বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

এই ভারত কতটা সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক? 
পি চিদম্বরম

ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক এই শব্দ তিনটি পাঠকরা স্মরণ করবেন। একটি আধুনিক সাধারণতন্ত্রের সংজ্ঞা এই গুণাবলির ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। এমন একটি সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়েছিল।
আজ জাতি স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপন করছে। আমি নিশ্চিত যে শততম বার্ষিকী এবং আরও অনেক বার্ষিকী উদযাপন করতে জাতি বেঁচে থাকবে। তবে আমি ভীতিবিহ্বল হয়ে এই প্রশ্ন রাখছি যে, আমাদের সাধারণতন্ত্র কি ২০৪৭ সালেও সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক থাকবে?
সার্বভৌমত্ব কোথায় যাচ্ছে?
শত শত বছর ধরে, ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল সার্বভৌম ছিল শুধুমাত্র এই অর্থে যে সেগুলি বিদেশি রাজা ও রানিরা শাসন করতেন না। রাষ্ট্র ‘সার্বভৌম’ থাকলেও জনগণ তা ছিল না। অনেক শাসক ছিলেন স্বৈরাচারী ও অযোগ্য। জনগণের জীবনমানের উন্নতির জন্য বিশেষ কিছুই করেননি তাঁরা।
একটি সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের অধীনে, কেবল রাষ্ট্রই সার্বভৌম নয়, সার্বভৌম তার জনগণও। শাসক পরিবর্তনের ক্ষমতাটি সার্বভৌম জনগণের বৈশিষ্ট্য। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন জনগণের সার্বভৌম অধিকার। যাই হোক, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, জনগণের এই অধিকার মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। মনে হয়, ইদানীন্তন নির্বাচনের বেশিরভাগেরই ফয়সালা অর্থবলের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। এবং, বিজেপি হল 
সেই দল যাদের কাছে সবচেয়ে বেশি টাকা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, রাজনৈতিক দলগুলির জন্য যে দান সংগৃহীত হয় তার প্রায় ৯৫ শতাংশ কুক্ষিগত 
হওয়ার মতো একটি ধুরন্ধর এবং গোলমেলে কল (ইলেক্টোরাল বন্ড) আবিষ্কার করেছে বিজেপি সরকার। ভোটে জেতার জন্য বিজেপির কাছে 
অন্যান্য হাতিয়ারও রয়েছে: বশংবদ মিডিয়া, তাঁবে এনে ফেলা সংস্থাগুলি, অস্ত্র করে তোলা আইনগুলি এবং পক্ষভুক্ত করে ফেলা এজেন্সিগুলি। আরও 
একটি বিষয় এই যে, বিজেপি কোনও নির্বাচনে হেরেও দমে যায় না। তখন তারা তাদের চূড়ান্ত অস্ত্র ‘অপারেশন লোটাস’ প্রয়োগ করে। ইতিমধ্যেই এই অস্ত্র তারা নির্লজ্জভাবেই প্রয়োগ করেছে গোয়া, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়, কর্ণাটক ও মধ্যপ্রদেশে। রাজস্থানেও অপারেশন লোটাস ব্যবহারের অপচেষ্টা হয়েছিল।
অবাধ বা সুষ্ঠু নির্বাচন বন্ধ হওয়ার মতো এমন এক পর্যায়ে কি আমরা পৌঁছব? আমি আন্তরিকভাবে তেমনটা আশা করি না। তবে বিপদটিকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’ বুলেটের তাক শুধু কংগ্রেস নয়। ‘কেবলমাত্র বিজেপিকেই জাতীয় দল হিসেবে রেখে ছোট দলগুলি বিলুপ্ত হয়ে যাবে’—জে পি নাড্ডার সাম্প্রতিক এই বিবৃতি চেনা রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর মাত্র নয়, আরও বেশি। এটি এমন একটি ‘আইডিয়া’ যেটি বিজেপির নার্সারিতে যত্নসহকারে লালন-পালন করা হয়।
জনগণ এক ঝলকায় তাদের সার্বভৌমত্ব হারাবে না। এটা স্লো পয়জন ছড়ানোর মতো কাজ করবে। ভাঙনটা শুরু হবে বঞ্চনার মধ্য দিয়ে। একটু একটু করে। কোন কোন বিষয়ে? ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, লেখালিখির স্বাধীনতা, ভিন্নমতের অধিকার, প্রতিবাদের অধিকার, গোপনীয়তা, ভ্রমণের স্বাধীনতা এবং শেষাবধি নির্ভয় থাকার স্বাধীনতা। নিজেকে প্রশ্ন করুন, ভারত কোন দিকে যাচ্ছে?
ধর্মনিরপেক্ষতার ভবিষ্যৎ কী?
ভারত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল দেশ হবে এবং জনসংখ্যা পৌঁছে যাবে ১৬০ কোটিতে। উর্বরতার হার যেহেতু সবার মধ্যেই একরকম, তাই জনসংখ্যার ধর্মভিত্তিক অনুপাতের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন কিছু হবে না। বর্তমান অনুপাতটি এইরকম: হিন্দু ৭৮.৪ শতাংশ, মুসলিম ১৪.৪ শতাংশ, খ্রিস্টান ২.২ শতাংশ, শিখ ১.৭ শতাংশ এবং অন্যান্য ৩.৩ শতাংশ। দু’হাজার বছর ধরে ভারত একটি বহুত্ববাদী দেশ ছিল। ভারত আজও একটি বহুত্ববাদী দেশ। কিন্তু আমাদের বহুত্ববাদকে নস্যাৎ করার জন্য আমরা বাড়াবাড়ি রকমের আচরণ করছি বলে মনে হচ্ছে। অন্যদিকে, অন্যদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড তাদের বহুত্ববাদী সমাজের প্রভূত সুবিধাগুলির কথা গর্বভরে স্বীকার করে। আদালত, মিডিয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের উচ্চতায় অবস্থান করেই সক্রিয়ভাবে বৈচিত্র্যের সন্ধান এবং প্রোমোট করে। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে মুসলিম এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে একজন করে সম্মানিত বিচারক রয়েছেন এবং শিখদের তরফে কেউ নেই। বর্তমান পদাধিকারীরা অবসর গ্রহণ করার আগে নতুনভাবে একজন মুসলিম বা খ্রিস্টান বিচারক নিয়োগ নাও হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নিজেকে প্রশ্ন করুন, ভারত ধর্মনিরপেক্ষ ছাড়া আর কিছু হতে পারে কি? মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বাদ দিলে আমাদের সঙ্গীত, সাহিত্য, সিনেমা, খেলাধুলো, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, আইন, শিক্ষকতা এবং নাগরিক পরিষেবার মান আরও নেমে যাবে। বিজেপি এবং আরএসএসের নেতারাই ধর্মনিরপেক্ষতার বদনাম করেছেন। তাঁরা এটিকে অভিহিত করেছেন ‘তোষণ’ নামে। এটাই জম্মু ও কাশ্মীর, নির্বাচনী প্রতিনিধিত্ব, সংরক্ষণ, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক এবং ব্যক্তিগত আইন সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিকে 
বিকৃত করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার মৃত্যু এবং একটি হিন্দু ‘রাষ্ট্র’ (জাতি) ঘোষণা ভারতের ধারণার পক্ষে একটি বিরাট আঘাত হয়ে উঠবে। তাতে 
গণতন্ত্রের মৃত্যুও ত্বরান্বিত হতে পারে। বেশিরভাগ ভারতীয় এই পরিণতি চায় না। কিন্তু বিজেপি সমর্থকদের অধিকাংশই হিন্দু ‘রাষ্ট্র’ চায় বলে মনে হয়। যখন একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তি (হিন্দুত্ব বিশ্বাসীরা) একটি অনড় শ্রেণির (মধ্যপন্থী এবং সহনশীল ভারতীয়দের) সঙ্গে মিলিত হয়, আমি জানি না, বিজয়ী হবে কোনটি।
গণতন্ত্র কোন পথে?
গণতন্ত্র মানে প্রতি পাঁচবছরে একবার করে ভোটদান নয়। নিত্যদিন কথোপকথন, আলোচনা, বিতর্ক ও ভিন্নমত প্রকাশের মাধ্যমে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। সেই মানদণ্ড অনুসারে, ভারতে গণতন্ত্রের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছে। প্রতিবছর কম দিনই সংসদ ও বিধানসভার অধিবেশন চলে। সুইডেন-ভিত্তিক ভি-ডেম ইনস্টিটিউট ভারতকে একটি ‘নির্বাচনী স্বৈরাচার’ বলে অভিহিত করেছে। গণতন্ত্র সূচক ২০২১-এ ভারতের র‌্যাঙ্কও তারা নামিয়ে এনেছে ৫৩-তে। রাজ্যভিত্তিক প্রতিটি দল নিজ রাজ্যে তার জায়গা ঠিক রাখার জন্য লড়াই করে, কিন্তু অন্য রাজ্য দলগুলিকে সুরক্ষার প্রদানে সাহায্য করতে কিংবা বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের শামিল হতে নারাজ হয়। দুঃস্বপ্নের মতো মনে হলেও, ওয়ান-পার্টি সিস্টেম বা একদলীয় ব্যবস্থার উত্থানকে উড়িয়ে দিতে পারি না (যেমন জে পি নাড্ডা মনেপ্রাণে চান) আমরা। তাঁর দল দাবি করবে যে, আমাদের এটি একটি গণতন্ত্র, তবে ভারতীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ!
আজ আপনি যখন তেরঙাকে অভিবাদন জানাবেন, অবশ্যই দুটি জিনিস মনে রাখবেন—এর ডিজাইনার পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়াকে এবং বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সেই ত্রিবর্ণকে—যেটি সার্বভৌমত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করে।
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত

15th     August,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ