বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

বিহারে পালাবদলে
আসল নায়ক তেজস্বীই
তন্ময় মল্লিক

এই নিয়ে আট আটবার মুখ্যমন্ত্রিত্বের কুর্সিতে। তারজন্য কখনও কংগ্রেসের, কখনও আরজেডির, কখনও আবার বিজেপির কাঁধে ভর করেছেন। গদির জন্য নীতি বিসর্জন দিয়েছেন বারবার। ডিগবাজি পলিটিক্সে তাঁর সমগোত্রীয় বলতে একমাত্র মুলায়ম সিং যাদব। গদির জন্য রাতারাতি সঙ্গী বদলালে সমালোচিত হতে হয়। সেটাই প্রথা। কিন্তু এবার ডিগবাজি খেয়েও নীতীশ কুমার তিরস্কৃত হচ্ছেন না। উল্টে পাচ্ছেন আম জনতার প্রশংসা। কারণ অহঙ্কারী, দাম্ভিক বিজেপির চোখরাঙানি তিনি উপেক্ষা করেছেন। ‘দাদা’র উপর করেছেন দাদাগিরি। তাই একটা রাজ্যের তিন নম্বর দলের নেতা হয়েও বিরোধী শিবিরের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর লিস্টে নাম তুলে ফেলেছেন। তবে, এতে নীতীশের প্রতি আবেগ অপেক্ষা প্রকট হয়েছে বিরোধী শিবিরের নেতৃত্বের সঙ্কট। জনপ্রিয়তার তলানিতে পৌঁছেও ক্ষয়রোগে আক্রান্ত এনডিএ শিবিরের এটাই একমাত্র স্বস্তির কারণ।
কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, তারপর মহারাষ্ট্র। প্রতিটি রাজ্যেই গেরুয়া শিবিরের ‘অপারেশন লোটাস’ বাস্তবায়িত হয়েছে। বিরোধীদের হাতে থাকা একের পর এক রাজ্য কব্জা করায় বিজেপি হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। তাতে ২০২৪ সালে ক্ষমতায় ফেরার ব্যাপারে গেরুয়া শিবির হয়ে যায় একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী। তাই গলগল করে উগরে দিয়েছিল পরবর্তী টার্গেটের তালিকা। উত্তরাখণ্ড, ঝাড়খণ্ড, বাংলা। তবে ‘পালাবদলে’র সেই তালিকায় ছিল না বিহার। কিন্তু নীতীশ কুমারের সৌজন্যে বিহার এখন সেই তালিকার একেবারে মগডালে। 
নীতীশ কুমারের রাতারাতি ভোল বদলের কারণ নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। কেউ কেউ বলছেন, মহারাষ্ট্রের কায়দায় ‘অপারেশন বিহারে’র গেমপ্ল্যানও নাকি তৈরি করে ফেলেছিলেন অমিত শাহ। সেটা টের পেয়েই নীতীশ কুমার ‘অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’এর থিওরি নেন। সময় নষ্ট না করে বিজেপিকে ল্যাং মেরে ধরাশায়ী করার প্ল্যান সাজিয়ে ফেলেন। যোগাযোগ করেন তেজস্বী যাদব ও সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব নীতীশের পরিকল্পনা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি। অথচ তারা শুধু রাজ্য সরকারের শরিকই নয়, রয়েছে কেন্দ্রের ক্ষমতাতেও। কেন্দ্রের গোয়েন্দারা ডাহা ফেল। 
বিজেপি বলছে, উপ রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন নীতীশ। কিন্তু দিল্লির নেতৃত্ব তাতে রাজি হয়নি। তাই তাঁর গোঁসা। সেই কারণেই গেরুয়া শিবিরকে শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা এবং তেজস্বীর আরজেডি ও কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানো। এরার তাঁর লক্ষ্য নাকি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার।
রাজনীতিতে উচ্চাসনে বসতে চাওয়াটা নেতৃত্বের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির মধ্যেই পড়ে। কুর্সি দখলের জন্য জোটসঙ্গী বদলানোটা রাজনীতিতে অন্যায় নয়। বরং বলা ভালো, এটাই রাজনীতির কৌশল। যিনি যত ভালো অঙ্ক কষতে পারেন তাঁর সাফল্যের হার তত বেশি। সেদিক দিয়ে নীতীশ কুমার অবশ্যই একজন সফল রাজনীতিবিদ। তবে আগামী দিনে জাতীয় রাজনীতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠবেন কি না, সেটা বলবে সময়। 
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজেপির সঙ্গ ছেড়ে বেরিয়ে আসা ছাড়া নীতীশের কোনও উপায় ছিল না। কারণ বিজেপির জোটে থাকলে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ভয় তাঁকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খেত। যে কোনও সময় বিহারেও একজন ‘একনাথ সিন্ধে’ তৈরি করে দিত বিজেপি। সেই আশঙ্কা থেকেই তিনি তেজস্বীর হাত ধরতে বাধ্য হয়েছেন।
কুর্সি দখলের জন্য নীতি বিসর্জন দেওয়ার অভিযোগ নীতীশ কুমারের বিরুদ্ধে থাকলেও কোনও কেলেঙ্কারি তাঁকে ছুঁতে পারেনি। তাঁর ইমেজ পরিচ্ছন্ন। সেটাকেই কৌশলে তিনি বিভিন্ন সময় ক্ষমতা দখলের কাজে লাগিয়েছেন। ২০১৭ সালে জোট ভেঙে বিজেপির হাত ধরার সময় তিনি তেজস্বী যাদবের দুর্নীতিকেই ‘ঢাল’ করেছিলেন। সেই তেজস্বী জেলও খেটেছেন। এখনও শাস্তির খাঁড়া মাথার উপর ঝুলছে। তা সত্ত্বেও নীতীশ তাঁর হাত ধরেছেন। তাঁর সামনে অন্য কোনও রাস্তা থাকলে তিনি কিছুতেই ঩ফের লালুপুত্রের হাত ধরতেন না। 
নীতীশ কুমারের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন। তিনি বহু ওঠাপড়ার সাক্ষী। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেছেন, বিজেপির হাত ধরে তিনি বিহারে কিছুতেই ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না। উল্টে তাঁকে সামনে রেখে বিজেপিই বিহারে তাদের মাটি শক্ত করে নিচ্ছে। আর বিজেপির হাত ধরায় কেন্দ্রের জনবিরোধী নীতির দায় তাঁকে নিতে হচ্ছে। তারজন্য বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর দলের বিধায়ক কমেছে। চিরাগ পাসোয়ানকে পিছনে লাগিয়ে বিধানসভা ভোটে তাঁর আসন কমিয়েছে। এখন দলের মধ্যে বিভেদ তৈরি করছে। তারপর নীতীশের দলে বিজেপি একটা ‘কাঠের পুতুল’ তৈরি করতে পারলেই তাঁকে ছুড়ে ফেলে দেবে। তাই বিহার রাজনীতিতে তাঁর ‘চিরশত্রু’ বলে পরিচিত লালুপুত্রের হাত ধরেছেন।
নীতীশ কুমার এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসায় সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে কোন দল? অবশ্যই সিপিএম। সিপিএমের খুশি প্রকাশ পেয়েছে দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের কথায়। জোট ভাঙায় বিজেপি নীতীশ কুমারকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেছে। সেলিম সাহেবের প্রতিক্রিয়া, ‘বিজেপির দিকে গেলে বলা হতো মাস্টারস্ট্রোক। আর বিজেপির দানা চিবোননি বলে বিশ্বাসঘাতক বলা হচ্ছে।’
সিপিএমের এত খুশির কারণ কী? দেশে বিরোধী জোট শক্তিশালী হচ্ছে বলেই কি এত খুশি? উত্তর হল, মোটেই না। সিপিএমের খুশির অঙ্কটা অন্য। বাংলায় একুশের নির্বাচনে বিপুল জয়লাভের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই হয়ে উঠছিলেন বিজেপি বিরোধী অন্যতম প্রধান মুখ। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে মমতাকে নিয়ে সিপিএমের সাপের ছুঁচো গেলা অবস্থা হয়। এই অবস্থায় নীতীশ কুমার বিরোধী শিবিরে যোগ দেওয়ায় সিপিএম স্বস্তি পেয়েছে। এবার পুরনো বন্ধুকে সামনে রেখে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কিছুটা খবরদারির চেষ্টা তারা চালাতে পারবে।
কংগ্রেস ও লালুপ্রসাদের আরজেডির সঙ্গে সরকার গড়ে নীতীশ বিজেপির বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছেন। তারজন্য নীতীশ ও তেজস্বীকে মাশুল দিতে হবে। কারণ লক্ষ্যপূরণের পথে বাধা সৃষ্টি করলে বিজেপি যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, সেটা বাংলাকে দেখে গোটা দেশ বুঝেছে। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে টাকা বন্ধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি বেছে বেছে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতাদের গ্রেপ্তারির ব্যবস্থা করেছে। বঙ্গে একই সঙ্গে হাতে ও ভাতে মারার যৌথ কর্মসূচি নিয়েছে বিজেপি।
বিজেপির প্রতিহিংসার রাজনীতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল লালুপুত্র। তেজস্বী খুব ভালো করেই জানেন, বিজেপি কিল খেয়ে কিছুতেই তা হজম করবে না। এবার বিহারে সিবিআই এবং ইডির তৎপরতা বাড়বে। তা সত্ত্বেও বিজেপির ক্ষমতা হাইজ্যা঩কের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তেজস্বী। যে কোনও রকম আক্রমণ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত তিনিও। তাই উপমুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েই ছুড়ে দিয়েছেন চ্যালেঞ্জ। দিয়েছেন তাঁরই বাড়িতে সিবিআই এবং ইডির অফিস করার প্রস্তাব। বিহার বিধানসভায় নীতীশ কুমারের চেয়ে তেজস্বীর দলের আসন সংখ্যা অনেক বেশি। তাই লালুপুত্র অনায়াসেই মুখ্যমন্ত্রিত্বের কুর্সি দাবি করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। কারণ তিনি এবং তাঁর পরিবার বুঝেছে বিজেপি কতটা বিপজ্জনক। তাই মুখ্যমন্ত্রিত্বের চেয়েও বিজেপিকে আটকানোই তাঁর কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি খুব ভালো করেই জানেন, নীতীশের জোটের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে লাভ হবে বিজেপিরই। তাই কোনও দর কষাকষি না করে মুখ্যমন্ত্রিত্বের কুর্সি ছেড়ে দিয়েছেন নীতীশকে। 
আজ থেকে ৩২ বছর আগে ঠিক এভাবেই লালকৃষ্ণ আদবানির রথযাত্রাকে আটকে দিয়ে লালুপ্রসাদ ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। ফের একরার ইতিহাসের পাতায় নাম তুললেন তাঁরই পুত্র তেজস্বী যাদব। বিজেপির রাজ্য দখলের অশ্বমেধের ঘোড়াকে দিলেন আটকে। গেরুয়াকরণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বৃত্তটা সম্পূর্ণ করলেন তিনি। তারুণ্যের সাহস ও তাঁর আত্মত্যাগ দেখে অনেকে বলছেন, বিজেপির সঙ্গ ছাড়ায় নীতীশ কুমার বিরোধী নেতৃত্বের চোখে যতই ‘হিরো’ হোন না কেন, আসল নায়ক কিন্তু তেজস্বীই।

13th     August,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ