বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

আমি যে বক্তব্য
রাখতে পারতাম
পি চিদম্বরম

মাননীয় চেয়ারম্যান,
এই বিতর্ক কয়েকদিন আগে হওয়া উচিত ছিল। বিধি ২৬৭-র অধীনে আলোচনা এবং অন্যকোনও নিয়মের মধ্যে ‘বাস্তবিক’ পার্থক্য বুঝতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। সরকার একগুঁয়ে, জনগণ এজন্য তার হামবড়া ভাবকে দায়ী করে।
মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক হোক। এটি আর্থিক পরিস্থিতি বিষয়ক বিতর্ক নয়। সেই বিতর্কে প্রবেশ করলে, এই সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বরং বলা ভালো, কুখ্যাত নোটবন্দির দিন থেকে ভুল-ব্যবস্থাপনা নিয়ে—মুখ খোলার মতো শ’খানেক বিষয় রয়েছে। 
দাম বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে গরিব ও মধ্যবিত্তের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। তাদের খরচ করার ক্ষমতা এবং সঞ্চয় কমে গিয়েছে। বেড়ে গিয়েছে পারিবারিক ধারদেনা। অপুষ্টি, বিশেষ করে  বেড়েছে নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, এই সত্য সরকার মানতে রাজি নয়। গতকাল, অন্য কক্ষে মাননীয়া অর্থমন্ত্রীর মুখে এই কথা শুনে আতঙ্কিত হলাম যে, জিএসটির হার বৃদ্ধি নাকি জনগণের উপর কোনও প্রভাব ফেলেনি! অর্থমন্ত্রীর এই বিবৃতিটি একটি সাধারণ ব্যাপারে ব্যবহার করা যেতে পারে, বিষয়টি আমার আলোচনার শেষেই জানাব।
ঘটনা ও তার কারণ 
আশা করি, এই কক্ষের বিতর্কটা বাইলেন এবং এঁদো গলির ভিতরে বাজে বকার পর্যায়ে গড়াবে না। ‘ম্যায়ঁ ম্যায়ঁ তু তু’ গোছের একটি বিতর্ক আমাদের কোনও সমাধানের পথ দেখাতে পারে না। সরকার ও সকল মাননীয় সদস্যের কাছে আমার নিবেদন, দুঃসহ মূল্যবৃদ্ধির বাস্তবতা মেনে নিয়ে একমাত্র প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি সামনে রাখুন, ‘মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কী পদক্ষেপ করবে?’
বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির কারণ চিহ্নিতকরণ থেকেই শুরু হোক এটা।   
ফিসকাল ডেফিসিট বা রাজকোষ ঘাটতি দিয়ে শুরু করতে চাই। 
আমরা জানি যে, বড় মাপের এবং ক্রমবর্ধমান রাজকোষ ঘাটতি দামের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এটা কীভাবে ঘটে, তার ব্যাখ্যা করার সময় আমার হাতে নেই। সরকারের অনুমান চলতি বছরের বাজেটে, রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ হবে ৬.৪ শতাংশ বা ১৬ লক্ষ ৬১ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। এপ্রিল-জুন মাসে বা অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে রাজস্ব ঘাটতি ৩ লক্ষ ৫১ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা স্পর্শ করেছে। আমরা জানি যে, সরকার সম্ভাব্য ব্যয়ের পরিমাণটা কম করে ধরেছিল এবং তার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ রাখেনি। সরকার কি সম্ভাব্য রাজস্ব আদায়ের পরিমাণটাও কম রেখেছে? সরকার কি রাজকোষ ঘাটতি ৬.৪ শতাংশে আটকে রাখতে সক্ষম হবে? আমরা একটা নির্দিষ্ট উত্তর চাই।
মনুষ্যসৃষ্ট আরও কিছু কারণ
এর পরেই আসে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিটের (সিএডি) কথা। এপ্রিল-জুন মাসে সিএডির পরিমাণ কমবেশি ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে। জুলাই মাসে ট্রেড ডেফিসিট বা বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছিল ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। অনুমান অনুযায়ী, যদি সারা বছরের সিএডি ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়, তার পরিণতিটা হবে বিপর্যয়কর। এই কক্ষে সরকারকে জানাতে হবে, সিএডি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তাদের প্রস্তাবটা কী। মাননীয় চেয়ারম্যান, আমি আবার একটি নির্দিষ্ট জবাব চাই।
তৃতীয় লালবাতিটা হল সুদের হার। আমরা জানি যে, ‘পলিসি রেট’ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ঠিক করা হয়। মানিটারি পলিসি কমিটিতে সরকার তিনজন সদস্যকে মনোনীত করেছে। আরবিআই বোর্ডে রয়েছেন সরকারের সচিব। সুতরাং, তার দায়বদ্ধতা সরকার অস্বীকার করতে পারে না। উন্নত 
অর্থনীতি অনুসরণের কালে ভারত সামঞ্জস্যপূর্ণ মুদ্রানীতির ভিত্তিতে বাজারে নগদের জোগান বাড়িয়েছিল। এখন তারা সুদের হার বাড়াচ্ছে। দেশ আজ ভিন্ন পন্থা নিতে পারবে কি না আমার সন্দেহ রয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়ালে চাহিদা কমতে পারে। তার ফলে লাগাম পড়তে পারে দামেও। কিন্তু সেটা বেচাকেনা, মুনাফা এবং সর্বোপরি, কর্মসংস্থানকেও প্রভাবিত করবে।
কৌশলটি নিহিত ‘ক্যালিব্রেশন’ বা পরিমাপমাত্রার ভিতরে। সরকার এবং আরবিআই গভর্নর কি বিষয়টিতে সহমত পোষণ করেন? সুদের হারের পূর্বাভাসটা কি সরকার আমাদেরকেও জানাবে?
চতুর্থ হল সরবরাহের দিকটি। যেহেতু আপাতত উদার আমদানির ব্যাপারটা খারিজ করা হয়েছে, তাই জানতে চাই, দেশীয় উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে সরকার কী পদক্ষেপ করছে? ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সংস্থাগুলি (এমএসএমই) গভীর সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। অগ্রিম সাহায্য না-পেলে তারা সাহায্য করতে পারে না। বৃহৎ কোম্পানিগুলি যথাসম্ভব বেশি মুনাফা করতে আগ্রহী, তাই তারা জোগানে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে। জিএসটি আইন এবং জিএসটি হার দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রিত। আমার প্রশ্ন, পণ্য ও পরিষেবার পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকার কী করতে চায়?
মূল পাপ
সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ফেলেছে যেটা আমার তালিকার সেটাই শেষ আইটেম: সরকারের কর নীতি। সরকারের মূল পাপ বলে আমি যেটাকে চিহ্নিত করি তা হল, পেট্রল ও ডিজেলের উপর নির্দয়ভাবে কর ও সেস চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত—সরকারের এই ভুল পদক্ষেপই মুদ্রাস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করেছে। তেল কোম্পানিগুলির মাধ্যমে কর, সেস এবং ডিভিডেন্ড (লভ্যাংশ) আকারে সরকার ২৬ লক্ষ কোটি টাকার মতো বিপুল অর্থ আদায় করেছে। এই সরকার নির্বোধ, হৃদয়হীন ও গরিব-বিরোধী। ওইসঙ্গে যোগ করুন, দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ যেসব পণ্য কেনেন এবং পরিষেবা গ্রহণ করেন সেসবের উপর পর্যায়ক্রমে জিএসটি হার বৃদ্ধি। 
এই সরকার ছয় বছরের কৃতি দুবের ব্যথা বোঝে না, যে মেয়ে জানে না আর একটি পেন্সিল চাইতে গেলে কেন তার মা তাকে তিরস্কার করেন কিংবা সেই মায়ের ব্যথাও বোঝে না এই সরকার, যিনি তাঁর মেয়েকে আর একটি পেন্সিল দিতে পারেন না। যদি এই সরকারের একটি মাথা এবং হৃদয় থাকে তবে পেট্রল এবং ডিজেলের উপর চেপে থাকা কর ভদ্রস্থ করবে, কমিয়ে দেবে রান্নার গ্যাসের (এলপিজি) দাম এবং দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের উপর বর্ধিত কর প্রত্যাহার করে নেবে।
মাননীয় চেয়ারম্যান, আমি আগে উল্লেখ করেছি, এমন একটি ‘পরীক্ষা’র প্রস্তাব দিয়ে আমাকে আমার বক্তব্য শেষ করতে দিন। মাননীয় চেয়ারম্যান আপনি, মাননীয়া অর্থমন্ত্রী এবং আমি—আমরা এই তিনজন—সঙ্গে কোনওরকম নিরাপত্তারক্ষী না নিয়ে চলুন, একটি সাধারণ গাড়িতে চেপে দিল্লির কোনও মধ্যবিত্ত পাড়ায় কিংবা একটি বস্তিতে যাই। মাননীয় চেয়ারম্যান, দয়া করে সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞাসা করুন—জ্বালানি ও এলপিজির দাম এবং জিএসটি হার নিয়ে তাঁরা বিপর্যস্ত কি না। আমি তাঁদের রায় মানতে রাজি আছি। আমি আশা করি, মাননীয়া অর্থমন্ত্রীও আম আদমির রায় মেনে নেবেন।
ধন্যবাদ।
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত 

8th     August,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ