বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

স্বাধীনতার মহোৎসব ও মানুষের প্রাপ্তি
হিমাংশু সিংহ

কাল সোমবার স্বাধীনতার ৭৫ বছর। দেশকে তেরঙ্গায় মুড়ে ফেলার বর্ণময় আয়োজন সম্পূর্ণ। ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসবে’র ঢক্কা নিনাদ শোনা যাচ্ছে সর্বত্র। জাতীয়তাবোধে প্রতিটি নাগরিক থেকে ইট কাঠ পাথর নেতা-নেত্রী সবাই উজ্জীবিত। সাড়ে সাত দশক যে কোনও রাষ্ট্রের জীবনেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। কিন্তু একইসঙ্গে এই অভিযাত্রা প্রশ্নও তুলছে বিস্তর। শুধু পতাকার পবিত্র রঙে ঘরবাড়ি সৌধকে সাজিয়ে তুলেই কি দায়িত্ব শেষ? আমাদের সংবিধান প্রণেতারা যে দুর্নীতিমুক্ত, সব সম্প্রদায় ও বিশ্বাসের মানুষের আস্থা জিতে মিলনতীর্থ ভারতবর্ষ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা কি বাস্তবায়িত হচ্ছে? নাকি আইনকে, জাতীয়তাবোধকে শিখণ্ডী করে আখেরে প্রতিটি দল ও সংগঠন নিজের নিজের ঢাক বাজাতেই ব্যস্ত। চারদিকে শুধু বিভাজনের বিষ ছোবল। যাঁরা জীবন বিপন্ন করে একদিন দেশ স্বাধীন করেছিলেন, অনাহারে অর্ধাহারে ছুটে বেরিয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা কী বলবেন এই পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি দেখে? এক সাধারণ মন্ত্রীর বান্ধবীর বাড়ি থেকে দু’দফায় ৫০ কোটিরও বেশি নগদ, বিপুল সম্পত্তির দলিল ও কেজি কেজি সোনা উদ্ধার নিঃসন্দেহে তাঁদের হতবাক করবে। এ নাকি চাকরি বিক্রির টাকা! কয়লা পাচার, গোরু পাচারের হিস্যা! হায় বঙ্গভূমি, এই মাটিতেই নেতাজি সুভাষ, চিত্তরঞ্জন দাশ, রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন। হাসতে হাসতে প্রাণ দিয়েছিলেন বিনয়-বাদল-দীনেশ। ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য সম্পত্তি বিসর্জন দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশের মুক্তির জন্য। সেই দেশেই ৭৫ বছর পর আজ গোরু পারাপার করে শত শত কোটি টাকার সম্পত্তি বানানোর অভিযোগে এক সামান্য শাসকদলের জেলা সভাপতিকে গ্রেপ্তার করতে হয়। সর্বক্ষেত্রে বালি থেকে পাথর, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে সাধারণের প্রাণ ওষ্ঠাগত। একটা বাড়ির ভিত খুঁড়তেও দাদাদের মোটা নজরানা দিতে হয়। তাঁদের পাঠানো লোকের কাছ থেকে বালি, সিমেন্ট কিনতে হয়। এই তোলাবাজি ও দুর্নীতির শিকড় কতদূর বিস্তৃত কে জানে?
কিন্তু বাংলাকেই শুধু আলাদা করে দেখলে তো হবে না। দুর্নীতি ও ক্ষমতার ভণ্ডামি শুধু বাংলার ভৌগোলিক সীমানাতেই আবদ্ধ নেই। তা আজ ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যে রাজ্যে, আসমুদ্রহিমাচল। পুলিস ও প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এমনকী বিচার বিভাগের অন্দরেও। অদৃশ্য সুতোর টানে মহামান্য আদালতের রায় পর্যন্ত বদলে যাচ্ছে আজকাল। রাতারাতি নির্বাচিত সরকার পড়ে যাচ্ছে নগদ টাকার হাত বিনিময়ে। পশুপাখি গৃহপালিত জীবজন্তুর মতো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেনাবেচার হাটও বসছে নিয়ম করে। বোফর্স থেকে কফিন কেলেঙ্কারি, সাড়ে সাত দশকে রঙ্গ বড় কম দেখেনি জনগণ। বিজেপির এক সর্বভারতীয় সভাপতি ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়েছেন হাতেনাতে। কিন্তু এই দুর্নীতির সঙ্গেই উদ্বেগজনক হচ্ছে বেছে বেছে বিরোধী রাজ্যে সিবিআই, ইডির অতি সক্রিয়তা। একদা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুখরামের বাড়ি থেকেও  ঘুষের টাকা উদ্ধার হতে ঘুম ছুটে গিয়েছিল দেশবাসীর। এই অবৈধ লেনদেন বন্ধ করতেই ঘটা করে বর্তমান নরেন্দ্র মোদি সরকার কালো টাকা রুখতে নোটবন্দি করে লম্বা চওড়া ভাষণ দিয়েছিল। কিন্তু মানুষের অশেষ দুর্গতি আর সরকারের বিপুল নোট ছাপানোর খরচ ছাড়া গোটা প্রক্রিয়াটাই ছিল আখেরে অশ্বডিম্ব। অবৈধ টাকার দাপট একটুও কমেনি। বিপুল খরচে ছাপানো দু’হাজার টাকার নতুন নোটও বাজার থেকে গায়েব। আর জিএসটি ৩০ সপ্তাহের মাথায় ভূমিষ্ঠ হওয়া অপরিণত শিশু। রোগব্যাধি লেগেই আছে। দুই পরীক্ষাতেই বিজেপি সরকার ডাহা ফেল! স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও সেই কালো টাকার হাটেই নির্ধারিত হচ্ছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের ভাগ্য। জনপ্রতিনিধিদের দাম। ডান বাম সবাই এই খেলায় ওস্তাদ। 
মহারাষ্ট্রে বিজেপি আর শিবসেনা একসঙ্গে মিলে ভোটে লড়েছিল। কিন্তু ভোটের ফল বেরনোর পর বিজেপিকে দূরে ফেলে বিপরীত মেরুর দুই রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গড়েন শিবসেনা প্রধান উদ্ধব থ্যাকারে। পরিণতি দু’বছর পর তাঁর দলটাই ভেঙে চৌচির। নীতি-আদর্শ নয়, সেখানেও নিয়ন্ত্রক সেই টাকা আর মন্ত্রিত্বের টোপ! সিংহভাগ বিধায়ক গেরুয়া শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে আবার ক্ষমতা দখলের নেশায় একটা নীতিহীন সরকার উপহার দিলেন। এক মাস পেরিয়ে গেলেও মন্ত্রিসভা নিয়েই দড়ি টানাটানির শেষ নেই। সবাই মন্ত্রী হতে চান, পয়সা কামাতে চান, কিন্তু দেশের কাজ করতে চান না। তাহলে কী দাঁড়াল ৭৫ বছরের এই অভিযাত্রায়? নীতি, আদর্শ, দেশসেবা নয়, যেনতেন ক্ষমতাদখল আর লাফিয়ে সম্পত্তি বৃদ্ধিই প্রধান বিবেচ্য। পিছনে পড়ে থাকে স্বাধীনতা, উন্নয়ন, মূল্যবোধের রাজনীতি আর ক্লিশে হয়ে যাওয়া কিছু উচ্ছিষ্ট ফাঁকা বুলি! এসবই গরিবকে আরও পাঁচ বছরের জন্য ধোঁকা দেওয়ার চমৎকার পুরিয়া। বিহারের নাটক আরও করুণ। বছর বছর মুখ্যমন্ত্রী একজনই থাকেন, শুধু বদলে যায় সহযোগী। একবার পাশে গেরুয়া তো পরক্ষণেই লালুর লণ্ঠন। সেই নিভু নিভু আলোতেই নীতীশ কুমার পথ চলেন বেমালুম। আয়ারাম গয়ারাম সরকার আর গোরুর মতো যে হাটে জনপ্রতিনিধি কেনাবেচা হয় রাতের নিশুতি আলোয়, সেখানে বড় বড় কথা কি আর সাজে? অচিরেই ভেঙে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। আর এসব নীরবে সহ্য করাই আজকের দস্তুর। ‘দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়েছি’... এটুকু বলার মতো সাহসী প্রতিবাদী মুখের সন্ধান মেলা বড় মুশকিল।
অর্থনীতির কী অবস্থা সবাই দেখছে? টাকার তুলনায় ডলারের দাম বাড়তে বাড়তে আজ ৮০ টাকার আশপাশে ঘুরছে। স্বাধীনতার সময় ছিল ৪ টাকার কিছু বেশি। আট বছর আগে ডলারের দাম ছিল ৬২ টাকা। টাকা দুর্বল হয়েছে, আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য মার খেলে দেশ এগিয়েছে কি বলা সাজে? ১৯৪৭ সালে এক লিটার পেট্রলের দাম ছিল ২৭ পয়সা। মোদিজি ক্ষমতায় আসার বছরে পেট্রলের দাম ছিল ৭৯ টাকা। আর আজ সগৌরবে একশো টাকা অতিক্রান্ত। এমনিতেই বিশ্বজোড়া মহামারীর আঘাতে মানুষ রোজগার হারিয়ে বেসামাল, তার উপর জিনিসের দামে লাগাম পরাতে সরকার ব্যর্থ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাতেও দাওয়াই শেষ। সুদ কমানো বাড়ানোর পুরনো অ্যান্টিবায়োটিকে আর কাজ হয় না। অতি ব্যবহারে রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গিয়েছে। তাহলে উপায়?
উপায় একটাই ধর্মের আফিমে গরিব মানুষকে বুঁদ করে দাও। বছরে দু’কোটি চাকরি, অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা—সবই মিথ্যে স্তোকবাক্য! ঝাঁ চকচকে বিদেশি পাথরে মোড়া মন্দির বানাও। বিগ্রহ সাজাও। উস্কানি দিয়ে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সংঘাত লাগিয়ে দাও। এর নামই নাকি মেরুকরণের তাস খেলা। ব্যাপারটা আদিম হলেও এটাই ভোটে জেতার আধুনিকতম স্টেরয়েড। মন্ত্রের মতো কাজ করবে। শিক্ষা, খাদ্য, বাসস্থান, চাকরির দাবিতে আর সেভাবে সোচ্চার হওয়ার কথা ভুলেই যাবে জনগণ। ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের আবর্তেই যে ধুরন্ধর শাসকের গদি দখলের স্বর্গসুখ তা আমরা বুঝব কবে?
কিন্তু বড্ড গোল বাঁধে যখন দেখি, একদিন যাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনে সেভাবে অংশই নেয়নি, উল্টে বিরোধিতা করেছে, নেতাজিকে পদে পদে অপদস্থ করার চেষ্টা করেছে, মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারীকে মদত জুগিয়েছে, পুজো করেছে, তাঁরাই এখন সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা সংগ্রামীর মর্যাদা পাচ্ছে। এ জিনিস মোটেও সমর্থন করা যায় না। কংগ্রেসকে মুছে দিতে নরেন্দ্র মোদি সফল হবেন কি না, তা সময় বলবে। কিন্তু সাভারকর, হেডগেওয়াররা স্বাধীনতা সংগ্রামীর পুজো পাবেন আর নেহরুর ভাগ্যে জুটবে শুধু ঘৃণা, এটাও দেশের মানুষ বেশিদিন সহ্য করবেন বলে মনে হয় না। এই ৭৫ বছরের অভিযাত্রায় দেশের মানুষ যেমন বিরাট সময়জুড়ে একটি পরিবারের শাসনে অতিষ্ঠ, তেমনি আদবানি-বাজপেয়ির দলও ক্ষমতা প্রসারের নেশায় যেভাবে আজ একজন ব্যক্তিরই মুখাপেক্ষী হয়ে গিয়েছে, তাও খুব উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে না। যে কোনও গণতান্ত্রিক দল ও সংগঠনের পক্ষে এই বিবর্তন আখেরে আশীর্বাদ না অভিশাপ, তাও অচিরেই বোঝা যাবে। অতিমাত্রায় ভাষণ ও নিজেকে জাহির করার মানসিকতাও দেশের পক্ষে মোটেই স্বস্তিদায়ক হতে পারে না। নতুন সংসদ ভবন, নবরূপে রাজধানীকে সাজানোর আড়ালে দেশের ইতিহাস আর একবার ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলে মানুষ রুখবেই। আজকের ক্ষমতাবানরা যেন মনে রাখেন ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। আজ পঁচাত্তরে যাঁরা মধ্যগগনে, আরও ২৫ বছর পর স্বাধীনতার শতবর্ষে তাঁরাও কিন্তু অতীতের আস্তাকুঁড়েই হারিয়ে যাবেন। জনতার আদালতে বেশিদিন একচ্ছত্র ক্ষমতার আস্ফালন চলে না। 

14th     August,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ