বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

ধন্যি রাজনৈতিক অধ্যাবসায়
শান্তনু দত্তগুপ্ত

শ্রদ্ধেয় নীতীশবাবু,
রাষ্ট্রপতি আর উপ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সৌজন্যে বিরোধী জোট রাজনীতির উনুনটা কেমন যেন নিবু নিবু হয়ে পড়েছিল। আচমকা আপনি তাতে জোরদার একটা ফুঁ মেরেছেন। বিরোধিতার যাবতীয় চর্চা আপাতত আপনাকে ঘিরে। কী কী করেছেন আপনি? প্রথমত, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে আর সি পি সিংকে যে আপনার চূড়ান্ত নাপসন্দ, তা স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রীর ডাক উপেক্ষা করে নীতি আয়োগের বৈঠকে যাননি। এবং তৃতীয়ত, সোনিয়া গান্ধীকে ফোন লাগিয়েছেন। আর আপনার এই তৃতীয় পদক্ষেপের পরই বিহারের রাজনীতি আচমকা গনগন করতে শুরু করেছে। সবাই আশ্চর্য হয়ে বলছে, নীতীশ কুমারের হলটা কী!
আসলে তারা বুঝতে পারছে না, আপনার কাছে রাজনৈতিক সম্মান এবং ক্ষমতাটাই শেষ কথা। এই প্রাপ্তিযোগ নিশ্চিত করতে আপনি যে কোনও নৌকায় পা রাখতে পারেন। এই তো সেদিনের কথা... ২০১৫ সালে লালুপ্রসাদ যাদবের আরজেডি এবং কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গড়েছিলেন। মাত্র ২০ মাস। তারপরই সব মধুচন্দ্রিমা শেষ। আচমকাই আপনি ঘোষণা করলেন, ইস্তফা দেব। আর মুখ্যমন্ত্রী থাকব না। কতকটা সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পদত্যাগের মতো ঘটনা। চোরেদের সরকারে তিনি থাকতে চাননি। তাই রেগেমেগে সরে গিয়েছিলেন। তবে তাঁর ক্ষমতার অত চাহিদা ছিল না। ওটা আপনার খানিক ছিল বটে। তাই দুর্নীতির নামে সরকার ভেঙে দিলেও সবটাই যে চটে গিয়ে করেছিলেন, তা নয়। বরং আপনার লক্ষ্য ছিল, বিজেপির লেজ ধরে আবার সরকারে আসার। নিখুঁত পরিকল্পনা। বিজেপি আপনাকে সমর্থন দিল, আপনি আবার মুখ্যমন্ত্রী হলেন।
এবার কি বিজেপির পালা? মশাই, আপনার হাবভাব কিন্তু তেমনই ঠেকছে। বিহারে শেষ বিধানসভা ভোট হয়েছিল ২০২০ সালে। ঠিক কোভিডের মারণ ঢেউয়ের পরপর। বিজেপির সঙ্গে জেডিইউয়ের জোট। সরকার গঠন এবং আবার বছর দুয়েক পর গোঁসা। ঠিক যেমনটা লালুর দলের সঙ্গে হয়েছিল। এবার অবশ্য কারণ বহু। একেই আর সি পি সিং ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনার বিরোধ সর্বজনবিদিত। তাই আপনি চেয়েছিলেন, জেডিইউ থেকে যদি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় কাউকে নিতেই হয়, সেটা অন্য কেউ। আর সি পি নন। তা সত্ত্বেও অমিত শাহ আপনাকে অবজ্ঞা করলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাত্তা দিলেন না। হতে পারে বিজেপি আপনাদের শরিক, হতে পারে আসন সংখ্যাতেও তারা জেডিইউয়ের থেকে এগিয়ে... তা সত্ত্বেও কিন্তু আপনি ওদের বশ্যতা স্বীকার করেননি! উল্টে কী করেছেন? আর সি পি সিংকে রাজ্যসভার টিকিটই আর দেননি। সোজা বার্তা বিজেপিকে—নীতীশ কুমারের দল থেকে প্রতিনিধি নিতে হলে তাঁরই মন মতো নিতে হবে। আপনাদের পোষ্য বেছে নেওয়ার থাকলে অন্য দল দেখুন। অথচ আপনি নিজেও জানেন, আপনার এই ‘বিদ্রোহ’ খুব ভালোভাবে নেবে না গেরুয়া কর্মকর্তারা। তাও আপনি কেন এমনটা করলেন? কারণ আপনি ওদের দুর্বলতাটা বুঝে গিয়েছেন। বিজেপি যতই হম্বিতম্বি করুক না কেন, বিহারে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা আদায় করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে জেডিইউ এবং লালুপ্রসাদের আরজেডি বিজেপিকে অনেকটাই পিছনে ফেলবে। পাশাপাশি কংগ্রেসেরও একটা ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে। আগের থেকে কম হলেও সেটা অস্বীকার করার মতো জায়গায় পৌঁছয়নি। মানে বাংলার মতো বিহারে কংগ্রেস একেবারে শূন্য হয়ে যাবে না। আসন্ন লোকসভা নির্বাচন নরেন্দ্র মোদির কাছে বড়সড় পরীক্ষা। গত দু’বার হেলায় জিতে এসেছেন তিনি। হ্যাটট্রিক করতে পারলে ইন্দিরা গান্ধীকে ছাপিয়ে যাবেন মোদি। জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে বসবেন একাসনে। এমন সুযোগ তিনি কোনওভাবে হাতছাড়া করবেন না। তার জন্য প্রত্যেকটি রাজ্যে বিজেপির একচ্ছত্র আধিপত্য চাই। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, বাই হুক অর ক্রুক। এটাই বিজেপি সরকারের মূলমন্ত্র। ভোটে জিততে না পারি, বিধায়ক কিনে সরকার ফেলে দেব। বিজেপি ছড়িয়ে পড়বে ভারতের ম্যাপের প্রত্যেকটা কোণায়। কিন্তু নীতীশবাবু, আপনি আচমকাই উল্টো চাল দিয়েছেন। ফলে বস্তুতই বিজেপি অস্বস্তিতে। অমিত শাহ এবং জে পি নাড্ডা, দু’জনেই বলেছেন, নীতীশকুমারই আসন্ন ভোটে আমাদের জোটের নেতা। তাতেও চিঁড়ে ভিজছে না। কিছুতেই না। আসলে বিজেপি বুঝতে পারছে না, আপনি ঠিক কী চাইছেন! হয় এসপার নয় ওসপার রাজনীতি? নাকি সোজাসাপ্টা ব্ল্যাকমেলিং? আসলে আপনার অভিমানটাই এরা কেউ বুঝল না। মুখে না বললেও রাজনীতির আনাচে কানাচে সক্কলে জানত, নীতীশ কুমার রাষ্ট্রপতি হতে চান। এনডিএ তাঁকে পদপ্রার্থী হিসেবে দাঁড় করাতেই পারত! করল না। তারা নিয়ে এল আদিবাসী মুখ। তাতেই মারমার কাটকাট। নবীন পট্টনায়েককে সম্পূর্ণ কনফিডেন্সে নিয়ে প্রার্থী ঘোষণা করলেন মোদি। আর আদিবাসী হওয়ায় হেমন্ত সোরেনের কাছেও দ্রৌপদী মুর্মু হয়ে গেলেন অটোম্যাটিক চয়েজ। বাকি রইল বিরোধীরা? ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি সবাই বিস্তর করে থাকে। ফলে ফাটল আবশ্যিক। এটাই চেয়েছিলেন মোদি। বিরোধী মহাজোটের নামে ভারতজুড়ে অবিজেপি যে মঞ্চের পাটাতন পাতা চলছিল, সেটাকে নড়বড়ে করে দেওয়া। এখন যদি সত্যিই আপনি বিরোধীদের শিবিরে চলে আসেন, সেটা জ্বরের মুখে প্যারাসিটামলের শামিল। 
আর সি পি সিং আপনার দল ছেড়ে দিয়েছেন। যাওয়ার আগে বলেছেন, আপনি নাকি বড্ড হিংসে করেন। সাত জন্মেও আপনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। হঠাৎ উনি প্রধানমন্ত্রীর প্রসঙ্গটাই কেন টানলেন? আসলে ঠিক জায়গাতেই আঘাত করেছেন আর সি পি। আপনি রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি। এবার রাজনৈতিক উৎকর্ষের শেষ সীমায় পৌঁছতে গেলে সামনে একটিই পদ বাকি রয়েছে—প্রধানমন্ত্রীর। বিরোধীদের জোট এখনও পর্যন্ত জমাট বাঁধতে পারেননি। নানা মুনির নানা মত থাকবেই। সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এমন পরিস্থিতিতে একজন কাউকে এগিয়ে আসতে হয়, যিনি প্রত্যেককে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে সক্ষম। হাঁকডাক করা নেতা নন, বরং মেরুদণ্ডের মতো পিছনে থেকে বিরোধী আদর্শকে দাঁড় করিয়ে রাখা। এ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া এমন কোনও নেতাকে রাজনীতির দরবারে দেখা যায়নি। কিন্তু তাঁর নেতৃত্ব কি রাহুল গান্ধীরা মেনে নেবেন? কংগ্রেস জাতীয় পার্টি। সারা দেশে আসন সংখ্যা ৫০ না পেরতে পারে, কিন্তু ঐতিহ্য তো আছে! ফলে কংগ্রেসই থাকবে জোটের মাথায়। আর একদিকে রয়েছেন শারদ পাওয়ার। অসুস্থ, কথা বলতে পারেন না, তাও ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে তাঁর অবস্থান চাই। উপ রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ঠিক করার জন্য বৈঠক ডাকলেন, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছাড়া। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এতদিন বিরোধীদের একজোট করার কঠিন কাজটা সামলে এসেছেন। তিনিই বা মানবেন কেন? মমতা বলে দিলেন, উপ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ভোট দেবে না। ব্যস, ফাটল আরও একটু বাড়ল। আর এই পরিস্থিতিতে আপনি মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন। ফোন করলেন সোনিয়া গান্ধীকে। সিগন্যাল পাঠালেন তেজস্বী যাদবের কাছে। ফলে এখন দিকে দিকে পরিষদীয় মিটিং চলছে। সবাই অঙ্ক করছে। প্রথম পদক্ষেপ, বিজেপিকে সরিয়ে বিহারে নতুন অঙ্কে ক্ষমতা দখল। এই ছকে সাফল্য পেলে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব আরও বাড়বে আপনার। তখন আপনি তাসটা ফেলবেন। বলবেন, আমি ছাড়া বিরোধীদের প্রধানমন্ত্রী মুখ আর কে হতে পারে?
নীতীশবাবু, আপনার রাজনৈতিক মস্তিষ্ক ধনধান্যে পুষ্পে ভরা। এ ব্যাপারে কারও কোনও সন্দেহ নেই। সংশয় রয়েছে আপনার উদ্দেশ্য নিয়ে। আপনি কতটা বিরোধী আদর্শের জন্য করবেন, আর কতটা নিজের জন্য... সে ব্যাপারে এখনও কেউ নিশ্চিত হতে পারছে না। বিরোধীরা তাই ভাববে... আরও ভাববে। আপনাকে নিয়ে। আজ বাদে কাল আপনি যদি বিজেপির থেকে বেটার কোনও অফার পেয়ে যান, তাহলে সেদিকে চলে যাবেন না তো? বেসরকারি চাকরির বাজারে এটা চলতি কৌশল—ভালো অফারের জন্য ছিপ ফেলা। আর নতুন অফার দেখিয়ে পুরনো সংস্থার সঙ্গে দর কষাকষি। 
ছিপ আপনি ফেলে দিয়েছেন। চারপাশে মাছেরা এখন ঘোরাফেরা করছে। আর আপনি? অপেক্ষায় আছেন। আপনি জানেন, ধৈর্য ধরতে হবে। দিল্লি এখনও বহু দূর।

9th     August,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ