প্রতীকে ভোট দিয়েছি। আমার পছন্দের প্রার্থী এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু আমার পছন্দের দল সরকার গড়ার গরিষ্ঠতা পায়নি। বুঝতে হবে যে, মানুষ চেয়েছে আমার পছন্দের এমপি ও দল বিরোধী আসনে বসবে। জনতার এই রায়ের প্রতি আমার এবং দল ও এমপির বিশেষ শ্রদ্ধা থাকা উচিত।
কিন্তু একদিন শোনা গেল যে, আমার এমপি মন্ত্রী হওয়ার বাসনায় কিংবা অন্যকোনও প্রলোভনে পড়ে শাসক দল/জোটের কাছে গোপনে দাসখত লিখে দিয়েছেন! শাসক দলের ‘খ’ প্রতীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ আমারও ছিল। কিন্তু আমার বিচারে তারা জনবিরোধী রাজনীতির কারবারি। তাই আমি তাদের আগেভাগেই প্রত্যাখ্যান করেছি। হায়, আমার ভোটে জয়ী একজন সেই দিকেই ভিড়ে গেলেন! তিনি তো আমার বা অন্য সমর্থকদের মতামত নেননি। এই ধ্যাষ্টামো আমরা বরদাস্ত করব কেন?
ওই এমপি এটা মনে রাখলেন না যে, তাঁকে জেতানোর জন্য কত মানুষ দিনের পর দিন মিটিং-মিছিল করেছেন, তর্ক-বিতর্কে অংশ নিয়ে কতজনের বিরাগভাজন হয়েছেন, ‘খ’ প্রতীকের সমর্থক ও গুন্ডাদের সঙ্গে লড়াই করেছেন, হয়তো প্রাণও দিয়েছেন একাধিক নিরপরাধ ব্যক্তি! তাঁরা ভুলে যান, এমন রাজনীতির জন্য কত মেধার অপমৃত্যু হয়, কত সংসার জলাঞ্জলি যায়। একটি দিনের রোজগার শিকেয় তুলে ভোটের লাইনে দাঁড়ানোর ব্যাপারটাকে না-হয় ছেড়েই দেওয়া গেল। এরপরও প্রশ্ন ওঠে, এই বিশ্বাসঘাতকতা, গদ্দারির জন্য কোনও শাস্তিই যথেষ্ট কি?
সামান্য সাফাই কর্মী কিংবা চতুর্থ শ্রেণির কর্মী পদে চাকরি পেতেও একজনকে নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত পূরণ করতে হয়, মানতে হয় বয়সসীমা, যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এরপর থাকে পুলিস ও মেডিক্যাল ভেরিফিকেশনের কঠিন ধাপ। যেখানে নাগরিকের জন্য এমন কঠিন কঠোর আইন প্রণীত হয়েছে, সেই আইনসভা আইনপ্রণেতাদের ছাড় দিয়ে রেখেছে বহু ক্ষেত্রে। অন্তত এমএলএ/এমপি হওয়ার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়সসীমা, পুলিস/মেডিক্যাল ভেরিফিকেশনের কোনও হ্যাপাই রাখা হয়নি! এসব শুধু তাঁদেরই জন্য, যাঁদের ভোটে ও টাকায় তাঁরা নির্বাচন উৎসব পালন করেন এবং শাঁসেজলে একটা আস্ত জীবন পার করে দেন এবং অনেকেই পরবর্তী কয়েক প্রজন্মের জন্য সুবন্দোবস্ত করে যান। রাজনীতির অর্থায়ন ও দুর্বৃত্তায়ন এই সকল অনাচারের সঙ্গে সুসম্পৃক্ত। প্রকৃত নির্বাচন সংস্কার যদি কখনও হয়, আইনসভা ও নির্বাচন কমিশন কি এসব বিবেচনায় রাখবে?
উপর্যুক্ত প্রশ্নগুলিতে সবার আগে রাজি থাকতে হবে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে এবং তাঁর পার্টিকে। কারণ গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলুষিত করার প্রশ্নে আজকের ভারত বিজেপিকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করে। নির্বাচন সংস্কার প্রস্তাবের উপর দেশজুড়ে বিতর্ক হোক। অংশ নেবেন ছাত্র যুব বেকার চাকরিজীবী কৃষক শ্রমিক অর্থনীতিবিদ সাংবাদিক শিক্ষক গবেষক বিশেষজ্ঞ সমাজকর্মী পরিবেশকর্মী ক্রীড়াবিদ ডাক্তার আইনজীবী ব্যবসায়ী রাজনীতিক অন্য পেশাজীবী শিল্পী উদ্বাস্তু এনআরআই নাস্তিক আস্তিক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ প্রভৃতি সমস্ত শ্রেণি। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বপ্নপূরণ সেদিনই সম্ভব হবে যেদিন শঠতার কারাগার থেকে মুক্তি ঘটবে ভারতীয় রাজনীতির। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বাধীনতাই দেশকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পথ দেখাবে। নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দল বা একজনমাত্র রাজনীতিকের পক্ষে এই হিমালয়তুল্য ভার সরানো সম্ভব হবে না। দায়িত্ব গোটা জাতির—প্রকৃত শিক্ষাপ্রাপ্ত, নির্বোধ ভক্তিভাবে আচ্ছন্ন নয়, সকলের কল্যাণের ভিতরে নিজের মঙ্গলের সমস্ত লক্ষণ প্রত্যক্ষ করে।

17th     August,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ